জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৪ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৪ 
 সালেহা খাতুন 

না সব মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃতি দেখা যায় নি। ভালো মানুষ সেদিনও ছিল আজও আছে। বাবরি মসজিদ/রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিরানব্বইয়ের উত্তাল ডিসেম্বরে নিজগৃহও আর নিরাপদ ছিল না। আমার বন্ধু বন্দনা চ্যাটার্জি বুড়িখালি থেকে সাইকেল চালিয়ে আমাদের সাহাপুরের বাড়িতে চলে এলো। বাবাকে বললো, ‘কাকু, বাবা আমাকে পাঠালেন আপনাদের সবাইকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখানে এখন থাকা আপনাদের পক্ষে নিরাপদ নয়’। বাবা বললেন, ‘চিন্তা করো না মা ভালো আছি। আর বাবাকে বলো কিছু অসুবিধা দেখা দিলে নিশ্চয়ই আমরা তাঁর সাহায্য নেবো’।

বন্দনার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজেই। অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য লিস্ট দেখতে গিয়ে পরিচয়। লিস্টে ওর নাম বেরিয়েছিল বেদানা চ্যাটার্জি। তাই নিয়ে হাসতে হাসতে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। আমরা মানে চৈতালী, তনুজা, বন্দনা এবং আমি। বন্দনা আমি বাউড়িয়ার আর তনুজা চৈতালী নলপুরের।

 ট্রেন যাত্রার সব অকল্পনীয় গল্প আছে আমাদের। প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ আন্দুলে। আমরা আন্দুলে প্রায় দিনই প্ল্যাটফর্মে নামতে পারতাম না, এতো ভিড় থাকতো। তার উপর আন্দুল থেকে যারা উঠতো তারা সবাই ঠেলে আবার আমাদের ভেতরে নিয়ে চলে যেতো। তাই আমরা উল্টো দিকে রেললাইনেই ঝাঁপ দিয়ে নামতাম। বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। কতদিন আর এমন করা যায়! আমরা নতুন একটা প্ল্যান করলাম। পেনসিল হিল জুতো পরে যারা প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ধরার জন্য গুঁতোগুঁতি করতো ট্রেন থেকে তাদের পায়ে লাফিয়ে পড়তাম। যাক এরপর থেকে তারা নামার জন্য জায়গা দিত।
🍂
ফেরার পথে স্টেশনে বসে এমন গল্পে মশগুল থাকতাম যে তনুজা একবার জুতো ফেলে খালি পায়েই ট্রেনে উঠে এসেছিল। ট্রেন পথে দীপক ও আরো অনেকে থাকতো। সোম থেকে শনি কলেজে ট্রেনে যেতে কোনো অসুবিধা হতো না। তবে রবিবার দিনও ট্রেন যাত্রা শুরু হলো বিরানব্বইয়ের এগারোই এপ্রিল থেকে। ঐ দিন থেকে আমাদের একটি অমূল্য যাত্রা শুরু হয় সাঁতরাগাছির উদ্দেশ্যে। অধ্যাপক ড. শ্যামল সেনগুপ্ত মহাশয়ের বাড়ি ওখানে। বিরাট  একটি দল ক্লাসের বাইরেও স্যারের কাছে পাঠ গ্রহণের জন্য আমরা যেতাম। অমন প্রিয় জায়গা আর দুটি নেই ভূভারতে।
ঐ রবিবারটির জন্য আমাদের বন্ধুদের সবার উৎকণ্ঠা এবং ব্যাকুলতা। সারা সপ্তাহ ধরে ঐ দিনটি আসার প্রতীক্ষায় আমরা থাকতাম। রবিবার যে আমাদের কাছে তখন কত আদরনীয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রবিবার আমরা নবনারীতলায় যখন মিলিত হতাম তখন আমাদের আনন্দের শিহরণ দেখে স্যার আমাদের বাঁদর আখ্যায় ভূষিত করতেন এবং বলতেন আমরা নাকি পরস্পরের লেজ টানাটানি করার জন্য ঐ ব্যাকুলতা জানাই। বন্ধুরা বিভিন্ন স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতাম। ট্রেন এলে তাতে চেপে আমাদের যত মজার গল্পের বন্যা বয়ে যেতো। রাস্তায় নেমে আমরা মিছিলের মতো সজ্জায় চলতাম। স্থানীয় বাসিন্দারা মন্তব্য করতো – কোন গর্তে আমরা ছিলাম, মেদিনীপুরিয়া না গাদিয়াড়া অধিবাসী ইত্যাদি। আমাদের মতো এই নর-ভূত-পেত্নীদের দেখার জন্য প্রত্যেক বাড়ি – ত্রিপর্ণা, ভালোবাসা,দুরাশা,পূর্বাশা,মুক্তালয় থেকে বহু মানুষজন জানালায় উঁকিঝুঁকি দিতো। তা দেখে আমাদের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠতো। চিৎকার চেঁচামেচি হইহল্লা করে আকাশ বাতাস মথিত করে আমরা চলতাম। রাস্তায় ভ্যান রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে গালাগাল খেতাম। এতে আনন্দ চতুর্গুণ বেড়ে যেতো। কেউ ভদ্রভাবে যেতে বললে তার সামনে আমরা এমন অভদ্র আচরণ করতাম সে বেচারি মনে মনে না হেসে পারতো না। এই দলই যখন আমরা একা হয়ে যেতাম তখন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না। নিজেদের আচরণ মনে পড়লে নিজেরাই হেসে সারা হই। 

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments