জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( একত্রিংশতি পর্ব )/ শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( একত্রিংশতি পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা


মাঝে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। খগেন মাস্টার অনেক সময় চিনতে পারেনা নিজের গ্রামকে। ভীষণ অচেনা ঠেকে পাড়া-বাখুল। কত  অচেনা লাগে মানুষজন। অথচ সে তো গ্রাম ছেড়ে এক মুহুর্ত যায়নি কোথাও। শৈশব কেটেছে তার গ্রামের ধূলোকাদা মেখে। কৈশোর কেটেছে খালবিল,পুকুরডোবা আর শিলাইয়ের জলে ঝাঁপাই ঝুড়ে, ডাঙির বনে বেতকুল আর মাদার পেড়ে। ছাবাতলার বন থেকে কুড়ুক জাম এনে জামপটকা ফাটিয়ে। খাঁদিরখালের আসুদ গাছের কোটর থেকে টিয়াপাখির বাচ্চা চুরি করে। যৌবন কেটেছে তার গ্রাম্য মানুষগুলোর সাথে। পড়াশুনা আর চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপের বাইরে সারাক্ষণ গ্রামের নোনা ঘামে জবজব করা মানুষদের গাঁ ঘেঁষে থাকতে পছন্দ করেছে সে। তাদের সারল্য তাকে আবেগমথিত করেছে। তাদের কর্মোদ্যম তাকে অভিভূত করেছে। তাদের আনাড়িপনা তাকে বিরক্ত করেছে। তাদের লোভ, বিদ্বেষ, কুঁদুলেপনায় রেগেছে সে। তাদের দারিদ্র্যের কষ্টে অঝোরে কেঁদেছে। সামান্য একজন স্কুলমাস্টার সে। কতটুকু তার ক্ষমতা। সংসার তার নেই। কিন্তু নিজের বউ-বাচ্চা না থাকলেও,মা-বাবা,ভাই-বোনের থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি কখনো। শুধু নিজের এই চৌখুপি বৃত্তের বাইরে সবাইকে সে তো আপন ভেবে এসেছে এতদিন। সেই ভাবনা তার আজও অব্যাহত। সংসার না থেকেও তার বৃহত্তর সংসার।অথচ আজ সেই মাস্টারের কাছে ঢোলের ভিতর - বাহির সব যেন অচেনা লাগে। জলের পাঁড় পরা,কাদায় লেপ্টে থাকা,আঁশটে গন্ধ লেগে থাকা ঢোলের লোকজন তার কত আপনজন ছিল। আজ যেন সেই আপনতার গায়ে অবিশ্বাসের আস্তরণ লাগতে শুরু করেছে। বড্ড বিরক্ত লাগছে তার চেনা মানুষজনদের। কখনো চরম অভিমানে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিতে চায়। তার সেই সরল সাধাসিধে ঢোল আর নেই। মনস্তাপ কোরে লোখার কাছে বলে,
— জানু,চোখের সামনে ক'বছরেই বদলে গেল গেরামটা। পাড়াগুলানে যতদিন মাটির ঘরবাড়ি  ছিল,লোকেদের মনটাও মাটির মতন নরম ছিল। রাস্তাঘাটে কাদা চটকাতে হত ঠিকই,তবু সেই রাস্তা সজা ছিল,কিন্তু এখন দেখিটি রাস্তা গুলান পচুর আঁকাবাঁকা! আর লোক গুলানও বাঁকা স্বভাবের হই গেছে। যত পাকার ঘরদর হয়ঠে,তত মনটাও ইঁঠের মত শক্ত হই যায়ঠে রে।
—-ইটাই ত জগতের নিয়ম মাস্টার। তমাকে আর কি বোলবো! সময়ের সঙে সবকিছু ত বদলাবেই। ভগী খুড়া অই জন্নে বলে,যখন যেমন তখন তেমন,যেদিন যেমন সেদিন তেরম। ইভাবে থাকবি, থাইলে কুনু কষ্ট হবে নি।
—-সেই রকমই থাকব ভাবিঠি ইবার থিকে। 
— তমার কথা আর বেড়ালের দু পাউড়ি যাওয়া, দুটাই সমান।
—- আসলে কি জানু বাপকে দেখেচি ত ছোটবেলায়। কারো কিছু হোল ত দে দৌড়। মা কিছু বোল্লেই তাকে দমে বাখান কোত্ত। বোলত, খচরাশালি! তুই মেইয়া জাত কিছু বুজু। জাতভাইয়ের আপদবিপদে যাবনি ত কার বেলায় যাব। 
—- আসলে তমাকে বাখান দিবার কেউ নাই ত, তাই তমার এই দশা।
খগেন মাস্টারের ঠোঁটের ডগায় হাসি ফুটে ওঠে। লোখার মুখের দিকে চেযে থাকে। ভাবে, এই যে বদলের কথা তার মনকে এত নাড়িয়ে দিচ্ছে সারাক্ষণ, সেই বদলের তালিকায়  সে সবাইকে ফেলতে পারবে না। লোখা তো সেই হাঁটুর বয়স থেকেই একই রয়ে গেছে। ভগী খুড়ার আগের চেয়ে বয়সের সংখ্যাটা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে কয়েক ধাপ। কিন্তু সেও তো একই রকম আছে। এখনো দেখা হলে কত কথা বলে। তার কথায় সবদিনের মতো আজও  সে স্নেহের স্পর্শ অনুভব করে। তাছাড়া গোটা দুনিয়া যখন বদলের নেশায় বুঁদ তখন তার গ্রাম মুখ ফিরিয়ে থাকবে কেন! তাহলে কিসের বদল তাকে এত ভাবায়। দুশ্চিন্তার জালে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে।
🍂
 লোখা আর খুদার বিবাদে তার সামনের ধোঁয়াশা ভাবটা কেটে যায। মাস্টার অনুভব করে, গ্রামের গড়া পচার রোগ শুরু হয়েছিল আগেই। তবে সেই রোগের বাড়ামুখে বাধ হয়ে দাঁড়ত গ্রাম্য অনুশাসন। সেই অনুশাসনের মধ্যে পুরোটাই নিরপেক্ষতা, আগাগোড়া যে স্বচ্ছতা ছিল তা জোর করে বলা যাবে না। কিন্তু কারো ভয়ানক অনিষ্টের কথা ভাবতে পারত না সালিসি সভা। আজ আর সেইসবের বালাই নেই। মানা - গোনার পাট কবেই চুকেবুকে গেছে। খগেন মাস্টারদের মত লোক আজকের ঢোলে বড্ড বেমানান। লোখা বলে,
— মেস্টার,সেসব দিনে ফুরি গেছে। জোত আলগা হয়ে গেছে জুয়াল থিকে। গরু এখন যেদিকে পারে ন্যাজ তুলে দৌড়াবে। তুমি আমি লেঙলের বঁটা ধরে দাঁড়ি থাকলে কিহবে? হালছড়ির আর কুনু কাজ নাই। বেশি বাড়াবিস্তর কল্লে, তোমাকে ঘুরে হালছড়ি পেটা কদ্দিবে।

মন্দির তৈরি নিয়ে দু-ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ। খুদা বাদে লোখার আর দাদা ভাইরা তো গ্রামেই থাকে না। গুনীনের ঘরে একটা মনসা মন্দির না থাকলে মান থাকে কোথায়! কিন্তু মনসা মন্দির করতে যেতেই খুদার সঙ্গে লোখার তুমুল কথা কাটাকাটি হয়। খুদার বউ সাগরী চুপ করে থাকার পাত্রী নয়। তার মুখের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। লোখার বউ কিছুটা নরম স্বভাবের হলেও তার গায়েও তো কুঁদুলা বাগদির রক্ত বইছে। সেও মুখ বুজে থাকবে কেন। তাবাদে স্বামীর পক্ষে দাঁড়িয়ে একটু যদি ঝগড়াঝাঁটি করতে নাই পারে,তাহলে ঢোলের বউড়ি হওয়া তার সাজে না। এর পরে আরো একটা কথা থেকে যায়,যা পুবে- পশ্চিমে সূর্যের ওঠা আর ডুবার মতো সত্য। সব বাগদি পাড়ায় গন্ডগোলের সূত্রপাত হয় একটুকরা আগুনের ফুলকির মতো হযে। অনায়াসেই যা এক চেটো জলে নিভে যেতে পারে। সেই আগুনের সামনে দাহ্য বস্তু হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে দুটো পুরুষ মানুষ। কিন্তু পুরুষরূপী দাহ্য বস্তুর উপর ততোধিক তরল দাহ্য ঢেলে দেয় দুই পুরুষের দুই সহধর্মিণী। পুরুষ দিয়ে যে গন্ডগোলের নিরীহ সূত্রপাত,তার সমাপ্তি ঘটে বউরূপী দুই কিংবা ততোধিক ঝগড়ুটে প্রাণীর বাকযুদ্ধের দাবানলের মধ্য দিয়ে। লোখা আর খুদার তর্কাতর্কির আঁচে বাতাস দ্যায় দুজনের বউয়েরা। শেষ অব্দি তার পরিণতি গড়ায় সালিশের আসনে। খগেন মাস্টার কিছুতেই যেতে চাইছিল না ওই মিটিংয়ে।  অথচ লোখার কথা তার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
খগেন মাস্টার জানে তাদের ঢোল এখন নিয়ন্ত্রণ হয় রাজনীতি দিয়ে। আগেও ছিল রাজনৈতিক প্যাঁচ- পয়জার।  কিন্তু তার পরেও আটচালার সালিসি সভায় সবকিছুর উর্ধ্বে শেষ কথা বলত গ্রাম্য সমবেত কন্ঠস্বর। সেই দৃঢ় বন্ধন ক্রমে আলগা হতে হতে গিঁট খুলে গেছে। ডান্ডা আর ঝান্ডার জোর গ্রামীণ ব্যবস্থাকে ভেঙে টুকরোটুকরো করে দিয়েছে।  পাড়ায় পাড়ায বিবাদ। বাখুলে বাবাখুলে শত্রুতা। ভাই ভাইয়ের ছায়া ধরে লাথি মারে। পাঁড়া- গাঁ'র সহজসরল সৌন্দর্যে ডান্ডা- ঝান্ডার অমোচনীয় কালো রঙ চেপে বসেছে। রাজনীতি মুখে বলেছে অভাব দূরীকরণের কথা। মঞ্চে চোখ ভিজিয়ে নেতা বলেছে দুঃখী মানুষগুলোর ভাতের থালার দৈন্যতার কথা। আড়ালে চেয়েছে গরীব চিরকাল গরীব থাকুক। নইলে দলীয় রাজনীতির ঝান্ডা বইবে কারা! সাধারণকে গৃহপালিত পোষ্যের মতো করে রাখতে চেয়েছে তারা। রাজনীতির খাতায় সাধারণের পরিচয় একজন ভোটার ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের অভাবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থপূরণের হাতিয়ার করে রাখাই তাদের সবদিনের গোপন অভিসন্ধী। সালিশে বসার আগে তাই পার্টি অফিসে চলে হিসেবনিকেশ। সেই হিসাবের খাতায় ন্যায়-অন্যায়ের কোন বালাই থাকে না। কার পক্ষে বেশি ভোটার। কাকে হাতে রাখলে পার্টির ফায়দা। মিটিংয়ের গতি তখন সেই অভিমুখেই চালিত হবে। এর জন্য বিভিন্ন অস্ত্রের প্রয়োগে নেতারা সিদ্ধ হস্ত। নাটকের কুশীলবরা আগে থেকেই মহড়া সেরে আসে। আর থাকে দু'চারজন গলাবাজি করার লোক। দলের প্রতি তাদের আনুগত্য তুলনারহিত। এইসব দু'পেয়ে প্রাণীর আজকের রাজনীতিতে সহজদৃশ্যমান। ঢোলে তাদের সংখ্যা একটু বেশি। তারা অতি সামান্য অর্থেই নিজেদের বিকিয়ে দিতে পারে। এক দু'গ্লাস দেশী চুল্লুর কাছে মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিতে তারা দ্বিধা বোধ করে না। আর এদের মতো লোকজনদের ডাইনে বাঁয়ে নিয়ে গোটা গ্রামের উপর গা-জোয়ারি  করে বেড়ায় ঝন্টু কটাল। সে ঢোলের ব্ড় নেতা। তারপরে মেজ,সেজো আছে। বাখুলে বাখুলে চারা নেতা আছে একটা করে। ঝন্টুর গাযে পেটাজোঁকের মতো চিপটে থাকে বিফল বড়দোলই। সে  পাড়ার হোমরাচোমরা।  গায়ের আর গলার দুটোর জোরই তার বেশি। তবে এদের মাথা চিবিয়ে খাওয়ার পান্ডা হল ভবতারণ মন্ডল আর সুধাকর ঘোষ। ভবতারণ লাল পার্টির লোক। সুধাকর সবুজ পার্টির। গ্রামে হালফিলে আরো একটা পার্টির বাড়বাড়ন্ত হযেছে। নিধিরাম সেই গেরুয়া পার্টির নেতা। তবে এখনো গ্রামে  নিধিরামের পার্টি সেভাবে জাঁকিযে বসতে পারেনি। নিধিরামের ঘর ঢোলের মিদ্যা পাড়ার। সোনার কাজে বোম্বে ছিল বেশ ক'বছর। এখন গ্রামেই থাকে। কিন্তু ভব মন্ডল আর সুধা ঘোষের ঘর পূর্বে। রাতদিন তবে পড়ে থাকে ঢোলের এপাড়ায় ওপাড়ায়। ঝন্টুরা এদের কথায নাচানাচি করে। ঝন্টু মনে করে সুধা ঘোষের কথা বেদবাক্য। সে যাকে ধরে আনতে বলে,ঝন্টু বিফলদের পাঠিয়ে তাকে বেঁধে আনে। ভবতারণের দলে আগে ঢোলের সবাই ছিল। তারপর যেই তারা হেরে গেল,অম্নি পাল্টি খেযে যায় ভবতারণের সাগরেদ চিত্ত কালসার। শুধু তারাপদ এখনো ভবতারণের সঙ্গ ছাড়েনি। ভবতারণ একমাত্র তাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে পার্টির প্রচার করে। অথচ আগে চিত্ত কালসারের দবদবানিতে চুপ মেরে থাকত ঢোল। তার পক্ষে তখন তিনভাগ ঢোল আড় হয়ে পড়ত। লোখা  কোন নেতার ধার ধারে না।  চিত্ত কালসার অনেকবার ডেকেও লোখাকে মিছিলে হাঁটাতে পারেনি। মন চাইলে ভোট দিতে যায়,না চাইলে যায় না। লোখার কপালে তাই লবডঙ্কা। কোনরকম সুযোগসুবিধা লোখার ভাগ্যে জোটে না। উপরন্তু তাকে হুট করতে শাসানি শুনতে হয়। চিত্ত কালসার তাকে কতবার শাসিয়েছে,
—কিরে লোখা,তুই কালকে মিছিলে গেলুনি যে? খুব বাড় বেড়ে গেছে তোর! পাটির ছেনাদের লেলি দিলে, তোর পাঁইতারা কাটি দিবে,জানু ত!
—  বাড়ের সঙে কি আছে?তমাদের মিছিলে গেলে কি মোর পেট চলে যাবে!  মোর বউ- ছেনাকে পাটি ত আর খাবাবেনি। মোকেই খেটেলুটে খাবাতে ত হবে।
—- খুম যে চেটাং চেটাং কথা বোলুঠু রে! তোর নামে আগেও অনেক কথা শুনেচি। শুনিঠি নাকি, ঝন্টাদের সঙে গুজগুজ ফুসফুস কোরু, মাচায়।
— কেনে? কথা বলা কি বারণ আছে? গেরামে সবাই সবার সঙে কথা বোলবে। উ তমাদের পাটি করেনি বলে, অর সঙে কথা বলা যাবে নি! ই কি বাবলাফুরা বিচার জুড়েচ!
— খুম আইনবাজ হোয়ে গেছু নাকি রে! বেশি কেরতানি মারাতে যাওসুনু। পাটি অপিসে যখন ছেনারা তুলে ৰি যাবে, তখন মোর কিছু করার থাকবেনি।
— তাই না কি! থাইলে একবার তুলেই লি যাও দেখি এগবার। কত তেজান হইচে দেখব! আর তুমি এগবারে কত বোড়ো নেতা হই গেছ, সেটাও দেখব!
—- দেকবি? দেখবি কি কোরব তোর? পুরা পরকাল ঝরঝরা কোদ্দুব তো! হাতে ত তোকে মারবোনি তোকে মারব পাতে।
— কেনে! তোমার কি ধেরে বসে আছি? না তুমি মোকে খাবাও?
— কেনে তুই মোদের পাটির কাছ থিকে কিছু লিউ নি। ফিরির রেশন লিচ্চু! বন্নার সময রিলিপ লিচ্চু। ঘর পড়ার টাকা লিচ্চু! তার কুনু মূল্য নাই! তোদের মত নেমখারামির জন্নে পাটিটার মোদের এই দশা হচ্চে।
—- কুন শালা বলে মোকে টাকা দিইচে? উ বছর বন্যাটার সময় একটা তিরপল চেইছিলম,মুখের উবরে বলে দিইল,তোকে ত কুনুদিন মোদের মিটিং মিছিলে ত এসতে দেখিনি। আর কন্টেলের চাল কেরাসিনে সবার অধিকার আছে।
— ভাষা ঠিক করে কথা বোলবি লোখা! তোর বাড়বিত্তি দেখিঠি তখন থিকে। থাইলে বল,পাউনি বোলেই অত তোর গায়ের জ্বালা!
—- ভাষা মোর ঠিকই আছে। তমরাও, বেবহারটা তোমাদের ঠিক কর। তাবাদে না পেলে সবারই গায়ের ডাহন হয়। তোমরা কি বিনা সাথ্যে পাটিয়ে ঘুরঠ?

ঘটনাটা অনেকদিন আগেকার। তখন ঢোলে লাল পাটির শাসন চলছে। চিত্ত কালসার বাজার বেরালেই একটা লাল রঙের টুপি মাথায দিয়ে বেরাত। কাঁধে একটা লাল রঙের ঝোলা ব্যাগ থাকত। পাতলুন - পাঞ্জাবি পরে হাতে একটা ঘড়ি ঝুলিয়ে সারাদিন দাসপুর ঘাটাল ছুটে বেড়াত। আর যেই ভব মন্ডল খবর দিল অম্নি লোকজন জুটিয়ে ছুটল মিছিলে। রাতে বসত পার্টি অফিসে। ওই ঘটনার কদিন পরে লোখাকে বাজারে ভব মন্ডল ঘিরে ধরে। মিহি গলার স্বরে বলে,
— খুব তাড়া আছে নাকিরে লখি?
— কেনে বল দিখি? 
— নাহ্,তোর সঙ্গে কিছু কথা ছিল আর কি।
— বল না,  কি বোলবে?
—আজকাল নাকি তুই মাথা গরম কোরে ফেলচু? গেরামে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে তবেই ত ভাল।
— কেনে!  কার সঙ্গে মোর বিবাত হইচে,তুমি শুনেচ?
—- অই চিত্ত বোলছিল তুই নাকি তাকে উচ্চবাচ্য করেচু? যক হোক সে মোদের পাটি মেম্বার।  তার উবরে এল সি এম। তার একটা ত সম্মান আছে নাকি!
— তার কথাটা শুনেচ যখন, মোর কথাটাও থাইলে একটু শুন। নাকি তমাদের পাটির মেম্বার বোলে তার কথাটাই বিশ্বাস কোরবে,মোরটা নয়!
— তাইলে ত তোকে জিগ্যাস কোত্তমনি।
— সে পাটি করে বোলে ত কারো মাথা কিনে লেয়নি! পাটি তমাকে আসাকে এিয়ে হয়। কুন্তু সে নেতা বলে যা খুশি বলে যাবে,হুক কথায় শাসাবে,পাটি অফিসে তুলে লি যাবার হুমকি দেখাবে সিটা কি মেনে লিবা যায়! তুমি বল থাইলে বিচার করে।
— কিন্তু শুনলম তুই তাকে পচলাপচলি কোরেচু। তাবাদে তোদের পাড়ার সবাই বলে তুই নাকি ঝন্টা কটালের মদতে এসব কোচ্চু যে!
— এই ত!  এতক্ষণ ঠিকই ছিল মন্ডল বাবু। ইবার ত মাথা গরম করি দাওঠ। আমি কুনু শালার কথায় চৰি নি। লোখা বাগদি নিজের কথায় চলে। সাদাকে সাদা বলে কালোকে কাল। গতর খাটি খায়। কারো ধার সে ধারবেনি।
— যাই হোক তোকে সাবধান করে দিলম। মোদের পাটির কমরেড সে। তার সঙ্গে ফারদার খারাব বেবহার কত্তে যাবিনি। তোর বাপ মোদের পাটি কোত্ত। তোর দাদারাও করে। সেইজন্য এবারে কোন একশান লিচ্ছি নি।
— নাইলে কি কোরবে? লোখা বাগদিকে বেশি চেনকি দিতে এস নি। তুমিই ত বাইর থিকে জিয়ে মোদের জাতের লোকদের লাচাও। মুখে বোলবে সর্বহারার পাটি করি। মোটামুজুরের জন্নে লড়ি। আর মাঠে তমার ভাইদের বেশি জমি। ঘরের সব ছেনাদের পড়তে পাঠি দিছ বাইরে। নিজের আর ভাইদের চাগরি করে লিচ। মোদের জাতের কার কি করে দিছ। শুধু মারপিট হেঙ্গাম কোত্তে লিয়ে যাও ত মোদের দিকে।
— মুখ সামলে কথা বল ৰোখা জুতিয়ে লাল করে দুব
— এই ত বেরাচ্চে তমার আসল রূপ। অই জন্নেই ত খগেন মাস্টার বলে। বলে ভব মন্ডলের কথা মিসরির ছুরি।
—- উটারও খবর আছে। তোকে ওই মাস্টারেও যে লাচায়,সে খবরও আছে। যেদিন ধোরব নি তোদের দুজনকে সেদিন বুজবি পাটির পিছনে লাগার পরিণাম কি।
— বেশি হাড়ের কায়দা দেখাতে যেওনি মাস্টারের কাছে। তাকে লোখা মাল পেয়ে যাওনি। তমার মতো নেতাকে চরি খায় সে। আর কুনু পাটিকে তার মত লোক তেলি চলে নি। 
— ঠিক আছে কি কোত্তে পারি তুই তেখে লিবি
সেইরাতেই লোখাকে পাটি অফিসে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। চিত্ত কালসারের দলবল। লোখা অবাক হয়ে যায়। আগে মাল পাড়ার লোককে গ্রামের লোক ভয় পেত। ঝাড় বাখুল বলে কেউ চট করে গন্ডহোল করতে সাহস পেত না। কিন্তু সেদিন দেখল তার মাল পাড়ার লোক কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রাত নটার সময় তাকে গামছা গলায় দিয়ে টানতে টানতে পাটি অফিসকে নিয়ে গেল তারই গ্রেমের জাতভাইরা। সকাল হলেই যাদের সাথে মুখ চাওয়া -চাওয়ি, শুধুমাত্র পার্টির কাছে ভাল সাজতে চেয়ে, দু'চার মুঠো ভিক্ষার দানের লোভে চোখের সামনে একটা ছেলেকে এভাবে মার খেতে দেখছে সবাই। কারো মুখে কোন উচ্চবাচ্য নাই। কোথায় গেল গ্রাম্য একতা! কোথায় গেল গেঁয়ো মানুষজনদের সাদাসিধা মনের আগুন প্রতিবাদ। রাজনীতির চালে,লোভের টোপে মানুষ যে এমন রঙ বদলাতে পারে,সেইদিন প্রথম লোখার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে আরো জোরাৰো করে অনুভব কোরলো রক্তের সম্পর্ক দিয়েই সব বাঁধন দৃঢ় হয় না। তার বাইরেও মানুষ আপন হয়,যে বিপড়ে আড় হয়ে পড়ে। তার বাল্যবন্ধু খগেন মাস্টার সেইরকম একজন,যে ওই রাতে চুপ থাকেনি,ঘরে বসে থাকেনি,একা রুখে দাঁড়ায় চিত্ত কালসার আর ভবতারণ মন্ডলের বিরুদ্ধে।

Post a Comment

0 Comments