জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৩/বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৩
বিজন সাহা 

নিঝনি নভগোরাদ 

আমাদের কাছে এই শহর গোর্কি শহর নামে বেশি পরিচিত ছিল। সোভিয়েত আমলে এ নামেই আমরা একে চিনতাম, বিশেষ করে বিদেশীরা। এখানেই এক সময় গৃহবন্দী ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী আন্দ্রেই সাখারভ। সেই সময় গোর্কি শহর ছিল বদ্ধ জনপদ, সেখানে বিশেষ করে বিদেশীদের প্রবেশ ছিল নিয়ন্ত্রিত। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সব জনপদই এমন ছিল। তবে বদ্ধ শহরে এমনকি সোভিয়েত জনগণের প্রবেশও কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত ছিল। এর মূল কারণ ছিল এসব শহরে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হত। কিন্তু আন্দ্রেই সাখারভকে এখানে রাখার ফলে গোর্কি শহর অনেক দুর্নাম কুড়ায়। এই শহরের ঐতিহাসিক নাম নিঝনি নভগোরাদ বা কথ্য ভাষায় শুধুই নিঝনি। ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এর নাম ছিল নভগোরাদ নিঝভস্কই জেমলি। সোভিয়েত শাসনামলে ১৯৩২ সালে ০৭ অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এই শহর গোর্কি নামে পরিচিত ছিল। ম্যাক্সিম গোর্কি নিজে এর বিরোধিতা করেন, কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্তের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। তিনি নিজে কোন দিন এই নতুন নাম ব্যবহার করেননি এবং নিজের আত্মীয়স্বজনকেও সেটা ব্যবহার করতে নিষেধ করেন।  

এক সময় ভোলগার উপরের দিকে মূলত বাস করত ফিন্নো-উগ্রিক জাতির লোকজন। আমরা অস্তাশকভ, কালিয়াজিন, উগলিচ ইত্যাদি জায়গায় ভ্রমণ কালে তাদের নিয়ে বলেছি। নবম শতাব্দীর শুরু থেকেই আপার ভোলগায় মানে ভোলগার উপরের দিকে স্লাভিয়ানরা উপনিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করে। একাদশ শতকের শেষ দিকে ওকা নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই রুশদের অধীনে চলে যায়। একটু ভাঁটিতে বাস করত ভোলগার বুলগার জাতি। তাদের সম্পর্কে আমরা বলব সময় এলে। সুরি নদীর মোহনা পর্যন্ত ভোলগার দক্ষিণ তীর ছিল এরজিয়ানদের দখলে। এরজিয়ানরা মরদোভা জাতি গোষ্ঠীর অংশ এক ফিন্নো-উগ্রিক জাতি। সে সময় ১২২১ সাল পর্যন্ত ভোলগার শেষ স্লাভিয়ান শহর ছিল গোরাদেৎস।  ১২২১ সালে ভোলগা ও ওকার সঙ্গমস্থলে ভ্লাদিমির রাজ্য রক্ষার জন্য ইউরি ভসেভোলোদোভিচ দুর্গ তৈরি করেন। উদ্দেশ্য ছিল মকশান, এরজিয়ান, মারিই ও ভোলগার বুলগারদের হাত থেকে নিজ রাজ্য রক্ষা করা। তিনি এর নাম রাখেন নভগোরাদ নিজোভস্কই জেমলি। সেটা কালক্রমে নিঝনি নভগোরাদ নামে পরিচিত হয়।     

সামন্ত যুগে নিঝনি নভগোরাদ কখনও ভ্লাদিমির, কখনও বা সুজদাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর ১৩৪১ সালে নিঝেগোরাদস্কো-সুজদালস্কি রাজ্য নামে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলে ১৩৫০ সালে নিঝনি নভগোরাদ এই রাজ্যের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই রাজ্য আয়তনে যথেষ্ট বড় ছিল আর স্লাভিয়ান জাতির প্রধান কেন্দ্র হবার জন্য মস্কোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। এই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর লোকজন এসে এখানে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু মস্কো ধীরে ধীরে কী আয়তন কী সেনাবল, সব দিক থেকে প্রসার লাভ করে এবং   ১৩৯২ সালে নিঝেগোরাদস্কো-সুজদালস্কি রাজ্য নিজের দখলে নিয়ে নেয়, যদিও এই প্রক্রিয়া শেষ হয় ১৪২৫ সালে দ্বিতীয় ভাসিলির রাজত্বকালে। তখন নিঝনি নভগোরাদ কাউন্টির কেন্দ্রে পরিণত হয়। জার তৃতীয় ইভান ও তৃতীয় ভাসিলির সময় নিঝনি নভগোরাদ কাজানের সাথে সীমান্ত শহরের ভূমিকা পালন করে। সে সময় একে কাজান আক্রমণের জন্য সেনা ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়। ১৫০০ – ১৫১১ সালে কাঠের ক্রেমলিনের জায়গায় পাথরের  ক্রেমলিন তৈরি হয়। ১৫২৩ সালে তৃতীয় ভাসিল কাজান আক্রমণ করেন। তিনি সুরি নদীর তীরে ভাসিল বা ভাসিলসুরস্ক শহর গড়লে নিঝনি নভগোরাদ সীমান্ত শহরের দায়িত্ব মুক্ত হয়। এরপর জার ইভান গ্রজনি কাজান ও আস্ত্রাখান জয় করলে ভোলগা থেকে সমস্ত সীমান্ত উধাও হয়ে যায়।     

🍂

স্মুতা বা অরাজকতার সময় ত্রৈৎসে সেরগিয়েভ লাভরার পাশাপাশি নিঝনি নভগোরাদ মস্কোর সাহায্যে এগিয়ে আসে। পোলিশ ও লিথুনিয়ার হানাদারদের হাত থেকে রাশিয়াকে মুক্ত করার জন্য চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে নিঝনি নভগোরাদের মিলিশিয়া বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন নভগোরাদ জেমশিনার প্রধান কুজমা মিনিন ও যুবরাজ দ্মিত্রি পঝারস্কি। সপ্তদশ শতকে পাত্রিয়ারখ নিকনের আমলে রুশ চার্চে ভাঙ্গন দেখা দিলে নিঝনি নভগোরাদের আশেপাশে, বিশেষ করে কেরঝেনৎস নদীর তীরে অসংখ্য প্রাচীনপন্থী বা স্তারোঅব্রিয়াদপন্থীদের জনপদ গড়ে ওঠে। এই ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য ১৬৭২ সালে এখানে নিঝেগোরাদস্কায়া ও আলতীরস্কায়া এপারখিয়া গঠন করা হয় ১৭১৯ সাল পর্যন্ত যার প্রধান ছিলেন মেত্রপলিত বা রাশান চার্চের উচ্চপদস্থ ধর্মযাজক। 

পিটার দ্য গ্রেটের সংস্কারের ফলে ১৭০৮ সালে নভগোরাদ কাউন্টি কাজান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ১৭১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি (রাশিয়ায় তখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হত, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০৬ ফেব্রুয়ারি) নিঝনি নভগোরাদ প্রদেশ গঠন করা হয় আর নিঝনি নবগোরাদ হয় এর নবগঠিত প্রদেশের কেন্দ্র। ১৮১৭ সালে ওকা নদীর বাম তীরে অবস্থিত মাকারেভ শহরের রাশিয়ার বিখ্যাত বাজার নিঝনি নভগোরাদে স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে শহরের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। নভগোরাদ বাজারের সেই কমপ্লেক্সে দুটো রুশ অর্থোডক্স চার্চ, মসজিদ, আরমিয়ান চার্চ, থিয়েটার, সার্কাস এসব ছিল। এই বাজারের কারণে নিঝনি নভগোরাদকে রাশিয়ার পকেট বলে অভিহিত করা হত। ১৮৩৪ – ১৮৪১ সালে শহরের বিভিন্ন রকমের সংস্কার করা হয়। এর ফলে ক্রেমলিনের ভেতর থেকে সমস্ত আবাসিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়া হয়। ক্রেমলিন হয় শহরের সামরিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। উনবিংশ শতকের মধ্য ভাগে শহরের আশেপাশে বিভিন্ন কারখানা স্থাপিত হয় যাদের মধ্যে নিঝেগোরাদ মেকানিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও মেটাল কারখানা উল্লেখযোগ্য। ১৮৬১ সালে মস্কো – নিঝেগোরাদ রেললাইন বসানো হয়। ১৮৮০ সালে স্থাপিত হয় নিঝেগোরাদ স্টক এক্সেঞ্জ। ১৮৯৬ সালে বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় শিল্প প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে শহরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে – রাশিয়ার সর্বপ্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রাম লাইন কাজ করতে শুরু করে, ফানুকুলার তৈরি করা হয়, শহরের নিকোলায়েভ থিয়েটার নতুন দালানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লবের সময় নিঝনি নভগোরাদের সরমভস্কি কারখানায় শ্রমিক অভ্যুত্থান ঘটে। যদিও দ্রুত সেই অভ্যুত্থান দমন করা হয়, সমাজে সেই অভ্যুত্থান ব্যাপক সমর্থন লাভ করে বলে সেই সময়ের স্থানীয় পত্রিকা খবর প্রকাশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিঝনি নভগোরাদে রুশ সাম্রাজ্যের পশ্চিম অঞ্চলের উদবাস্তুদের ঢল নামে। ১৯১৫ সালে সেখানে “সিমেন্স ও গালস্কে” টেলিফোন কারখানা কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ কারখানাও এখানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৬ সালে নিঝেগোরাদ পপুলার ইউনিভার্সিটি কাজ শুরু করে, সেই সময় রুশ সাম্রাজ্যের অধীন ওয়ারশ পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এখানে সরিয়ে আনা হয় যা ছিল পরবর্তী কালের গোর্কি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ভিত্তি। শুরু হয় ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্থাপনার নির্মাণ কাজ। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে সংঘটিত হয় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। ফলে ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ আর শেষ হতে পারেনি। একই কারণে রুশ বরক্কো স্টাইলে প্রায় ১০০০ লোক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গির্জার নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয় ওকার উপরে ব্রিজের কাজ আর ভোলগার নীচ দিয়ে টানেলের কাজ। ১৯১৭ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে সাময়িক সরকারের কার্যকরী প্রাদেশিক কমিটি তৈরি হয়। মার্চের মাঝামাঝি কৃষক ডেপুটিদের সোভিয়েত তৈরি হয়। শুরু হয় দ্বৈত শাসন। ১৯১৭ সালের শরতে নিঝনি নভগোরাদে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি বিপ্লব, প্রতিটি পরিবর্তন আসে নতুন কিছু সৃষ্টির বার্তা নিয়ে। আবার সেই বিপ্লবই অনেক অনেক সৃষ্টির সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। কারণ জীবন মানেই ভাঙ্গা আর গড়ার ইতিহাস। প্রতিনিয়ত একদিকে যেমন এগিয়ে চলছে সৃষ্টির বিজয় রথ, অন্য দিকে পাশাপাশি চলছে ধ্বংসের বুলডোজার। এ যেন জীবন আর মৃত্যুর হাতে হাত রেখে চলা, যখনই জীবন দুর্বলতা দেখায় মৃত্যু তাকে মুহূর্তের মধ্যে গ্রাস করে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। মানুষ যেহেতু প্রকৃতির অংশ তাই সেও এই নিয়মের বাইরে নয়। আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত সেটা ঘটছে। ঝড়ের সময় আমরা যেমন বাতাসের উপস্থিতি উপলব্ধি করি, একই ভাবে বিপ্লবের সময় আমরা খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করি সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই যুগলবন্দী। 

ছবিতে নিঝনি নভগোরাদ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=248

নিঝনি নভগোরাদ ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=-QQ0VvDSXvg&t=946s

        

Post a Comment

0 Comments