জ্বলদর্চি

বিবস্বৎসপ্তমী/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯৫
বিবস্বৎসপ্তমী

ভাস্করব্রত পতি

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে সূর্যের পূজা আর অর্ঘ্য দিয়ে এই লৌকিক উৎসব পালন করেন সধবা মহিলারা। এটি পালন করলে যাবতীয় রোগজ্বালা, শোকসন্তপ্ত পরিবেশ এবং যাবতীয় বিপদের হাত থেকে রেহাই মেলে। আসলে মা লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হয়ে লৌকিকতা পালনকারীর বাড়িতে অচলা হয়ে রয়ে যান। সেই বাড়িতে থেকেই তাঁর দেখভাল করেন। যাবতীয় বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেন। 

বিবস্বান (স্বৎ) হলেন তেজোযুক্ত বা সূর্য। সূর্যের অপর নাম বিবস্বান। এঁর পিতা হলেন কাশ্যপ এবং মাতা অদিতি। এঁর পুত্র হলেন বৈবস্বৎ মনু। যিনি সূর্য্য বংশের আদিপুরুষ। আর সূর্য হলেন হিন্দুধর্মের প্রধান পাঁচ দেবতার মধ্যে একজন, যিনি পঞ্চায়তন পূজার সমতুল্য দেবতা হিসেবে বিবেচিত হন। স্মার্ত ঐতিহ্যে ব্রহ্মের সমতুল্য বলে পরিগণিত হন।
ত্বষ্টার কন্যা সংজ্ঞা সূর্য্যাতেজ সহ্য করতে না পারায় ত্বষ্টা সূৰ্য্যকে ১২ টি খণ্ডে ভাগ করেন। দ্বাদশ মাসে এই দ্বাদশ আদিত্যের উদয় হয় (শব্দকল্পদ্রুম)। মাঘে অরুণ, ফাল্গুনে সূর্য্য, চৈত্রে বেদজ্ঞ, বৈশাখে তপন, জ্যৈষ্ঠে ইন্দ্ৰ, আষাঢ়ে রবি, শ্রাবণে গভস্তি, ভাদ্রে যম, আশ্বিনে হিরণ্যরেতাঃ, কার্তিকে দিবাকর, অগ্রহায়ণে চিত্র (মিত্র?) এবং পৌষে বিষ্ণু। হরিবংশমতে দ্বাদশ নাম — ধাতা, অর্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান্, ইন্দ্ৰ, পূষা, পর্জ্জন্য, ত্বষ্টা এবং বিষ্ণু। 

তবে সুধীর চন্দ্র সরকার সংকলিত 'পৌরাণিক অভিধান' অনুসারে বিবস্বান্ সম্পর্কে লেখা হয়েছে, "রামায়ণ ও পুরাণ অনুসারে দক্ষরাজের অন্যতমা কন্যা অদিতি হতে কশ্যপের ঔরসে অর্যমা, পূষা, বিবস্বান প্রভৃতি দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়। এঁর স্ত্রীর নাম সংজ্ঞা। সংজ্ঞার গর্ভে বিব স্বানের তিনটি পুত্র সন্তান হয় — বৈবস্বত মনু, শ্রাদ্ধদেব ও যম, এবং যমুনা নামে যমের এক যমজ ভগ্নী। সংজ্ঞা সূর্যের প্রখর তেজ সহ্য করতে না পেরে ছায়াকে সৃষ্টি করেন এবং ছায়ার উপর তাঁর পুত্র কন্যাদের পালন করবার ভার দিয়ে অনত্র চলে যান এবং অশ্বীরূপ ধারণ করে বনে ভ্রমণ করতে থাকেন। তখন বিবস্বান অশ্বরূপ ধারণ করে তাঁর সঙ্গে সহবাসে রত হন। এর ফলে অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের জন্ম হয়। এরপর বিবস্বান সংজ্ঞাকে নিজের গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সংজ্ঞার পিতা বিশ্বকর্মা তখন বিবস্বানের তেজ হ্রাস করবার তাঁকে শানযন্ত্রে, কর্তন করে তার অষ্টম অংশ পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেন। এই অংশ জলন্ত অবস্থায় পৃথিবীর উপর পতিত হয়। তখন বিশ্বকর্মা এই থেকে বিষ্ণুর চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, কার্তিকেয়ের শক্তি এবং অন্যান্য দেবতাদের অন্যান্য অস্ত্র প্রস্তুত করেন। মহাভারতের বর্ণনানুসারে কুন্তীর গর্ভে কর্ণ বিবস্বানের ক্ষেত্রজ পুত্র। বিবস্বানের বৈবস্বত মনু হতে ইক্ষ্বাকুর জন্ম হয়। এই জন্য ইক্ষ্বাকুবংশ সূর্যবংশ নামে খ্যাত। অশ্বরূপে বিবস্বান শুক্ল যজুর্বেদ যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রদান করেন। বিবস্বানই সত্রাজিৎকে স্যমন্তক মণি দান করেন। এঁর রথ সপ্ত অশ্বদ্বারা বা সপ্ত মস্তক বিশিষ্ট অশ্বদ্বারা সূর্যরশ্মিমণ্ডিত হয়ে চালিত হয়। কথিত আছে, ইনি শনি ও সুগ্রীবের পিতা"। 

জবা অথবা অন্য যেকোনো লাল ফুল, দূর্বা, চন্দন, আতপচাল ফল ও মিষ্টান্ন লাগে এই লৌকিক উৎসব পালনের উপচারে। এটি পালন করতে হলে পালনের দিন সকালে স্নান করে খোলা বা এলোচুলে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে ও কপালে সিঁদুরের টিপ পরে তিনবার হাতযোড় করে সূর্যকে অর্ঘ্য দিয়ে প্রণাম মন্ত্র পড়ে প্রণাম করতে হয়। এই বিবস্বৎসপ্তমীর সৃষ্টির যে কাহিনী পাওয়া যায় তা এরকম ---

কোনো এক দেশে একজন খুব গরিব ব্রাহ্মণ ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন। ব্রাহ্মণ সারাদিন ভিক্ষে করে যা পেত তাই নিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতেন। তাঁরা তাই রান্না করে রাত্রে খেতো এবং সকালের জন্যে কিছু পান্তা ভাত রেখে দিতো। পাস্তা খেয়ে সকালে ব্রাহ্মণ আবার ভিক্ষেয় বেরোতেন। ব্রাহ্মণী সব সময় চোখের জল ফেলতো আর ভগবানকে ডেকে ডেকে বলতো, “ভগবান! আমাদের দুঃখ কি আর ঘুচবে না”? 

পবন কুমার নামে সেই দেশের রাজার একটি ছেলে ছিল। সে কুষ্ঠ রোগে ভুগছিল। এই কারণে রাজার মন বিচলিত ছিল। মনে কোনো শান্তি ছিল না। নানান দেশের নানান রকম চিকিৎসককে দিয়ে রাজা ছেলের চিকিৎসা করালেন, কিন্তু কেউ পবনকুমারকে সারিয়ে দিতে পারলো না। পবনকুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মন্ত্রীর মেয়ে কনকমালার। স্বামীর এই রোগ কেউ সারাতে পারলো না দেখে কনকমালার মন খুব খারাপ। কনকমালা সব সময় খুব কান্নাকাটি করতেন। রাজপুরীর ভেতরে একটা বাগানে সূর্য মন্দির ছিল, কনকমালা রোজই সেখানে গিয়ে পূজো দিতেন। একদিন সকালে উপোস করে স্নান করার পর সে সূর্যমন্দিরে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে খুব কাতর ভাবে সূর্যদেবকে ডাকতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে কনকমালা সেই মন্দিরের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে একটা বিচিত্র স্বপ্নে দেখতে পেলেন যে, লাল কাপড় পরা একজন জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁর সামনে এসে বলছেন, “আমি স্বয়ং সূর্যদেব! তুই আমাকে খুব কাতর হয়ে ডাকছিস। তাই আমি তোর কাছে চলে এলাম। তোর মনে কী আছে আমি জানি। তাই আমি যা বলছি মন দিয়ে সেই মত কাজ কর। তাহলেই তোর স্বামীর কুষ্ঠ রোগ সেরে যাবে। 
কয়েক জনম আগে তোর স্বামী এক ব্রাহ্মণের চাকর ছিল। কিন্তু সে ছিল খুব রাগী। একদিন সামান্য কথা কাটাকাটির পর সে ব্রাহ্মণকে একটা লাথি মেরেছিল। সেই ব্রাহ্মণ আমাকে খুব ভক্তি করতো। সে আমার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলল, 'সূর্যদেব, একে সাত জন্মের কুষ্ঠ রোগ দাও। তারপর থেকে ছ’জন্ম পর পর তোর স্বামী কুষ্ঠ রোগে ভুগছে। তুই আমার কথা মতো কাজ কর, তাহলেই তোর স্বামীর রোগ সেরে যাবে”। 
কনকমালা বললেন, “বলুন প্রভু, আমাকে কী করতে হবে”? 
সূর্যদেব তখন বললেন, “রাজপুরীর দক্ষিণ দিকে প্রায় চার ক্রোশ দূরে একটা ভাঙা কুঁড়ে ঘরে খুব গরীব এক ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী বাস করে। সেই ব্রাহ্মণকে দিয়ে আমার পূজো ও অর্ঘ্য দান করিয়ে তোকে তাঁদের চরণামৃত খেতে হবে এবং তাঁদের অনেক ধনদৌলত দিতে হবে”। এই স্বপ্ন শেষ হতেই কনকমালার ঘুম থেঙে গেলো। তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি রাজপুরীতে ফিরে এসে সব কথা রাজা ও রাণীকে জানালো। এর পরই আর দেরি না করে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীকে রাজবাড়িতে আনানো হলো। পবনকুমার ও কনকমালা তাঁদের পা ধোয়া জল খেয়ে তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি, পরে সূর্যদেবের দয়ায় তাঁরা সবই জানতে পারলেন। সূর্যদেবের দয়াতে পবনকুমারের কুষ্ঠ রোগ সেরে গেলো। রাজা ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীকে অনেক ধন দৌলত দিলেন। পবনকুমারের রোগ সারার জন্যে রাজধানীতে ফের শুরু হল আনন্দোৎসব। তারপর একদিন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সূর্যমন্দিরে পবনকুমার ও কনকমালা সেই ব্রাহ্মণকে নিয়ে বিবস্বানের পূজা বিবস্বৎসপ্তমীর ব্রত উদযাপন করল।
🍂

Post a Comment

0 Comments