পর্ব ৯২
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
শান্তিতে সে লভুক বিশ্রাম
১৮৯৬ সালের ২৭ জুন স্বামীজীর নির্দেশে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন গুডউইন এবং স্বামী সারদানন্দ। জুলাই মাসের ২ তারিখে তাঁরা নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছান। আমেরিকা যাওয়ার বিষয়ে স্বামীজী গুডউইনকে বলেছিলেন, “শরৎ আমেরিকাতে যাবে, তুমিও এর সঙ্গে যাও। শরৎ নতুন লোক, আমেরিকার হালচাল জানে না। তুমি সঙ্গে থাকলে শরতের অনেক উপকার হবে।” গুডউইন বলেন, “আমার তো ওখানে থাকার খরচা নেই।” স্বামীজী বলেন, “ওর জন্য তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। আমি দেব।” ( লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ, প্রথম খণ্ড, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, মহেন্দ্র পাবলিশিং হাউস ) সারদানন্দজীকে আমেরিকায় পাঠান স্বামীজী অবশ্যই বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যে।
কয়েকমাস পর ভারতে বৃহত্তর কাজের তাগিদে প্রত্যাবর্তনের ভাবনা এল স্বামীজীর মনে। গুডউইন ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছেন। স্বামীজী স্থির করেন গুডউইনও তাঁর সঙ্গে ভারতে যাবেন, শুধু যাওয়াই নয় সেখানে গিয়ে সন্ন্যাসও গ্রহণ করবেন। ১৮৯৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি স্বামীজী, গুডউইন ও তাঁর অন্যান্য সফরসঙ্গী সমভিব্যহারে মাদ্রাজ থেকে স্টিমারে রওনা হয়ে বজবজে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ পৌঁছান। এর আগে ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার কলম্বো পৌঁছেছিলেন তাঁরা। লণ্ডন থেকে ইতালি হয়ে কলম্বো পৌঁছেছিলেন। ১৮৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংল্যাণ্ড থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন স্বামীজী, সেইসময় গুডউইন তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। গুডউইন পরে যোগ দেন। চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বাথইস্টনে কয়েকটি দিন নিভৃতে তাঁর বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে যান। ২১ ডিসেম্বরের পূর্বে তিনি ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করেননি। এরপর ইংলণ্ডের সাউদাম্পটন জাহাজে চেপে ইতালি পৌঁছে তিনি স্বামীজীর সঙ্গে মিলিত হন। উৎফুল্ল স্বামীজী সহর্ষে বলে ওঠেন -- ‘অবশেষে, এবার ভারত যাব -- আমার ভারত!’ ( ইস্টার্ন অ্যাণ্ড ওয়েস্টার্ন ডিসাইপলস, দ্য লাইফ অফ স্বামী বিবেকানন্দ, অদ্বৈত আশ্রম)
🍂
ঘটনাচক্রে গুডউইনের আর সন্ন্যাস গ্রহণ হয় নি! ভারতের উটকামণ্ডে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে স্বামীজী বিষণ্ণ হয়ে পড়েন এবং বলেন --‘আমার ডানহাতখানি চলে গেল। আমার এ-ক্ষতি অপূরণীয়।’ স্বামীজী একটি কবিতাও রচনা করেন, যেটি গুডউইনের মা'কে পাঠিয়ে দেন পুত্রের স্মরণিকা হিসাবে। কবিতাটি হল ‘Requiescat in Peace' -- ‘Speed forth, O soul! upon thy star-strewn path;/ Speed, bliss one! where thought is ever free,/ Where time and space no longer mist the view,/ Eternal peace and blessings be with thee!’ ইত্যাদি। বঙ্গানুবাদে কবিতাটির নাম --‘শান্তিতে সে লভুক বিশ্রাম’। যেটি এইরকম -- ‘চল আত্মা, শীঘ্রগতি, তারকাখচিত তব পথে,/ ধাও হে আনন্দময়, যেথা নাহি বাঁধে মনোরথে;/ দেশকাল দৃষ্টিপথ যেথা নাহি করে আবরণ,/ চিরশান্তি আশীর্বাদ যেথা করে তোমারে বরণ!’
অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি
------------------------------------------------
১৮৯৬ সালের ৬ জানুয়ারি স্বামীজী তাঁর এক পাশ্চাত্য অনুগামিনী কৃস্টিন গ্রিণস্টাইডেলের উদ্দেশ্যে উপহারস্বরূপ একটি কবিতা রচনা করেন, কবিতাটির নাম 'অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি'। ( মূল কবিতাটি ইংরেজিতে লেখা ) কবিতাটি হল এইরকম --‘তুষার কঠিন মাটিই না হয় হোক না তোমার শয্যা,/ আবরণ তব শীতার্ত ঝঞ্ঝার,/ জীবনের পথে নাই বা জুটল বন্ধুজনার হর্ষ,/ ব্যর্থ তোমার সৌরভ বিস্তার;/ প্রেম যদি হয় নিজেই ব্যর্থ তবু কি বা আসে যায়/ না হয় ব্যর্থ সৌরভ সঞ্চার/ অকল্যাণের জয় যদি হয়, কল্যাণ পরাজিত,/ পুণ্যের পরে পাপের অত্যাচার;/ তবু প্রশস্ত বিকশিত থাকো, পবিত্র মধুময়/ থাকো অবিচল আপনার মহিমায়,/ দাও ঢেলে দাও স্নিগ্ধ উদার মধু সৌরভ তব।/ চির -প্রসন্ন অযাচিত করুণায়।’ কবিতাটি স্বামীজী কৃস্টিনকে উদ্দেশ করে লিখলেও সকল মানুষের কাছেই প্রেরণাময় একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। কীভাবে কৃস্টিন গ্রিণস্টাইডেল স্বামীজীর সংস্পর্শে এলেন সেই ইতিহাস এইরকম -- “আমেরিকায় স্বামীজীর আবির্ভাবের বিস্ফোরক প্রভাব অনুভূত হয় শিকাগোতে ১৮৯৩ সালে। ক্রমপ্রতিক্রিয়ার প্রথম তরঙ্গটি অনুভূত হল ডেট্রয়েটে। ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, এখানে কৃস্টিন গ্রীণস্টাইডেল দোলাচলচিত্তে স্থির করলেন ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নামে এক ভারতীয় যোগীর বক্তৃতা শুনতে যাবেন।
কৃস্টিন, তাঁর বান্ধবী শ্রীমতী মেরী ফাঙ্কির সাথে দিনকতক নানা বক্তৃতাবলী শুনে আসছিলেন। সেইসব বক্তৃতার অনেকগুলিই খুব নীরস মনে হয়েছিল। কেবল শ্রীমতী ফাঙ্কির পীড়াপীড়িতেই কৃস্টিন সেদিন স্বামীজীর বক্তৃতায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন।
স্বামীজীর কৃপা কৃস্টিনের অজ্ঞাতসারেও তাঁর উপর বর্ষিত হয়েছিল।” ( স্বামীজীর কৃস্টিন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয়) ওই দিনের বক্তৃতা শ্রবণের পর কৃস্টিনের স্মৃতিচারণ থেকে প্রতিক্রিয়া এইরকম পাওয়া যায় --
“আমরা মিনিট পাঁচেক শুনতে না শুনতেই বুঝতে পেরেছিলাম, এতদিন পরে যে পরশমণিটি আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেটি পেয়ে গেছি।” ( স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিকথা, ইং, ভগিনী কৃস্টিন)
0 Comments