জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ১৬/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৬

গৌতম বাড়ই


বসন্তসেনা মনখারাপ করে ফিরেছিল সেদিন অফিস থেকে। জেনারেল শিফটের ডিউটি ছিল । সুশোভন মেয়ে ঘরে ঢুকতেই, হাসনুমায়ের মুখের বার্তাটি পড়ে ফেলেছিলেন। তিনি জানেন, মানুষেরা তাদের নির্দিষ্ট ঘরে ফেরেন ঠিকই, তবে একই পথে ফেরেন না তারা প্রতিদিন। যদিও প্রতিদিনের ফেরাটি সেই ঘরে ফেরা সবমানুষের গড়পড়তা আনন্দ সহকারেই হয়, কিন্তু কখনও আনন্দমুখে ছায়া দেখলে, সেদিন চমকে উঠতে হয়। আজকে বসন্তসেনার মুখটির ভেতর ঈশানে কোলে কালো মেঘের মতন একটুকরো কালো মেঘ জমে আছে যেন, সেরকম ছায়ার একটুকরো! হাসনুমা যতই সে মুখে কৃত্রিম হাসিতে ভরিয়ে ঘরে ঢুকুক না কেন, একটা যেন কী আজ ঘিরে আছে!  সুশোভনবাবু চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান না, তার জীবনবোধ, মেধা, তার ভেতর গড়ে ওঠা নিজস্ব এক সংস্কৃতি তাকে এইভাবে গড়ে তুলেছে। তিনিও হাসিমুখে দরজা খুলে পাশে দাঁড়ালেন, অভ্যাসবশত জিগ্গেস করলেন - " মা, ভালো আছিস তো? আয় ভেতরে ।"

বসন্তসেনা বাবাকে হাসিমুখে প্রত্যুত্তর দিয়ে নিজের ঘরের ভেতর চলে গেল। সুশোভনবাবুও নিজের ঘরে গেলেন। তিনি ভালো করে জানেন, এখন পাক্কা আধঘন্টা রিফ্রেশ রুম, তারপর সে বেরোবেন তরতাজা হয়ে নিজের মতন করে । তবে আজ হলটা কী? এই রকম এক দুশ্চিন্তা তার মনের মধ্যে এককোণে পড়ে রইলো। দীপা থাকলে হয়ত তার মনের ভিতরটা কিছুটা হালকা থাকত। সব স্বামী- স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ায় এ রকম মানসিক অনুভূতি নিশ্চয় জড়িয়ে থাকে। এই সব ছোটখাটো দুশ্চিন্তাগুলো পারস্পরিক ভাবে ভাগাভাগি হয়ে যায় বলে। 
  

অনেকক্ষণ হল, আজ বোধহয় একটু বেশি সময় নিচ্ছেন। রিফ্রেশ রুমের বাইরে থেকে সুশোভন হাঁক দিলেন আস্তে করে, " কী রে হাসনু- মা এখনও হল না?" ভিতর থেকে বসন্তসেনা উত্তর দিল-" হ্যাঁ বাবা, বেরুচ্ছি।" 

সুশোভন নিজের  ঘরে ফিরে এসে পাশে একটা বই খুলে উল্টো করে রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ছিল। ভাবনাহীন এক হারিয়ে যাওয়া যাকে বলে। টের পায়নি তার পাশে কখন তার মেয়ে এসে বসেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তিনি টের পেলেন, হাসনু- মা তার পাশে এসে বসেছে। ধড়মড় নিজেকে সোজা করলেন। এতে মেয়ে একটু রাগত স্বরেই বলল-" এত ধুড়ধাড়  করে উঠে বসার কী হল? আরও একটু জিরিয়ে নাও না। " সুশোভন তাকালেন মেয়ের মুখের দিকে, অন্য দিনের তুলনায় চোখ- মুখ ফোলাফোলা, বাথরুমে গিয়ে বোধহয় কেঁদেছে অনেক। তবে কী আজ হাসনুর মায়ের কথা মনে পড়ছে? দীপা চলে গিয়েছে তাও তো বছর চারেক হল। আর আজকের দিনে বা মাসেও সে তাদের ছেড়ে চলে যায়নি, স্মৃতিকথা তো দিনক্ষণ দেখেই তো বেশি ভিড় করে আসে মনে! তবে?

সুশোভনবাবু জিগ্গেস করলেন - " হ্যাঁ রে মা কিছু খেয়েছিস? পান্না তো তোর জন্য আজ গাজরের হালুয়া আর পরোটা করে আলাদা করে ঢেকে রেখে গিয়েছিল। আর বলল-" দাদাবাবু হাসনু এলে বলো, আজ গাজরের হালুয়া আর পরোটা আছে। আমি টেবিলে দুটোই আলাদা করে সাজিয়ে ঢেকে রাখলাম। মেয়েটা কী যে ভালোবাসে খেতে, অনেকদিন পর বানালাম। দিদিমণি মনে রাখত এইসব, আর আমাকে দিয়ে ঠিক মনে করিয়ে দিয়ে বানিয়ে রাখতে বলত। দিদিমণি তো আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল এই রান্নাগুলো। আজ বেড়ে নিতে হবে না। এইখানে রাখলাম। " 

সুশোভনবাবুর সে সময় পান্নার কথায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। সত্যি তো কেউ কারও জায়গা পুরোপুরি আলাদা করে একশ শতাংশ নিতে পারেন না। মা যেমন মায়ের মতন, বাবাও তেমনি বাবার মতন।  হাসনুর কথায় এই মুহূর্তে চমক ভাঙল সুশোভনের। বলল- " বাবা আজ এত খেয়ে এসেছি, যে এখন আমার খিদে একদম নেই। রাতে আমরা একসাথে পান্নামাসির গাজরের হালুয়া আর পরোটা খাব। " সুশোভনবাবু এবারে বললেন-" মা তুই কী কোন দুঃখ বা চাপাকষ্টে ভুগছিস আজকে? " সুশোভনবাবুর কথাতে, প্রথমে ঘাড় নিচু করেছিল বসন্তসেনা কিছুক্ষণ, তারপর ঘাড় তুলে মাথা নেড়ে বলল- " হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক আমাকে আজ পড়তে পেড়েছ। এই জন্য আমার বাবা সবার সেরা! আমি বলব বা বলতামও সব তোমায়। সে তুমি জিজ্ঞাসা না করলেও।" সুশোভনবাবু বললেন-" কিছু একটা মুখে দিয়ে আয় আর বলতে শুরু করো হাসনু-মা। আমার কিন্তু অগাধ কৌতূহল হচ্ছে। হয়ত নিজের কন্যা বলেই।" 
🍂

ঠিক আছে বাবা, বলে সুশোভনের ঘর থেকে বাইরে গেল বসন্তসেনা। একটা ওয়াফি স্টিকের কৌটো পাশের ঘর থেকে নিয়ে এল, আর সঙ্গে পটাটো চিপসের প্যাকেট। সুশোভনবাবু এসব জানে, তার মেয়ের পছন্দ আর অপছন্দগুলো। অনলাইন মার্কেটিং এ এইসব বাড়িতে মেয়ের জন্য নিয়ে এসে রাখে। মেয়ে নিজেও খাচ্ছে আর বাবাকেও এগিয়ে দিচ্ছে, সুশোভন পারতপক্ষে এইসব খাবার খুব একটা যে পছন্দ করেন তা নয়, তবে মেয়েকে সঙ্গ দিচ্ছেন এখন। বসন্তসেনা বলতে শুরু করল - " অঙ্কুশের সাথে এবারে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটবে বাবা। "

- " কেন?" 

- " না অন্য কিছু নয়, বাঙ্গালুরুতে এক নামিদামী সংস্থায় বিরাট প্যাকেজে জয়েন্ট করতে চলেছে সে। আজ এই খবরটি পেয়েছে অঙ্কুশ। "

- " এ তো খুব- খুব ভালো খবর! আনন্দের খবর। তোর বোকাসোকা বন্ধুটির কী বিরাট হিল্লে হল বল? বোকা কিন্তু তুই বলতি, আমি কিন্তু কখনও বলিনি। তা বিরাট ট্রিট দেবে অঙ্কুশ। ওই তোরা এখন কথায়- কথায় বলিস না। তোদের মতন করেই বললাম।" 

বসন্তসেনা মুখ গোমড়া করে বলল-" বাবা! তুমি এই সারবস্তু বুঝলে আমার কথা থেকে। ওকে আমি কত মিস করব বলতো? ও তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। "

সুশোভনবাবু বললেন-" শুধুই ফ্রেন্ড ? নাকি আরও গভীর কিছু? একজন শুধুই বন্ধুর সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটলে  এমন গভীর ছায়াপাত করে মনে? " 

বসন্তসেনা একেবারে উচ্ছাসে ভেসে গিয়ে বলল-" হ্যাঁ। একদম ঠিক বলেছ বাবা। এই না হলে তুমি আমার বাবা! বলেছিলাম না, ক্যাবলা, মফস্বলের ছোঁয়া, অথচ ভীষণ আলাদা প্রকৃতির এক ছেলে, এত গভীরতা, এত সৃষ্টিশীলতা, এত বিচার ক্ষমতা সচরাচর সবার মধ্যে দেখা যায় না। অঙ্কুশ আলাদা। ওকে আমি ভালবাসি। একজন ছেলে এবং  মেয়ের গভীর বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত লভ বা ভালোবাসায় গিয়েই ঠেকে। এত ভালো খবর দিয়েও বলেই ফেলল আমাকে,  'তোকে তো এই কোম্পানিতে আমি এপ্লাই করতে বলেছিলাম, বললি বাবাকে ফেলে আমি কলকাতা ছেড়ে নড়ব না। একদিকে ভালই হয়েছে, তোর মতন ক্যান্ডিডেট পেলে আমায় ওরা এপয়েন্টমেন্ট দিতই না! আর আমিও এখানে এই স্যালারিতে থাকতে চাইছিলাম না। ' আমি শুনে রেগে গিয়ে বললাম, ও তোর ওই স্যালারি বড় হল আমার থেকে? যা ভাগ আমার কাছ থেকে, তুইও আর সবার মতন একই, তাই দেখছি!"তারপর মান- অভিমান, আড্ডা, হাসাহাসি , আমাদের ক্লোজড সার্কেলের মধ্যে। বাড়ি ফেরার পথে শুধু সারা রাস্তায় অঙ্কুশের কথা ভেবেই গেলাম। ভীষণ মন খারাপ করতে লাগলো। "

সুশোভন এবার বললেন-"  তা অঙ্কুশ কবে যাচ্ছে যোগদান করতে তার নতুন কোম্পানিতে?"

বসন্তসেনা বললেন- " নেক্সট মাসে। "

 - " তাহলে আমি তোর অন্তরঙ্গ সহকর্মীদের সাথে একদিন আড্ডা মারব। আমাদের ঘরেই। ওই যাকে বলে পার্টি দেব। তুই রাজি তো?"

- " দারুণ মজা হবে। আমি কালকেই ওদের সবার কাছে সময় চেয়ে নেব, এবং এক ছুটির দিনে আমাদের বাড়িতে আসতে বলব। আমি তোমায় একদিন  বলেছিলাম না বাবা, হয়ত সবাই চিরদিন এই কোম্পানিতে থাকব না, তবে অঙ্কুশ আর ঋষিতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে ভীষণ কষ্ট পাব মনে। আমাদের মনের অনেক বলা কথাই ভবিষ্যতে কেমন মিলে যায়, তাই না বাবা? "

- " একদম ঠিক বলেছিস। তবে এটাও তো ঠিক, অঙ্কুশের বাবা- মা ওকে অনেক টাকা- পয়সা খরচ করে পড়িয়েছে। সবাই তো ভবিষত্যের বড় পথে এগিয়ে যাবেই। তুইও কিন্তু আমার কথা ভেবে কখনও নিজের ভবিষ্যতকে নষ্ট করবি না। এ বলে দিচ্ছি। মানুষ আদতে একাই বাঁচে, মানুষ আদতে নিজেকে শূন্য করে দিয়ে চলে যায়। তবে বৃথা কেন ভয় পাচ্ছিস।"

বসন্তসেনা বলে- " কী আজেবাজে কথা বলছ বাবা?"

- " না রে আমি একদম সত্যি বাস্তব কথাটাই বলছি। শোন হাসনু- মা, একজন নারী পুরুষের এই যে অপেক্ষা, তা বিপরীত মেরুর আকর্ষণ থেকে। সাময়িক বিচ্ছেদ হলেও, সেই অমোঘ আকর্ষণে দু-জনা দুজনার অপেক্ষায় থাকে। যেভাবে সুসীমা আর অনুরও ছিল। তোকে আবার একদিন সুসীমার সেই ইতিহাসের পাতায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম। "

- "আচ্ছা বাবা, তাই হবে। তোমার সুসীমা আমার জীবনের পলে- পলে থেকে যায় সবসময়। এই নারী চরিত্রটিকে নিয়ে আর কাউকে এত উৎসাহ নিয়ে বলতে শুনিনি। তোমার সাথে সব শেয়ার করে আমি একদম হালকা হয়ে গিয়েছি বাবা। ভিতরে একটা জমাট বাঁধা কষ্টের পাথরে মনটা চাপা পড়ে ছিল এতক্ষণ। চলো এবারে আমরা ডিনার করতে যাই।"

সুসীমার মতন বিচ্ছেদে, তাদের এই ভালোবাসার দৈর্ঘ্য আরও বাড়িয়ে দেবে না তো? বিচ্ছেদ ভালোবাসার থেকে দূরত্ব বাড়ায় না, বিচ্ছেদ ভালোবাসার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়। ভালোবাসার একক কী?"

এ প্রশ্ন বসন্তসেনা নিজে , নিজেকেই করল। 

ক্রমশ


Post a Comment

0 Comments