জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৯৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

সহস্রদ্বীপোদ্যানে এই গাছের তলাতেই সমাধিস্থ হন স্বামীজী

পর্ব ৯৩
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 জাত সাপের ছোবল

 কৃস্টিন ও শ্রীমতী ফাঙ্কি জাত সাপের ছোবল খেয়েছিলেন। স্বামীজীর প্রথম বক্তৃতার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বক্তৃতাও তাঁরা শুনতে গিয়েছিলেন। সেই সময় স্বামীজী ডেট্রয়েটে অবস্থান করেছিলেন ছয়মাস। কৃস্টিন তাঁর স্মৃতিকথায় এই বিষয়ে জানিয়েছেন --“আমরা বুঝেছিলাম আমরা আমাদের ‘আচার্য’ খুঁজে পেয়ে গেছি। ‘গুরু’ শব্দটি তখন আমরা জানতাম না। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও আমাদের তিনি চিনতেন না। কিন্তু তাতে কি আসে যায়?” ( স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিকথা -- ইং, ভগিনী কৃস্টিন, পৃষ্ঠা ১৫৮ ) স্বামীজী ডেট্রয়েট ছেড়ে অন্যত্র বেদান্ত প্রচারে চলে গেলে এই দুজনের সঙ্গে সাময়িকভাবে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ১৮৯৫ সালের জুলাই মাসে কৃস্টিন ও শ্রীমতী ফাঙ্কি সংবাদ পেলেন স্বামীজী একদল শিক্ষার্থীসহ থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে অবস্থান করছেন। থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে অবস্থানের বিষয়ে স্বামীজী ওলি বুলকে জানাচ্ছেন --“বর্তমানে গ্রীনএকরে যেতে পারছি না, থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে ( সহস্রদ্বীপোদ্যানে ) যাবার বন্দোবস্ত করেছি -- উহা যেখানেই হউক। তথায় আমার জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের এক কুটির আছে। ...আমার ক্লাসে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ‘যোগী’  করতে চাই। গ্রীনএকরের মতো কর্মচঞ্চল হাট একাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।” পত্রে নিউ ইয়র্কের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখ করেছেন স্বামীজী। লিখছেন -- “জ্ঞানযোগের ক্লাসে যাঁরা আসতেন, তাঁদের ১৩০ জনের নাম মিস হ্যামলিন টুকে রেখেছিলেন।... আরও ৫০ জন বুধবারে যোগ-ক্লাসে আসতেন -- আর সোমবারের ক্লাসে আরও ৫০ জন।“ ( যুগনায়ক বিবেকানন্দ, স্বামী গম্ভীরানন্দ)
 এদিকে কৃস্টিন এবং শ্রীমতী ফাঙ্কি গুরুর উদ্দেশ্যে থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কের দিকে রওনা দিলেন। দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে হল তাঁদের। পাঁচশো মাইলেরও ( ৯০০ কি মি ) বেশি। প্রথমে ট্রেনে চেপে নিউইয়র্ক, তারপর নদীপথে স্টিমারে চেপে থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্ক। এই বিষয়ে প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা লিখছেন --“প্রবল ঝড় ও বর্ষণে পথ-ঘাট কর্দমাক্ত। তারই মধ্যে পাহাড় ও ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে ভিজে কর্দমাক্ত জামাকাপড়ে প্রায় ঘসড়াতে ঘসড়াতে রীতিমতো অবাঞ্ছিত অতিথিরূপে রাত্রিবেলা তাঁরা এসে পৌঁছালেন।
সহস্রদ্বীপোদ্যানে স্বামীজী

 পরবর্তীকালে মেরী ফাঙ্কি স্মৃতিচারণ করেছেন --‘তিনি আমাদের সাদরে মধুরস্বরে স্বাগত জানালেন। এটা ছিল আমাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।’ নিচে কোনও গ্রামে নিজেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন -- এইরকম মনস্থ করেই তাঁরা গিয়েছিলেন। কিন্তু অধ্যাত্ম পিপাসুদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তাঁরা সানন্দে সম্মত হলেন।” ( স্বামীজীর কৃস্টিন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয়)
 থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে স্বামীজীর নির্বিকল্প সমাধি
--------------------------------------------------------------------------
 থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে থাকাকালীন স্বামীজী নির্বিকল্প সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আর এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন এই দুই মহিলা ----- মেরি ফাঙ্কি এবং কৃস্টিন। স্বামীজী যেদিন এখান থেকে বিদায় নেন তার আগের দিন ঘটেছিল এই ঘটনা। শ্রীমতী ফাঙ্কি এই বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন -- “তিনি আমাকে এবং কৃস্টিনকে একটু বেড়াবার জন্য ডাকলেন যাতে আমাদের সাথে একান্তে কথা বলতে পারেন। সারা গ্রীষ্মকালটা তাঁকে অন্যান্য শিষ্যরা ঘিরে রেখেছিলেন। স্বামীজী মনে করেছিলেন আমাদের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলার প্রয়োজন আছে। আমরা প্রায় আধমাইল দূরে একটা উঁচু পাহাড়ে উঠলাম। চারপাশে গাছপালা এবং অপার নির্জনতা।... আমাদের প্রত্যাশামতো কথাবার্তার পরিবর্তে হঠাৎ তিনি বলেন উঠলেন, ‘এখন আমরা ধ্যান করব। এই বোধিবৃক্ষের নিচে আমরা বুদ্ধের ন্যায় হব।’ মনে হলো তিনি ব্রোঞ্জ-এর মূর্তিতে রূপান্তরিত হলেন। -- এত শান্ত, এত সমাহিত। তারপর বজ্রপাত হলো, বৃষ্টি নামল, তিনি বুঝতেই পারলেন না। আমার ছাতাটা তুলে ধরে তাঁকে যতটা সম্ভব বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলাম। তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। সমগ্র জগত তাঁর কাছ থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। একটু পরেই দূর থেকে কোলাহল শুনতে পেলাম। অন্যেরা ছাতা ও বর্ষাতি নিয়ে আমাদের খুঁজতে এসেছে। স্বামীজী লজ্জিতভাবে চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কলকাতাতেও আর একবার বৃষ্টির দিনে আমার এরকম হয়েছিল’।” ( স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিকথা, ইং , মেরি ফাঙ্কি )
 থাউজেণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে স্বামীজীর অবস্থানের পর্বটি নিয়ে ফরাসি মনীষী রোমা রোল্যাঁ লিখছেন --“It was immediately after ( June-July, 1895 ), during the summer weeks spent among a chosen band of devoted souls at the Thousand Island Park, that Vivekananda definitely decided, according to the evidence of Sister Christine, on his plan of action. On a hill near a forest above the river St. Lawrence on an estate generously placed at the Master's disposal for his exposition of the Vedanta, a dozen chosen disciples were gathered together. He opened his meditations by a reading from the Gospel according to St. John. And for seven weeks not only did he explain the sacred books of India, but ( a more important education from his point of view ) he sought to awaken the heroic energy of the souls placed in his hands: ‘liberty’, ‘courage’, ‘chastity’, ‘the sin of self-depreciation’, etc. Such were some of the themes of his Interviews.” ( The life of Vivekananda and the Universal Gospel by Romain Rolland, Advaita Ashrama, Myabati )
🍂

Post a Comment

0 Comments