জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২১/সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —২১

সুমিত্রা  ঘোষ

সারা বাংলাদেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল রানির অসংখ্য তালুক। অবিভক্ত বাংলার রানির কোনো তালুকে অশান্তি দেখা দিলে বা প্রজারা অত্যাচারিত হলে রানি তৎক্ষণাৎ বিশ্বাসী লোক মারফৎ খোঁজ খবর নিতেন। তিনি ছিলেন প্রজাদের জননী। সে প্রজা যে তালুকেরই হোক না কেন তিনি প্রজাদের স্বার্থে তখনকার দিনে এক লক্ষ টাকা খরচ করে 'টোনার থাল' খনন করিয়েছিলেন। রানি ভবানীপুর ও আরও কয়েকটি স্থানে বাজার স্থাপন করলেন তীর্থস্থান কালীঘাটে ঘাট নির্মাণ করিয়ে তিনি প্রভূত যশের অধিকারিণী হলেন।
রানি রাসমণিকে স্মরণ করতে গেলে অনেকের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ মহামনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম করতেই হয়। যদিও বয়সের দিক থেকে রানি রাসমণি এবং বিদ্যাসাগরের মধ্যে  অনেকটাই তফাত  ছিল। রানির জন্ম ১৭৯৩ সালের ১১ই আশ্বিন (বাংলা ১২০০ সাল) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর। প্রায় ২৭ বছর বয়সের তফাৎ ছিল এই দুজন বাংলার কৃতি সন্তানের মধ্যে। বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজচন্দ্র দাসের আমল থেকে জানবাজারের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। রানি রাসমণিকে পিসিমা বলে ডাকতেন। রানি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অধিক স্নেহ করতেন, সমাজ সংস্কারের কাজে উভয়ে এগিয়ে ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতি পদক্ষেপে প্রতিকূল পরিবেশে নারীজাতির জন্য লড়াই করেছেন, সর্বদা তখনকার দিনে সমাজের মাথাস্বরূপ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অত্যাচার সহ্য করে দেশের দশের সেবা করেছেন। বিপরীত মেরুতে রানি অন্তঃপুরে বসে সমাজে অত্যাচারিত-অবহেলিত-অভুক্ত নারী-পুরুষদের সাহায্য করেছেন। অত্যাচারিত মেয়েদের জানবাজারের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। এজন্য তাঁকে পরিবারের লোকদের কাছ থেকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
🍂
 প্রীতরাম দাসের পিসিমা বিন্দুবালা দাসী এবং পিসেমশাই-এর নাম অক্ররচন্দ্র মান্না, অক্রুরচন্দ্রের ভাই যুগলকিশোরের মেয়ে মায়ার সঙ্গে প্রীতরাম দাসের বিবাহ হয়। মায়ার মা-বাবা প্রীতরাম দাসের বাড়িতেই থাকতেন। সুতরাং জানবাজারের রানি রাসমণির পরিবারের সদস্যসংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। রানি যখন অনাথ- আতুর বিধবা বা সধবা মেয়েদের এই জমিদার বাড়িতে আশ্রয় দিতেন তখন শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ি উভয়ে মিলে রানিকে বকাবকি করতেন। তবে শাশুড়ি মায়াদেবী তাঁর ছোট বৌমাকে সময়মত শাসন করলেও অত্যধিক স্নেহও করতেন। প্রীতরাম দাস রানিকে মা লক্ষ্মী বলে ডাকতেন। সর্বদা বলতেন ছোট বৌমা আমার পরিবারে লক্ষ্মী ও সংসারে প্রবেশ করাতে আমার কারবারে উন্নতি হয়েছে, সংসার উথলে উঠেছে। ছোট বৌমাকে সর্বদা আগলে রাখতেন যাতে পরিবারের কেউ ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করতে পারে। স্বামী রাজচন্দ্র দাসের সম্বন্ধে রানি বারবার বলতেন আমি ভগবানের মত স্বামী পেয়েছি। রানির ভাসুর হরচন্দ্র দাস অল্প বয়সে মারা যান। তখন তাঁর স্ত্রীর কোনও সন্তানাদি হয়নি। এই বড়-জা অতীব ভাল ছিলেন ছোট জা এবং ঠাকুরপো রাজচন্দ্রকে খুব স্নেহ করতেন। সর্বদা ওদের মঙ্গল কামনা করেছেন। রানিকে ছোট বোন এবং রাজচন্দ্রকে ভাই জ্ঞান করতেন। যদিও রাজচন্দ্র দাস বড়বৌদি অপেক্ষা বড় ছিলেন কিন্তু উভয়ের মধ্যে দিদি-ভাইয়ের সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। বড় বউকে সংসারের কেউ বুঝতে দেয়নি যে সে স্বামীহারা অনাথিনী।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা লিখে শেষ করা যায় না। নবজাগরণের এই প্রাণপুরুষ যখন দেখতেন রানি কোন অনাথ মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন বা প্রজাদের দিকে সাহায্যের বাড়িয়ে দিয়েছেন বা দুর্ভিক্ষ- মহামারীর সময় বিপদগ্রস্তদের রাজবাড়ি থেকে সাহায্য করা হচ্ছে তখন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আনন্দের সীমা থাকত না।
ক্রমশ
 

Post a Comment

0 Comments