ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৪
বিজন সাহা
বেরিওজোভাইয়া পইমা
নিঝনি নভগোরাদ বা নিঝেগোরাদে আমাদের চেষ্টা ছিল আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলা এবং এখানকার ইতিহাস সম্পর্কে জানা। দিলীপ তো এসেছে মূলত সেই উদ্দেশ্য নিয়ে। গঙ্গার তীরে যেমন বিভিন্ন সময় নতুন নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে এবং তা যেভাবে ভারতের আর্থসামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে রাশিয়ায় ঠিক সেভাবেই ভোলগার তীরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদ এবং সেসব রাশিয়ায় আর্থসামাজিক জীবনে ঠিক একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম দিকে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দিলীপ একটু একটু করে বুঝতে পেরেছে যে পুরানো ইতিহাস জানতে হলে উপাসনালয়ে না গিয়ে উপায় নেই। তার আরও একটা কারণ ছিল। প্রথমত এসব ইতিহাস জানা যায় একাডেমিশিয়ানদের কাছে থকে, কিন্তু এই মুহূর্তে তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে। পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে এখানে শিক্ষা বর্ষ শুরু হয়, তাই ফিরে এলেও আগামী কিছুদিন তারা ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন, তাই ওমুখো হওয়া এখন অর্থহীন। তাহলে বাকি রইল বয়স্ক মানুষ। তাদের কোথায় পাওয়া যাবে গির্জা ছাড়া? তাই যে লোকের কাছে আমরা বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম তাকে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললে তিনি কয়েকটি জায়গায় যেতে বলেন। এর একটি ছিল শহরের মধ্যে পেচরস্কি মনাস্তির আরেকটি বেরিওজোভাইয়া পইমা। আমরা ঠিক করলাম প্রথমেই বেরিওজোভাইয়া পইমা যাব। এটা শহর থেকে কমবেশি ২০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট একটা গ্রাম। সেখানে পঞ্চাশের দশকে এই জনপদ তৈরি করা হয়। এখান থেকে মূলত পিট নামে এক ধরণের জ্বালানি সংগ্রহ করা হত শহরের একটা কারখানার জন্য। এটা ছিল সাময়িক জনপদ। ১৯৮২ সালে পিট সংগ্রহ বন্ধ হলেও জনপদ থেকে যায়। আমরা সেখানে একটা গির্জার লোকজনদের সাথে কথা বলতে গেলাম। তবে আশা ছিল দুই এক জন স্থানীয় বয়স্ক মানুষ পেয়ে যেতে পারি যারা আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।
আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন রকম পূজাপার্বণ হত। দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা সহ বিভিন্ন পুজাও হত। ছোটবেলায় ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস ছিল। তবে সেটা কখনোই মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। আমার প্রথম গল্পের বই ছোটদের রামায়ণ, ১৯৭২ সালে ইন্ডিয়া বেড়াতে গেলে বড় মামা সেটা উপহার দেন। পরে ক্লাস সিক্স ও সেভেনে জন্মদিনে সুধীর দা কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশিদাসী মহাভারত উপহার দেয়। সেসব পড়ে ঠাকুর দেবতাকে কখনই বাইরের কেউ মনে হয়নি। এরা ছিলেন অনেকটা পাড়ার মানুষের মত যারা বনে বাদারে দেখা দিতে পারেন। এক কথায় ছোটবেলায় ঈশ্বর আমার জন্য কখনই দূরের কেউ ছিল না। পরে অবশ্য বিভিন্ন কারণে ঈশ্বরের সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। আর যখন থেকে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হই তখন তো উনি আমার ঘোর শত্রু, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পরে অবশ্য এসব নিয়ে ভাবা বাদ দিই। ঈশ্বরের সাথে বন্ধুত্ব হয় – আমরা এক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করি আর ঠিক করি কেউ কারও কাজে নাক গলাব না। একবার দুবনায় দেশ থেকে এক কালের এক নামকরা বিজ্ঞানী বেড়াতে এলেন। কথায় কথায় ওনাকে যখন বললাম ঈশ্বর আমার বন্ধু, উনি তো আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন ঈশ্বর কারও বন্ধু হতে পারে না। আমিও বললাম, এটা ঈশ্বরের সমস্যা। এরপর আর এ নিয়ে ভাবা হয়নি। তবে এটা ঠিক ঈশ্বরে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দুটোই বিশ্বাস, এখানে লজিকের স্থান নেই। তাই এসব নিয়ে তর্ক মানে অযথা সময়ের অপচয়। তাছাড়া কসমোলজি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মহাবিশ্ব কত বৈচিত্র্যময়। তাই কেউ যদি বিশ্বাস করে সেটা যেমন তার অধিকার, কেউ বিশ্বাস না করলে সেটাও তার অধিকার। এখানে বাঁধা দেয়া মানে কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যতক্ষণ কারও বিশ্বাস সামাজিক ভাবে ক্ষতিকর না হয় সেটা নিয়ে না ভাবাই ভালো। তাছাড়া আজকাল শুধু ধর্ম নয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা অন্যান্য হাজার তন্ত্রের নামেও বিভিন্ন ধরণের অনাচার করা হচ্ছে। আসলে সমস্যা ধর্মে নয়, সমস্যা অন্ধবিশ্বাসে। এমনকি কেউ যদি বিজ্ঞানেও অন্ধভাবে বিশ্বাস করে সেও যেকোনো ধর্মীয় মৌলবাদীর মতই ভয়ঙ্কর। যাহোক এত কথা আসলে এই গ্রামে দুই মহিলার সাথে কথা বলার প্রেক্ষাপট।
অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত এলাম সেই গ্রামে। শুরুতেই কাঠের তিখভিনস্কি গড মাদার আইকন গির্জা। নক করলাম। কোন উত্তর পেলাম না। কী করা। গেলাম গ্রামের অন্য প্রান্তে যদি কাউকে পাওয়া যায়। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে বুঝলাম কিছু জানতে হলে শেষ পর্যন্ত ঐ গির্জায়ই যেতে হবে। ফিরে এসে দেখি সেখানে লোক আছে। হয়তো কোন কাজে বাইরে গেছিলেন। আমাদের গ্রহণ করলেন। দেখালেন তাদের ছোট্ট গির্জা। বয়স কত হবে? সত্তর, আশি! এখানেই জন্ম, এখানেই শৈশব ও যৌবন কেটেছে ওনাদের। সোভিয়েত আমলে স্থানীয় কারখানায় কাজ করতেন। নতুন রাশিয়ায় ধর্মে মন দিয়েছেন, গির্জার দেখাশুনা করেন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ বয়সের অধিকাংশ মানুষই সোভিয়েত আমলের জন্য নস্টালজিক হয়। কারণ সে সময় এদের অধিকাংশের ছিল নিশ্চিন্ত জীবন। ছিল স্থায়ী চাকরি বা উপার্জন, ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়াশুনা, সবার বিনামূল্যে চিকিৎসা, মাথার উপরে ছাদ – আহামরি কিছু না হলেও এক ধরণের নিশ্চয়তা। তাই এই বয়সের অধিকাংশ মানুষই সেই সময়ের জন্য মন খারাপ করে, বর্তমান সময় সম্পর্কে কিছুটা হলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাই জিজ্ঞেস করলাম
কেমন লাগে এই সময়?
ভালোই তো। এটা ঠিক এখন এলাকায় তরুণ তরুণীরা কেউ থাকে না বললেই চলে। ভালো বেতনের কাজ পাওয়া কষ্ট। তাই সবাই যায় শহরে কাজে, সেখানেই থাকে। কালেভদ্রে আসে। তবে এখন অনেক ভালো আছি। তাছাড়া জীবন আগের চেয়ে সোজা হয়ে গেছে। সব কিছুই অটোম্যাটিক। আগের মত জিনিসপত্রের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয় না।
তা ঠিক, তবে তখন চাকরির নিশ্চয়তা ছিল, শিক্ষা, চিকিৎসা ফ্রি ছিল। নিরাপত্তা ছিল। সেসবের জন্য খারাপ লাগে না?
দেখুন, তখন অনেক কিছুই ছিল, আবার অনেক কিছুই ছিল না। এই যে আজ আমরা এখানে গির্জায় বসে আছি, উপাসনা করছি – তখন সেই স্বাধীনতা ছিল না। সব কিছু তো আর চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা – এসবের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় না। সে সময় বয়স কম ছিল। ঈশ্বর নিয়ে ভাবতাম না, কিন্তু এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হয় ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাস – এটাও গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত সেই অধিকার থেকে তো আমাদের বঞ্চিত করতে পারেন না।
গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রত মহিলা
আমরা সেখানে বসে তাদের সাথে আরও অনেকক্ষণ কথা বললাম, জানলাম সেই গ্রামের কথা। তবে এখানে ভোলগা তীরের জার্মানদের সম্পর্কে তারা কিছুই বলতে পারলেন না। প্রথম দিকে একটু আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত ছবি তুলতে দিলেন। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম শহরের দিকে। আমার বার বার মনে হল ওনাদের কথা – তখন ঈশ্বরে বিশ্বাস করার, তাঁর উপাসনা করার স্বাধীনতা ছিল না, এখন সেটা আছে। বিভিন্ন দেশে বামপন্থী রাজনীতি করার ক্ষেত্রে অনেক বাঁধা বিপত্তি ছিল। আমরা এটাকে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করতাম। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন দেখতাম মানুষকে অবাধে ধর্ম পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না সেটা ঠিক বলে মনে হত, মনে হত এসব পশ্চাৎপদ ধারণা থেকে মানুষকে সরিয়ে আনার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু ওনাদের কথা শুনে বুঝলাম আমার জন্য যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ওনাদের জন্য এই ভক্তি, এই বিশ্বাসও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুর বাইরেও একটা ভাব জগত আছে। এই যে আমরা মিউজিক শুনি, বই পড়ি, এসব যেমন আমাদের মনকে প্রসন্ন করে, আমাদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে, ধর্মে বা ঈশ্বরে বিশ্বাস একই ভাবে এদের জন্য মানসিক শান্তি বয়ে আনে। আমরা সবাই যদি প্রকৃতির সন্তান হই আর প্রকৃতি যদি বিভিন্ন মানসিকতার মানুষকে নিজের বুকে ধারণ করে তাহলে আমরা কে তাতে বাঁধা দেবার যদি না সেটা সমাজের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে।
বেরিওজোভাইয়া পইমার কিছু ছবি
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=250
ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=bR6MdCP1oiQ&t=304s
0 Comments