জ্বলদর্চি

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে/পর্ব-৪/সুদীপ সেন

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে
পর্ব-৪

সুদীপ সেন


জল আর অক্সিজেন এই দুটোই প্রকৃতির দেয়া সেরা জীবনদায়ী অমূল্য উপহার যা কোনও টাকা ছাড়াই প্রকৃতি আমাদের দিয়ে আসছে। আর নিখরচায় প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া যায় বলেই আমরা এর মুল্য ভুলে গেছি। অক্সিজেন না পেলে মাত্র কয়েক মুহূর্ত আর জল না পেলে কয়েক দিনে শেষ হবে আমাদের এই বিনোদন – উন্নয়ন – আন্দোলন – আস্ফালনে ভরা জীবন। 

আমরা ২০ টাকা দিয়ে ১ লিটার জল যখন কিনি তখন শেষ ফোটাটা পর্যন্ত খেয়ে ফেলি কিন্ত রাস্তার সরকারি কলের মুখ থেকে যখন জল পড়ে যেতেই থাকে তখন আমাদের অধিকাংশই দেখেও না দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। অনেকে আবার শাওয়ার চালিয়ে চান করতে গিয়ে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি জল ব্যবহার করছে। অনেকে জলের ট্যাপ খুলে হাত – মুখ ধুয়েই চলে অনেকক্ষণ ধরে। হাত মুখ ধোয়ার জন্য যতটুকু জল দরকার তার কয়েকগুন ট্যাপের মুখ খোলা থাকার জন্য অপচয় হয়। অনেকের বাড়ির ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে অঝোর ধারায় জল পড়তেই থাকে, শব্দ শুনেও বাড়ির কেউ জল পড়া বন্ধ করে না। অনেকে অনুষ্ঠান বাড়িতে মিনারেল ওয়াটারের সিল করা বোতল থেকে এক চুমুক খেয়ে বাকিটা ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে । অনেকেই কমোডের মধ্যে সিগারেটের ছাই বা টিস্যু পেপার জাতীয় আবর্জনা ফেলেন আর ফ্ল্যাশ টেনে জল নষ্ট করেন। ভুগর্ভস্থ জলের ভান্ডার আমাদের সীমিত, সেই জল কারেন্ট পুড়িয়ে ( তাতেও কয়লা, অক্সিজেন এর মতো সম্পদ খরচ হচ্ছে আর কার্বন ডাই অক্সাইডের মত বিষাক্ত গ্যাস উদ্গীরন হচ্ছে ) ইলেকট্রিক পাম্পের সাহায্যে মাটির উপরে তোলার পরে তাকে ব্যবহার না করেই আবার ড্রেনে ফেলে দেয়া এক বিরাট অপচয়, একধরনের অপরাধ। 

এই ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার যত কমছে তত বেশী মাটির গভীরে আমাদের পৌঁছাতে হচ্ছে জল সংগ্রহের জন্য। বহু জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর অনেক নেমে যাওয়ায় গরমকালে পানীয় জল পাওয়া যাচ্ছে না ( অথছ কিছু বছর আগেও পাওয়া যেত ), চাষের জন্য জল পাওয়া যাচ্ছে না, বহু জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক জাতীয় বিষাক্ত অনুকনা মিশে আমাদের স্বাস্থের ক্ষতিসাধন করছে। একটু ভালো পানীয় জল সংগ্রহের জন্য অনেক জায়গাতেই মানুষকে অনেক দূর থেকে মাথায় করে কলসি ভরে জল নিয়ে আসতে হয়। ব্যাঙ্গালোর / চেন্নাই এর মত অনেক শহরেই এখন জলের এত অভাব যে দূর দূর এলাকা থেকে শয়ে শয়ে ট্যাংকার ভর্তি জল এনে শহরের আবাসিকদের কাছে বিক্রি করা হয়। 

তাই সময় এসেছে সবাই মিলে সচেতন ভাবে জল বাঁচানোর ( প্রকৃত অর্থে প্রান বাঁচানোর ) বা ভবিষ্যতের জন্য জল সঞ্চয়ের চেষ্টা করার, সবাই মিলে করলে সেই বিন্দু বিন্দু জল জমা করেই আমরা সিন্ধু সৃষ্টি করতে পারবো।  
🍂
১) রাস্তার কল থেকে জল পড়ে যেতে দেখলে এক মিনিট দাড়িয়ে কলটা বন্ধ করে দিতে পারি।
২) বাড়ির ছাদের ট্যাঙ্কের জল উপচে নিচে পড়ার শব্দ পেলে, জলের পাইপের ভাল্ভটা বন্ধ করে দিতে পারি। পাশের বাড়ির ট্যাঙ্ক থেকে জল পড়লে, প্রতিবেশীরা কয়েকজন মিলে বাড়ির মালিককে অনুরোধ করতে পারি।
৩) অনুষ্ঠান বাড়িতে প্রত্যেককে একটা করে মাঝারি সাইজের জলের বোতল না দিয়ে, প্রত্যেক টেবিলে ১টা করে ১ লিটারের বোতল আর সাথে ৫-৬ টা কাগজের গ্লাস দিতে পারি। যার যতটুকু দরকার, সে ততটুকু জল নিয়ে খাবে, অহেতুক অপচয় হবে না।
৪) বাড়ির বাগানে বা গাছের টবে রোজ জল দিতে হয়, বাড়ির বাইরের দিকের ড্রেনও রোজ পরিষ্কার করতে হয়, মাঝে মাঝে গাড়ি ধুতে হয়। বাড়ির ঘরধোওয়া জল, স্নান বা হাত – মুখ ধোওয়ার পরে সেই জল একটা আলাদা ট্যাঙ্কে রাখতে পারলে কিন্তু এই কাজে অনেকটাই ব্যবহার করা যায়।    
৫) স্নান করার সময় শাওয়ারের পরিবর্তে বালতিতে জল ভরে স্নান করলে জল কম লাগবে। দরকারে বালতিতে এক টুকরো বরফ ফেলে দিলে জলে ঠাণ্ডা ভাব বাড়বে আর অল্প জলেও স্নিগ্ধ স্নানের আরাম বোধ হবে। দরকারে জল সাশ্রয়কারী বিশেষ প্রযুক্তির শাওয়ার হেড লাগানো যেতে পারে। টয়লেট পাইপে / সিসটার্নে লিক থাকলে তা সারিয়ে নিতে হবে। হাত-মুখ ধোয়ার সময় ট্যাপ খুলে না রেখে, বালতি – মগ ব্যবহার করলে জল সাশ্রয় হবে।
৬) সারা বাগান জুড়ে জল না ঢেলে, শুধু গাছগুলোর গোড়ায় অল্প অল্প করে কিন্তু বার বার জল দিন, যাতে জল গাছের কাছাকছি মাটির গভীরে যাবার সময় পায়। সম্ভব হলে গাছের গোড়ায় কিছু নুড়ি পাথর রেখে দিন, চট করে মাটি শুকাবে না।
৭) বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারলে, গাড়ি ধোওয়া, কাপড় কাঁচা, গাছের টবে বা ঘর মোছার কাজে লাগানো যায়। 
8) রাস্তায় কোথাও কর্পোরেশনের জলের পাইপ লিক নজরে পড়লে, একটা ছবি তুলে লোকেশন জানিয়ে কতৃপক্ষের ( প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে ) নজরে আনা যেতে পারে। 
৯) বাথরুমের সিসটার্নে যত লিটার জল থাকে সাধারণত অত জল সবসময় লাগে না। একটা ১ লিটারের জলের বোতলে জল আর কয়েকটি ছোট পাথরের টুকরো ভরে বোতলের মুখটা আটকে সিসটার্নের যন্ত্রপাতির নিচে কায়দা করে শুইয়ে রাখলে প্রতিবার ব্যবহারের সময় ১ লিটার করে কম জল খরচ হবে।
১০) ওয়াশিং মেসিন সবসময় ফুল লোডে চালালে, একবারে যতটা সম্ভব বেশি কাপড় কাচলে জল সাশ্রয় হবে।

আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব পশুপাখি, মাছ, গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদের প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক জীবনধারণের মধ্যে রেখে। তার জন্য সবার আগে চাই বিশুদ্ধ পানীয় জল আর পরিষ্কার শুদ্ধ অক্সিজেন। পৃথিবীর সব থেকে উন্নত মস্তিস্ক এবং মননের অধিকারী হিসাবে সমগ্র জীবজগতের জীবনধারণের এই নুন্যতম প্রয়োজনটুকুর নিরন্তর সরবরাহ নিশ্চিত এবং নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব স্বীকার করেই এবার আমাদের সবাই মিলে এগিয়ে চলার পালা।  
 "প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"।

Post a Comment

0 Comments