জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে-৩/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী     

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব

          
তৃতীয় পর্ব

শ্রীকৃষ্ণের এই আদেশ শুনে ব্রহ্মা বললেন "হে প্রভু, আপনার আদেশের পরে আমার অন্তরে একটি প্রশ্ন জেগেছে"। শ্রীকৃষ্ণ বললেন "কি সেই প্রশ্ন"? তার উত্তরে ব্রহ্মা বললেন "আপনি বলছেন স্বয়ং মাতা পার্বতী ভল্লুকরাজ জাম্বুবানের কন্যারূপে জন্ম নেবেন। অন্যান্য দেবীরা যখন রাজকন্যারূপে জন্ম নিবেন সেক্ষেত্রে মাতা পার্বতী কেন ভল্লুকরাজ জাম্বুবানের কন্যারূপে জন্ম নিবেন"। শ্রীকৃষ্ণ বললেন "পার্বতীনন্দন গণেশের জন্মের পরে সমস্ত দেবতারা গণেশকে আশীর্বাদ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে কিরিটি কুণ্ডলধারী নবযৌবনসম্পন্ন বিষ্ণুকে দেখে পার্বতী লজ্জায় আরক্তিম হয়ে নিজের আচলে মুখ ঢেকে নিয়ে সকলের অগোচরে একবার স্বামী পঞ্চাননকে আবার পরক্ষণে বিষ্ণুকে দেখে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না কে বেশি আকর্ষণীয়। মহাদেব অন্তর্যামী। তিনি পার্বতীকে একান্তে ডেকে বললেন 'ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও আমি তিনজনেই অভিন্ন, আমরা সকলেই এক ও সনাতন ব্রহ্ম। তুমিও এক প্রকৃতি সর্বরূপিনী, সকলের মাতৃস্বরূপা। তুমি ব্রহ্মার কাছে সরস্বতীরূপে, বিষ্ণুর অঙ্কশায়িনী লক্ষ্মীরূপে এবং আমার ক্রোড়ে আনন্দরতা পার্বতীরূপে ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে বিরাজিত। তোমার মনের ইচ্ছা অনুসারে তুমি বিষ্ণুকে একবার আলিঙ্গন কর'। মহাদেবের এই কথা শুনে পার্বতী অধোবদনে বললেন "প্রভু, এ জীবনে আপনার আদেশ আমি পালন করতে অসমর্থ। তবে আপনার আদেশ অনুসারে দেহান্তরে জন্ম লাভ করে বিষ্ণুর ভজনা করব"। এই কাহিনী শুনে ব্রহ্মা বললেন "প্রভু, দেহান্তরে পার্বতী যখন বিষ্ণুর ভজনা করবেন তাহলে তাঁর জন্ম পৃথিবীতে কোন রাজকুলে না হয়ে সামান্য ভল্লুক জাম্বুবানের গৃহে কেন হবে"? তার উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন " ত্রেতাযুগে আমার রাম অবতারে জাম্বুবান আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন এবং আমার আশীর্বাদে তিনি চিরজীবী। এই জাম্বুবান আবার হিমালয়ের অংশস্বরূপ। তাই পার্বতী তাঁর কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে আমার ভজনা করবেন"।                               
অষ্ট মহিষীর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করে অন্যান্য দেব দেবীদের আদেশ করলেন তারা মর্ত্যভূমিতে কে কোথায় জন্ম নিয়ে তাঁর লীলা সহচর হবেন। স্বয়ং লক্ষ্মীর অংশে ষোল হাজার রমণী কুলরক্ষার্থে আমার ভার্যা হবেন যাঁরা পূর্বজন্মের পাপে নরকাসুরের প্রাসাদে বন্দিনী হবেন। স্বয়ং সূর্যের অংশে মহাবীর কর্ণ, ধর্মের এক অংশে যুধিষ্ঠির এবং অপর অংশে বিদুর, পবনদেবের অংশে ভীম, দেবরাজ ইন্দ্রের অংশে অর্জুন, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অংশে নকুল ও সহদেব এবং কলির অংশে দুর্যোধন জন্ম নিবেন। বসু অংশে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, শিবের অংশে অশ্বত্থামা, চন্দ্রের অংশে অভিমন্যু, বৃহস্পতির অংশে দ্রোণ, লক্ষ্মীর অংশে যজ্ঞসম্ভূতা হয়ে যাজ্ঞসেনী, শতরূপের অংশে সুভদ্রা, অগ্নির অংশে ধৃষ্ট্রদ্যুম্ন, কালনেমীর অংশে কংস জন্ম নেবেন। এরা সকলেই মর্তভূমিতে আমার লীলা সহচররূপে বিরাজ করবেন। 
মর্ত্যভূমিতে তাঁর লীলা প্রকাশ কিভাবে হবে সে কোথাও তিনি বলে দিলেন। প্রথমে মথুরাতে কংসের কারাগারে জন্ম নিয়ে বৃন্দাবনে তাঁর বাল্যলীলা প্রকাশ করবেন। শ্রীরাধা ও গোপীগনের সাথে লীলা প্রকাশ করে কৈশোরে মথুরায় কংস বধ করার পরে দ্বারকায় যেয়ে রাজ্য স্থাপন করে তাঁর ষোল হাজার আট মহিষীদের সাথে জীবনের অবশিষ্ট অংশ অতিবাহিত করে তাঁর মর্ত্যলীলা শেষ করে পুনরায় গোলকধামে ফিরে আসবেন। পৃথিবীকে ধর্মের গ্লানি থেকে মুক্ত করে ধর্মরাজ্য স্থাপনের অভিপ্রায়ে প্রথমে মথুরায় কংসবধ ও এবং পরবর্তীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমস্ত দুরাচারীদের ধ্বংস করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই চিত্রনাট্য প্রকাশের পরে সমস্ত দেব-দেবীগণ মর্ত্যভূমিতে চলে এলেন। 
                                                                                                                                    শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব 
                                                                         ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। গর্গ সংহিতায় বলা হয়েছে গোলকপতি শ্রীকৃষ্ণ ভুলোকে অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্প করে তার প্রাণাধিকা শ্রী রাধিকাকে ভূলোকে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করলেন। তখন শ্রীরাধিকা বললেন "যত্র বৃন্দাবনং নাস্তি ন যত্র যমুনা নদী। যত্র গোবর্ধনো নাস্তি তত্র মে ন মনঃসুখং। এর অর্থ হল যেখানে বৃন্দাবন, যমুনা নদী আর গোবর্ধন পর্বত নেই সেখানে গিয়ে আমি মনে শান্তি লাভ করতে পারব না"। শ্রীরাধিকার কথা শুনে গোলকপতি শ্রীকৃষ্ণ গোলকধাম থেকে বৃন্দাবন, যমুনা ও গোবর্ধন পর্বতকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। এই বৃন্দাবনে ২৪টি বন সমাযুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার বৃন্দাবন লীলার সাক্ষী হলেন।
🍂

বৈবস্বত মন্বন্তরের অষ্টাবিংশতি চতুর্যুগের দ্বাপর যুগের শেষভাগ। দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান, কংসের যম। কৃষ্ণের জন্ম অদ্ভুতভাবে হয়েছিল। যেহেতু তিনি স্বয়ং ভগবান সেই জন্য তিনি অযোনিসম্ভব। শোনিত ও বীর্যের সংমিশ্রণে দেবকীর গর্ভের ভ্রুন গঠন হয়নি। তাহলে সন্তান কিভাবে হলেন? ভগবানের মায়ায় তাঁর ইচ্ছায় দেবকীর গর্ভে বায়ু পূর্ণ হয়ে গর্ভলক্ষনে পরিণত হলো। ন'মাস কেটে যেয়ে দশ মাস উপস্থিত। দেবকীর রূপের ছটায় কারাগার আলোকিত। দেবকীকে দেখে কংসের মনে হতে লাগলো দেবকী যেন আকাশের কোন জ্যোতিষ্ক। এলো সেই রাত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির নিকষকালো অন্ধকার। কংসের মন খারাপ। উদ্বেগে পায়চারি করছেন। বারবার কারারক্ষীদের কাছে খবর নিচ্ছেন দেবকীর কোলে কি কেউ এল? রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। সারা আকাশে ঘন কালো মেঘ, বিজলী চমকাচ্ছে। কংসের কারাগারের রক্ষীদের চক্ষে নেমে এলো মায়ানিদ্রা। এই অবসরে দেবতারা সবাই আকাশ থেকে নেমে এলেন ধরার ধূলিতে কংসের কারাগারে। এক্ষুনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গোলকধাম থেকে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন। ব্রহ্মা, শিব ও ধর্ম এসে শুরু করলেন স্তব - 'হে জগৎযোনি, অযোনি, অনন্ত ও অব্যয়। তুমি জ্যোতিস্বরূপ, অনঘ, সগুন, নির্গুন ও মহৎ। তুমি নিরঙ্কুশ, তুমি নিরাকার কিন্তু ভক্তের অনুরোধে কখনো কখনো সাকার। তুমি স্বেচ্ছাময়, সর্বেশ, সর্ব ও সর্বগুনাশ্রয়। তুমি সুখদ, তুমি নির্ব্যুহ, নিখিল পদার্থের আধার'। তিন দেবতা স্তব করছেন আর তাঁদের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু নির্গত হচ্ছে। তাঁরা যাবার পরে অন্যান্য দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করে চলে গেলেন। "মুমুচুর্মুয়োঃ দেবাঃ সুমনাংসি মুদান্বিতাঃ। মন্দং মন্দং জলধারা জগর্জুরনুসাগরম্ঃ"।। চতুর্দিক অদ্ভূত রকমের শান্ত। অন্তরীক্ষে অপ্সরারা নৃত্য করছেন, বিদ্যাধরেরা গান গাইছেন। এই সময়ে বসুন্ধরা রমণীরূপ ধারণ করে কারাগারে প্রবেশ করলেন। মথুরাপুরী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, শুধু কংসের কারাগারে বসুদেব ও দেবকী জেগে আছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের লগ্ন আগত। অশুভ গ্রহেরা সরে যেয়ে শুভ গ্রহের সংযোগ ঘটলো। কিরকম সেই শুভ গ্রহের যোগ! রোহিনী নক্ষত্র, অষ্টমী তিথি, জয়ন্তী যোগ, অর্ধচন্দ্রদয়, মীন লগ্ন এবং অন্যান্য সমস্ত গ্রহ লগ্নের একাদশে বিরাজ করছেন। এমন সময় চতুর্দিকে জয়ধ্বনি উঠলো, শঙ্খনিনাদ ও হরিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে গেল। দেবকী মায়ানিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লেন। আর সেই সময়ে দেবকীর উদর থেকে সমস্ত বায়ু বেরিয়ে গেল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর হৃদয় থেকে আবির্ভূত হলেন। চারিদিকের ঘন অন্ধকার দূর হয়ে তৎক্ষণাৎ যেন পূর্ব দিগন্তে ষোলকলা পূর্ণ চন্দ্রমার উদয় হলো। এই সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক ঝলকে দেখিয়ে দিলেন তার চিরকালীন মনোহর মূর্তি - দ্বিভূজ, হাতে বাঁশি, দু' কানে মকরাকৃতির কুণ্ডল, কৃষ্ণ কেশদাম, রত্নভূষণে বিভূষিত, পরিধানে পীতবস্ত্র, গাত্রবর্ণ নীল মেঘের ন্যায়, কুমকুম ও চন্দনে চর্চিত, ওষ্ঠাধরে স্মিতহাসি। মুখাবয়ব যেন শরৎকালের পূর্ণচন্দ্র, অধর দুটি বিম্বফলের ন্যায় গাঢ় লাল। মাথায় ময়ূরপুচ্ছশোভিত চূড়া, রত্ন মুকুট। তাঁর শরীরের মধ্যদেশ ঈষৎ বঙ্কিম, ত্রিভঙ্গমুরারি। গলদেশে বনমালা, হৃদিমাঝে শ্রীবৎস চিহ্ন, সেখানে আবার কৌস্তভমণি। বসুদেব ও দেবকী তাঁদের সামনে এই মূর্তি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন। তাদের গন্ডদেশ বেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ল। তারা উভয়ে হাতজোড় করে স্তব করতে শুরু করলেন। সদ্য আবির্ভূত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসুদেব ও দেবকীর স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন "আপনাদের পূর্বার্জিত পুণ্যফলে আমি আপনাদের কাছে এসেছি"। পিতা বসুদেবকে বললেন "পূর্বজন্মে আপনি বিখ্যাত ছিলেন 'পৃশ্নি' নামে। তারপরের জন্মে আপনি যোগীগন শ্রেষ্ঠ প্রজাপতি ঋষি হয়ে নিরন্তর তপস্যা প্রভাবে আমার দর্শন লাভ করেছিলেন এবং আমার মত একটি পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। আমিও অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তা করেছিলাম আমার তো দ্বিতীয় কোন হতে পারে না, তাহলে আমাকেই আসতে হবে। এর পরের জন্মে আপনি কশ্যপরূপে জন্মগ্রহণ করলেন এবং মাতা দেবকী দেবমাতা অদিতিরূপে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান জন্মে আপনি কশ্যপের অংশসম্ভূত বসুদেব নামে জন্ম নিলেন এবং দেবমাতা অদিতির অংশসম্ভূতা দেবকীরূপে জন্ম নিলেন। আমি ইতিপূর্বে একবার অদিতির গর্ভে আপনার অংশে বামনরূপে জন্ম নিয়েছিলাম। কিন্তু এই জন্মে আমি আপনাদের পরিপূর্ণতম পুত্র হলাম। এখন আপনারা আমাকে পুত্রভাবেই হোক বা ব্রহ্মভাবেই হোক লাভ করে জীবন্মুক্ত হবেন। এইবার আপনি আমাকে কোলে নিয়ে যমুনা পেরিয়ে ব্রজধামে নন্দভবনে গমন করবেন। সেখানে যশোদার কোলে যোগমায়া এক কন্যারূপে জন্ম নিয়েছেন। আপনি আমাকে যশোদার কোলের কাছে রেখে যোগমায়ারূপী কন্যাকে নিয়ে এসে মা দেবকীর কোলের কাছে রাখবেন"। উভয়ে দেখতে পেলেন স্বয়ং শ্রীহরি তাঁদের পুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এরপরে শ্রীকৃষ্ণ যোগমায়ার প্রভাবে পুনরায় সাধারন শিশুর রূপ ধারণ করলেন।
     (পরবর্তী অংশ চতুর্থ পর্বে)

Post a Comment

0 Comments