জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে- ২/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী        

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
      
দ্বিতীয় পর্ব

শ্রীদামের এই ভৎর্সনা শুনে শ্রীরাধিকা কুঞ্জ থেকে বেরিয়ে শ্রীদামকে বললেন "যে ব্রজাধম জনকের স্তুতি করে জননীর নিন্দা করে তার গোলকে থাকার কোন অধিকার নেই। আসুরিক আচরণের জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি অসুরযোনিতে তুমি জন্মগ্রহণ কর"। শ্রীরাধিকার অভিশাপ বাণী শুনে শ্রীদাম তাকে পাল্টা অভিশাপ দিয়ে বললেন "মানবীর মতো তোমার ক্রোধের জন্য তুমিও মর্ত্যভূমিতে মানবযোনিতে জন্মগ্রহণ করবে এবং কলঙ্কিনী হবে। গোকুলে তুমি শ্রীহরির অংশজাত কৃষ্ণের সাথে বিহার করে তাঁকে পাবে। শতবর্ষ পরে তুমি গোলকে পুনরায় শ্রীহরির কাছে ফিরে আসবে"।                     
শ্রীদাম শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে এসে সমস্ত শাপবৃত্তান্ত নিবেদন করে বললেন "প্রভু আপনার বিচ্ছেদে আমি কি করে বাঁচবো?" ভগবান শ্রীহরি বললেন "শ্রীদাম তুমি দুঃখ কোরো না। পাতাললোকে তুমি মহর্ষি কশ্যপের পৌত্র অসুররাজ দম্ভের পুত্র অসুর শঙ্খচুড় রূপে জন্মগ্রহণ করে অপরাজেয় হবে এবং তুলসীর স্বামী হবে। পঞ্চাশ যুগ পরে ভগবান শঙ্করের শূলে বিদ্ধ হয়ে তোমার অসুর দেহ ধ্বংস হবে এবং পুনরায় আমার কাছে ফিরে আসবে"।                                        
ইতিমধ্যে শ্রীরাধিকাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্রন্দন করতে করতে শ্রীহরির কাছে এলেন। তাঁকে প্রবোধ দিয়ে শ্রীহরি বললেন "প্রিয়ে, দুঃখ করে লাভ নেই। এ সকলই পূর্বনির্দিষ্ট। তুমি মর্ত্যলোকের গোকুলে যেয়ে গোপ বৃষভানু এবং গোপিনী কলাবতীর কন্যা রূপে জন্ম নিয়ে আয়ান ঘোষের ভার্যা হবে। আর আমি বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে জন্ম নিয়ে গোকুলে নন্দগোপ ও গোপিনী যশোদার গৃহে প্রতিপালিত হয়ে তোমার সাথে লীলা বিহার করবো বৃন্দাবনে। যে তুমি সেই আমি কোন ভেদাভেদ নেই। তুমি সৃষ্টির আধার আর আমি বীজ। তুমি যেখানে আমিও সেখানে। আমাদিগের মধ্যে নিশ্চিত কোনো ভেদ নাই। তুমি সৃষ্টির আধারভূতা আমি অচ্যূতবীজরূপী। আমি যখন তোমাকে ছাড়া থাকি তখন লোকে আমাকে শুধুই কৃষ্ণ বলে আর যখন তোমার সাথে একীভূত হয়ে থাকি তখন শ্রীকৃষ্ণ বলে। তুমি শ্রী, তুমি সম্পত্তি, তুমি আধারস্বরূপিনী সকলের এবং আমার সর্বশক্তি স্বরূপা। হে রাধে! তুমি স্ত্রী, আমি পুরুষ বেদও ইহা নির্ণয় করতে পারে না। হে অক্ষরে! তুমি সর্বস্বরূপা আমি সর্বরূপ। আমি যখন তেজঃস্বরূপ, তুমি তখন তেজোরূপা। আমি যখন যোগের দ্বারা সর্ববীজস্বরূপ হই তখন তুমি শক্তিস্বরূপা, সর্বস্ত্রীরূপধারিনী হও। এই বিশ্বের সমস্ত স্ত্রী তোমার কলাংশের অংশকলা। যাহাই স্ত্রী তাহাই তুমি, যাহাই পুরুষ তাহাই আমি। তুমি সদাই আমার আধার, আমি তোমার আত্মা। যেখানে তুমি সেখানেই আমি, তুল্য প্রকৃতি পুরুষ। হে দেবী, আমাদের দুইয়ের একের অভাবে সৃষ্টি হয় না। তুমি শ্রী, তুমি সম্পত্তি, তুমিই জগতের আধাররূপা। হে  রাধে, তুমি স্ত্রী, আমি পুরুষ - এইটি বেদের সিদ্ধান্ত। যে সময়ে আমি যোগে সর্ববীজ স্বরূপ হই তখন তুমিও সর্বশক্তি স্বরূপা ও সকল স্ত্রী রূপধারিনী হয়ে থাকো। তুমি আমার অর্ধাংশ থেকে প্রকাশিত মূল প্রকৃতি। তুমি শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও তেজ। যারা অজ্ঞ তারা আমাদের পৃথকভাবে। তোমার চেয়ে প্রিয় আমার কেউ নেই। তুমি আমার প্রাণেরও অধিক তুমি আছো আমার হৃদয়ে"। ভগবান শ্রীহরি স্বপার্ষদ মর্ত্যলোকে আসবেন - এ তাঁর পূর্বপরিকল্পিত। কোন কোন দেব দেবী তাঁর সাথে কোন রূপে মর্ত্যভূমিতে এলেন তা একবার দেখে নিই।
🍂

ভগবানের পরিকল্পনা 
এবারে আমরা জেনে নিই বৃষভানু বা কলাবতী এবং বসুদেব ও দেবকী পূর্বজন্মে কে ছিলেন। বৃষভানু পূর্বজন্মে ছিলেন মনুর বংশজাত রাজা সুচন্দ্র এবং কলাবতী ছিলেন পিতৃগনের মানস থেকে সৃষ্টি তিন কন্যার অন্যতমা। এই তিনকন্যা হলেন কলাবতী, রত্নমালা ও মেনকা। মেনকা শ্রীহরির অংশসম্ভূত পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয়কে পতিরূপে বরণ করেন, রত্নমালা জনক রাজাকে এবং কলাবতী রাজা সুচন্দ্রকে পতিরূপে বরন করেন। পরবর্তীকালে সুচন্দ্র গোকুলধামে রাজা সুরভানের স্ত্রী পদ্মাবতীর গর্ভে শ্রী হরির অংশ রূপে বৃষভানু রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। আর কলাবতী কান্যকুব্জে কমলার অংশভূতা অযোনিসম্ভবারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। রাধার স্বামী রায়ান বা আয়ান পূর্বজন্নে নারায়ণের তপস্যা করে রাধারূপী লক্ষ্মীকে স্ত্রী হিসেবে লাভ করার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান তার একটু খুঁত রাখলেন। কি সেই খুঁত? সূর্যের উত্তরায়ণে আয়ানের জন্ম। উত্তরায়ণ ফল শূন্য। অতএব আয়ান নপুংসক রূপে জন্মলাভ করলেন। যার ফলে রাধার মা হওয়ার সম্ভাবনা রইল না। নন্দের পালকপিতা নন্দরাজা জন্ম নিলেন অষ্টবসুর এক অংশে এবং বসুকামিনীর অংশে মা যশোদা। মহর্ষি কশ্যপ শ্রীকৃষ্ণের জন্মদাতা পিতা বসুদেব রূপে এবং দেবমাতা অদিতি দৈবকী রূপে জন্ম নেবেন। বসুদেবের পিতার নাম দেবমীঢ় এবং মায়ের নাম মারিষা। যদুবংশে দেবক নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি আহুকের পুত্র। দৈবকী আহুকের কন্যা। বসুদেব পূর্ব-পূর্ব জন্মে বিখ্যাত ছিলেন 'পৃশ্নি' রূপে। পরের জন্মে হলেন প্রজাপতি, তারপরের জন্মে মহামুনি কশ্যপ এবং এই জন্মে হলেন বসুদেব। স্বয়ং শ্রীহরি যখন মর্ত্যধামে এলেন তখন তাঁর মর্ত্যভূমের সঙ্গী সাথীদেরও স্বর্গ থেকে নিয়ে এলেন। এবং কে কোন অংশে জন্ম নেবেন তাও তিনি বললেন সুপরিকল্পিতভাবে। উদ্দেশ্য ধরিত্রীমাতাকে মর্ত্যভূমির মানুষের অত্যাচার, অনাচার থেকে রক্ষা করার জন্য। সেক্ষেত্রে শ্রীরাধিকার বা শ্রীদামের অভিশাপ উপলক্ষ মাত্র। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই উত্তর পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিজেই বলেছেন 'পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে'। যখন স্বয়ং শ্রীহরি তাঁর নিজের পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছেন সেখানে এইসব শাপ শাপান্তের উল্লেখ দিয়ে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন যে মনুষ্যলোকের সাথে দেবলোকের কোন পার্থক্য নেই?                            
গোলকধামে শ্রীহরির সামনে সব দেবদেবীরাও উপস্থিত। পূর্বে তিনি কিছু জন্মবৃত্তান্ত দেওয়ার পরে পুনরায় শুরু করলেন। কামদেবকে বললেন রুক্মিনী তনয় প্রদ্যুম্নরূপে তুমি জন্ম নিবে, তোমার স্ত্রী রতি মায়াবতী নামে শম্বর গৃহে অবতীর্ণ হয়ে ছায়ারূপে অবস্থান করবেন। স্বয়ং মায়াবতীর গর্ভে ব্রহ্মা কামদেবের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে বিখ্যাত হবেন অনিরূদ্ধ নামে। ভারতী, শোনিতপুরে অসুররাজ বানের কন্যা উষারূপে তুমি জন্ম নিবে এবং এই ঊষা ও অনিরুদ্ধের প্রণয় থেকে বিবাহ হবে। জগৎপতি অনন্তদেব, আপনি দেবকীর গর্ভে সঞ্চারিত হয়ে যোগমায়ার আকর্ষণে রোহিনীর গর্ভে নিহিত হয়ে বলরামরূপে জন্ম নিবেন। যোগমায়ার আকর্ষনে রোহিনীর গর্ভে নিহিত হওয়ার জন্য আপনার আরেক নাম হবে সঙ্কর্ষন। দ্বারকাতে আমার অষ্টপ্রধান মহিষীরা হবেন রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, মিত্রবিন্দা, নাগ্নজিতা, লক্ষণা, কালিন্দী এবং ভদ্রা। লক্ষ্মীর অংশভূতা হয়ে রুক্মিণী বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রূপে জন্ম নিবে, বসুন্ধরার অংশভূতা সত্যভামা দ্বারকাতে যাদব সত্রাজিতের কন্যা হবে। পার্বতীর অংশজাতা জাম্ববতী ভল্লুকরাজ জাম্বুবানের কন্যারূপে জন্ম নিবে। এই জাম্বুবান সত্রাজিতের ভাই প্রসেনকে হত্যা করে সামন্তক মনি শ্রীকৃষ্ণকে দিয়েছিলেন। সরস্বতীর এক অংশে জন্ম হবে মিত্রবিন্দার এবং অপর অংশে জন্ম হবে ভদ্রার। এই মিত্রবিন্দা অবন্তীরাজ জয়সেনের কন্যা এবং ভদ্রা কেকয়রাজ ধৃষ্টকেতুর কন্যারূপে জন্ম নেবে। বেদমাতা সাবিত্রী মর্ত্যভূমিতে নাগ্নজিতা নাম নিয়ে কেশলরাজ সত্যর কন্যা হবে। তুলসীর এক অংশে লক্ষণা জন্ম নিয়ে ভদ্ররাজ বৃহৎসেনার কন্যা হবে এবং কালিন্দী যমুনা বা বিরজার অংশরূপে জন্ম নিবে।     
                                                      পরবর্তী অংশ তৃতীয় পর্বে

Post a Comment

0 Comments