সুমিত্রা ঘোষ
কোন এক তীরে রানির নৌকো ভিড়েছিল এবং এক ব্রাহ্মণ কুটিরে আশ্রয় পেয়ে ব্রাহ্মণের দয়ায় রানি প্রাণে বেঁচে গেলেন। প্রতিদান স্বরূপ দয়াময়ী রানি রাসমণি ব্রাহ্মণ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দানে(বাবদ) কৃতজ্ঞতা জানালেন। রানি সদলবলে আবার জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে পুরী যাত্রা করলেন। সুবর্ণরেখা নদীর উপর দিয়ে রানি সমস্ত নৌবহর চলেছে। রানি নদীর দুপাশ দেখতে দেখতে চলেছেন। রানি দেখলেন নদীর পাড়ের রাস্তাঘাট ভাল নয়, ভগ্নদশা। লোকের পথ চলাচলের অসুবিধার কথা ভেবে রানি নিজ তহবিলের টাকা দান করে ভগ্ন রাস্তা মেরামত করার ব্যবস্থা করলেন এবং কয়েকদিন ওখানে নৌকোয় অবস্থান করে তারপর একদিন পুরীর পথে রওনা দিলেন। পুরীতে পৌঁছে রানি প্রচুর দানধ্যান করলেন। জগন্নাথদেব সুভদ্রাজি ও বলরামজীকে হীরকখচিত মুকুট নিবেদন করলেন। পান্ডাদেরও অর্থ দান করেছিলেন।
পুরী ভ্রমণ শেষে রানি আরও কয়েকটি তীর্থ ভ্রমণ করেন, যেমন সাগর সঙ্গমে স্নান, ত্রিবেণীতে স্নান এবং নবদ্বীপ দর্শন। সাগর সঙ্গম ভ্রমণ ও স্নান এবং ত্রিবেণীতে রানির স্নান ভালোভাবে কাটলেও নবদ্বীপ দর্শন করে ফেরার পথে দলবলসহ রানি ডাকাতের হাতে পড়লেন। তখনকার দিনে বর্গীর হামলা, ডাকাতদলের হামলা মানুষের মনে সর্বক্ষণ ত্রাসের সঞ্চার করত। রানি রাসমণির অনেক পর সারদা মা মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন বর্গীর হামলা কমে এলেও ডাকাতদলের অত্যাচার প্রবল ছিল। কত নিরীহ লোককে খুন করে টাকা-পয়সা লুঠ করত তার সীমা-পরিসীমা ছিল না। যাইহোক নবদ্বীপে এসে রানি ডাকাত দলের হাতে পড়লেন। বারো হাজার টাকা ডাকাতকে দিয়ে রানি প্রাণে বাঁচলেন এবং সদলবলে নবদ্বীপ ছাড়লেন।
🍂
সে বছর তীর্থদর্শন সেরে রানি রাসমণি ভাবলেন একবার জন্মস্থান কোনা গ্রাম ঘুরে আসবেন। তখন রাজচন্দ্র দাস বেঁচে নেই, একাই রানিকে সব সামলাতে হচ্ছে। সময়টা খুব সম্ভব ১২৫৭/৫৮ বঙ্গাব্দ। ইংরাজির ১৮৪৯/৫০ সাল হতে পারে।স্মৃতির পাতা উলটে যতটা মনে পড়ছে তাতে মনে হয় খুব সম্ভব ১২৩০ বঙ্গাব্দে(ইংরাজীর ১৮২৩/২৪ সাল) যখন রানির পিতা হরেকৃষ্ণ দাস ইহলোক ত্যাগ করেন তখন রানি রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে হালিশহরের কোনা গ্রামে নিজের বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রানির দুই দাদা ও একপিসিমা কোনাগ্রামে থাকতেন। সেই সময় রানি দাদাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও কিছু আর্থিক সাহায্য করেন। ১২৩০ বঙ্গাব্দের পর রানি আবার ১২৫৭/৫৮ বঙ্গাব্দে হালিশহরের কোনা গ্রামে যান। তখনকার দিনে কোনাগ্রাম অনুন্নত শ্রীহীন পল্লীগ্রাম ছাড়া আর কিছু লক্ষ্যণীয় ছিল না। দরিদ্র পল্লীবাসীরা তাঁর গ্রামের মেয়ে রানিকে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত। রানিও তাঁদের পেয়ে খুব খুশী হলেন। গ্রামবাসীদের প্রচুর অর্থ সাহায্য করলেন। জানবাজারের জমিদারনী হলেও রানি মনে প্রাণে গ্রামের একজন সাধারণ মেয়ে রয়ে গিয়েছেন। মনে বিন্দুমাত্র অহংবোধ ছিল না রানির। কোনা গ্রামে রানির পিত্রালয়ের কাছে গঙ্গাঘাটের রাস্তা ঘাট ভাঙাচোরা ছিল এবং গঙ্গায় স্নান করার কোনো ঘাট ছিল না। গ্রামবাসীরা তাঁদের মেয়ের কাছে একটি ঘাটের অনুরোধ জানালেন, রানি গঙ্গায় ঘাট করিয়ে দিলেন। ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল ঐ ঘাট বাবদ। ঐ সময় রানি কাছাকাছি আরও কয়েকটি ঘাট নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব রানিকে বলেছিলেন জগন্মাতার অষ্টসখীর এক সখী রানি রাসমণি। ধরাধামে শ্রীশ্রী জগদম্বার পূজা প্রচারের জন্য তিনি ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ক্রমশ
0 Comments