মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৪
দেবেন্দ্রনাথ বেরা (সাইক্লিষ্ট, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর)
ভাস্করব্রত পতি
সাইকেল হলো দূষণহীন যান। আজকাল পেট্রলের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। মানুষ যদি এসময় সাইকেলকে বেছে নেয় পরিবেশবান্ধব যান হিসাবে তবে পরিবেশেরই উপকার হবে। এই ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সাইকেলকে নিজের বশে রেখেছিলেন যিনি, তিনি দেবেন্দ্রনাথ বেরা।
তাঁর সাইকেলে নেই কোনও সিট। নেই চেন, নেই ব্রেক, নেই বেল। কেবল দুটি চাকাই সম্বল। সেই ব্রেক, চেন, সিটবিহীন সাইকেল নিয়েই গত ২০১৮ এর ১৭ ই জুন ভারত ভ্রমণে রওনা দিয়েছিলেন সবংয়ের যুবক দেবেন্দ্রনাথ বেরা। স্বচ্ছতার বার্তা নিয়ে 'ভারতকে নির্মল কর' এবং 'নিজেকে নির্মল রাখ' স্লোগান ছিল তাঁর লক্ষ্য। পরিবেশকে পরিষ্কার রেখে সুস্থ ভারত গড়ার দাবিই ছিল দেবেন্দ্রনাথ বেরার আসল পরিকল্পনা। সবংয়ের ২ নং অঞ্চলের বড়সাহড়া গ্রামে জন্ম। তবে বেড়ে উঠেছেন ৫ নং সারতা অঞ্চলের সাতসাই গ্রামে, মামার বাড়িতে। কিন্তু গত ২০২২ এর ৭ ই ডিসেম্বর হঠাৎ মৃত্যু হয় মেদিনীপুরের এই বর্ণময় চরিত্রের সাইক্লিষ্টের। মেদিনীপুরবাসী বঞ্চিত হয় আরও নানা সচেতনতামূলক কাজের পরিধি থেকে।
১৯৯০ তে যখন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় পালিত হচ্ছিল ক্ষুদিরাম বসু জন্মশতবার্ষিকী, তখন তিনি সাইকেল নিয়েই শুরু করেছিলেন পরিভ্রমণ। সবংয়ের দেহাটি গ্রামে তাঁর সাইকেল যাত্রার উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন সভাধিপতি হরেকৃষ্ণ সামন্ত। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ৫৪ টি ব্লকে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল সেই অভিনব সাইকেল র্যালি। মাত্র ১ মাসে তা পরিক্রমা করেছিলেন তখন।
১৯৯২ সালে ‘সাক্ষরতা ও রোগ প্রতিরোধ' বার্তাকে সামনে রেখে শুরু করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পরিক্রমা। প্রতিটি জেলায় ঘুরেছিলেন তাঁর আশ্চর্য সাইকেল নিয়ে। মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে সেই যাত্রার উদ্বোধন করেন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী সুকুমার সেনগুপ্ত৷ সাইকেল নিয়ে অতিক্রম করেন চার হাজার কিমি পথ। ফের ১৯৯৪ এর ৯ ই ডিসেম্বর ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি' রক্ষায় শুরু হয় তাঁর ভারত ভ্রমণ। ২৮ টি রাজ্যই অতিক্রম করেন তিনি। ১৯৯৫ এর ১৭ ই এপ্রিল ফিরে আসেন কলকাতায়। তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন। তবুও তাঁর কৃতিত্বের জন্য কোনও স্বীকৃতিই জোটেনি।
এই মানুষটি সাইকেল অন্তপ্রাণ। বিয়ে করেননি। কিন্তু নানা কসরত দেখাতে ওস্তাদ তিনি। সামান্য ওষুধের দোকান চালাতেন তিনি। তীব্র অর্থসংকট। কিন্তু মনে নেশা -- পরিবেশ সুস্থ রাখার। পাঁচ ফুট মাটির নিচে সাইকেল সহ ২৪ - ৩৬ ঘণ্টা জীবন্ত সমাধিতে থাকা তাঁর কাছে জলভাত। চুলে কাছি বেঁধে লোডিং বাস টানা বা লরি টানতে তিনি ওস্তাদ। বুকের ওপর কাঠ চেরাই করা, মাথায় আগুন জ্বালিয়ে এক কেজি মাংস রান্না করা, চোখের ওপর আগুন জ্বালিয়ে চা তৈরি করা, বুকের ওপর লোডিং মোটরবাইক চালানো, বুকের ওপর দেড় দুই কুইন্টাল পাথর ভাঙার কাজ তিনি অনায়াসেই করতে পারতেন। এক সময় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনের সামনে তিনি তাঁর অদ্ভুত সাইকেলে চেপে কসরত দেখিয়েছেন। তাঁর এই নৈপুণ্য দেখেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, হাসিম আব্দুল হালিম, সুব্রত মুখার্জি, মানস ভুঁইয়া, সুভাষ চক্রবর্তীরা। এক হাত দিয়েই চাকা ঘুরিয়ে সাইকেল চালিয়েছেন তিনি।
তাঁর সাইকেলের কেবল দুটো চাকাই সম্বল। সেই সিট, ব্রেক, বেল, চেনহীন এমনই আজব সাইকেলে চেপে সবংয়ের দেবেন্দ্রনাথ বেরা ইতোমধ্যেই ঘুরে এসেছেন গোটা ভারত। প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে গিয়ে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজেও হাত লাগিয়েছেন তিনি। কিন্তু গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাঁর নাম ওঠেনি। ফের এমন মজার সাইকেলে চেপে প্রত্যন্ত গ্রাম সবং থেকে ভূভারত চষতে চেয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ বেরা। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সাথ দেয়নি।
সবংয়ের শিক্ষক শান্তনু অধিকারী এবং প্রয়াত গৌতমদেব পাত্রের নিরন্তর উৎসাহে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন এহেন বিরল সাইকেল নিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়ার। তিনি তাঁর লক্ষ্য পূরণের জন্য অনেকখানিই এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। স্বপ্নপূরণের আগেই তাঁকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তাঁর কথায়, 'সাধারণ সাইকেল নিয়ে তো সকলেই যেতে পারে। কিন্তু যে সাইকেলের ব্রেক, চেন, গিয়ার, সিট কিছুই নেই – এমন সাইকেল চালাতে পারে ক'জন'?
শুধু একটু সহযোগিতা এবং সহায়তা প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। ব্রেক, বেল, চেন, সিট বিহীন সাইকেলে চেপে ভারতের প্রতিটি শহরে ঘুরে আসতে বদ্ধপরিকর ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ বেরা। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ভাবনা। সেইসাথে সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের উন্নয়নের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার Thankless Job করার একজন মহানুভব ব্যক্তিকে হারালো মেদিনীপুরের লোকজন।
🍂
0 Comments