জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো। অন্তিমপর্ব // চিত্রা ভট্টাচার্য্য

নর্থ ক্যারোলীনার বাড়ি

কালের অতল তলে কলোরাডো।  অন্তিমপর্ব  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

শেষ রাতের গহীন কালো জঠর ভেদ করে ঝকঝকে এক সোনার কলস উপুড় হয়ে একরাশ তরল সোনা গড়িয়ে গিয়েছে সদ্য ঘুম ভাঙা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সীমানায়। খুশিতে চেয়ে দেখি   পূবদিকের কোণ ঘেঁষে কমলা রাঙা আধফোঁটা কমলাফুলি কোয়ার মত সদ্য উদিত সূর্যের এক অনিন্দ্য সুন্দর আত্মপ্রকাশ হতে চলেছে।
  সদ্য আলোর স্পর্শে নিউজার্সী এয়ারপোর্টের রানওয়ে তে কয়েক পাক চক্কর লাগিয়ে ধীরে ধীরে আকাশের মেঘে ভাসমান হলো ইউনাইটেড নেশানের স্পেশাল প্লেন টি। রুপালী ডানায় এক ঝলক রোদে ঝিলিক দিয়ে মেঘের গায়ে মুক্তির আনন্দে ডানা মেলে দিয়েছে আমার নতুন নামে ডাকা যান্ত্রিক বিহঙ্গ। কবে যেন সেই প্রথম দিন ,প্রায় কুড়ি বছর আগে যেদিন একাকী প্লেনে চড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল --মনে বিশাল ভয় দ্বিধা উৎকণ্ঠা নিয়ে সিট বেল্টের ফাঁসে নিজেকে জড়িয়ে, বেশ কৌতুক করে এই আকাশ যান টির নাম রেখেছিলাম ''যান্ত্ৰিক বিহঙ্গ''।

 প্লেনের জানলা দিয়ে মেঘের বিচিত্র খেয়ালী রূপের মাঝে অনায়াসে তার অবাধ গতি, বায়ু সমুদ্রে রূপালী ঝড় তুলে বৃহৎ ডানা মেলে আকাশে অবাধে সগর্জনে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যে আমার  কল্পনা প্রবন চির ভাবুক মন এই বিশাল বপুর আকাশ যান টির সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিল , রূপকথার  রাক্ষস রাজ্ রাবণের সীতা হরণের সাক্ষী পুষ্পক রথটির সাথে। আমি যেন এখন তারই সওয়ারী , তবে বন্দিনী নয় বন্দিমুক্ত হয়ে ফিরছি স্বদেশে।          
আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা।

  বদ্ধ প্লেনের ভেতরে যতক্ষন নির্বাক বসে ছিলাম যত ভয় দ্বিধা সংশয় আশঙ্কা দুর্ভাবনা এসে মনের প্রান্তে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। কর্মহীন স্থবিরের মত বসে থেকে মনে পড়ছিল একটানা চৌদ্দ ঘণ্টা বায়ু সমুদ্রে ভেসে দুরন্ত হাওয়ার বেগে পথ পরিক্রমার পর পৌঁছবো দেশে। মুম্বাইয়ের এর মাটি স্পর্শ করবে প্লেন টি  ,''ও আমার দেশের মাটি ! ''এইতো কয়েক দিন আগেও ভেবেছিলাম , আর এ জীবনে বোধহয় ঘরে ফেরা হবে না। আজ কিছুটা আশার আলোয় মনে বিশাল উত্তেজনা। প্রায় এগারো মাস পর দেশের ঘরে ফিরতে পারবো।  ভিটে মাটির টান যে কি সাংঘাতিক মর্মস্পর্শী , যাঁরা আমার মত ভুক্তভুগী তারাই জানেন। এর আগে ভারত সরকার প্রবাসে আটকে পরা যাত্রী দের স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পাঠিয়েছে ''বন্দেভারত'' প্লেন টি। তার  চলাচল ছিল সম্ভবতঃ সানফ্রান্সিস্কো থেকে দিল্লী। সেখানে কোনো টিকিট পাইনি। দুবারের চেষ্টায় ও তিল ঠাঁই নেই এদিকে ভিসার মেয়াদ মে মাসেই শেষ হয়ে গিয়েছে ,নতুন ভিসার আবেদন করে ডলার জমা দেওয়া সত্ত্বেও এখানের বিদেশ মন্ত্রকের অফিসে কোনো হেলদোল নেই।  পাসপোর্টের আয়ু ও প্রায় শেষের পথে। প্রচন্ড অস্থিরতায় একের পর এক দিন কাটে, রাত শেষ হয়ে সূর্য ওঠে। অবশেষে খবর এলো ইউএস গভর্মেন্টের উদ্যোগে  নিউজার্সী থেকে ইউনাইটেড নেশানের স্পেশাল প্লেন টি ছাড়ছে। কোথাও ব্রেক না নিয়ে সোজা ১৪ ঘন্টায় মুম্বাই পৌঁছবে। মুম্বাই আমার চিরচেনা , সেখানে যে আমার  ''শ্রী '' থাকে।   ওর কোয়ার্টারে চৌদ্দদিন আইসোলেশানে কাটিয়ে তারপর কলকাতা ফেরা । কিন্তু কন্যা আমার আগেই বায়না করে রেখেছে ,U.S থেকে সোজা আমার কাছে আসবে ,এ বছরের শেষ টা কাটিয়ে তারপর তোমরা নতুন বছরে কলকাতায় ফিরবে।   
🍂

                      প্লেনের গোল জানলায় সাঁটা কাঁচে মাথা রেখে এ যাত্রা পথের নেপথ্যের ঘটনার ঘনঘটা গুলো প্রথম থেকে একের পর এক  টিভির সিরিয়ালের মত মনের পাতায় ভেসে উঠছে। আকাশ পথে ইন্টারন্যাশানাল বা ডোমেস্টিক প্লেন গুলোর চলাচল মোটেই স্বাভাবিক হয়নি। ইন্টার ন্যাশানাল প্লেন গুলো এমার্জেন্সি তে সারাদিনে রানওয়ে দিয়ে কয়েকটা চললেও ডোমেস্টিক প্লেনের এয়ারপোর্টে এখনো বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে গভর্মেন্ট এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমাদের মত আটকে পড়া যাত্রীদের দেশে পাঠানোর উদ্যোগে যথেষ্ট সতর্কতা ও ঝুঁকি  নিয়ে প্লেন চালানোর অনুমতি  দিয়েছে। বিশাল প্লেন টির অন্দরে ঢুকে চোখে বিস্ময়ের ঘোর লেগে যায় ,সব সিট গুলোই ফাঁকা , প্রায় সাড়ে তিন'শর মত যাত্রী  আমরা সেখানে মাত্র তিরিশ জন। ভাবছি বন্দেভারতে যেখানে টিকিট পাওয়া গেল না সেখানে এই প্লেন কেন এত ফাঁকা। নেটসার্চ করে দেখি এই এয়ার ওয়েজের দাম বন্দেভারতের তুলনায় প্রায় অনেকটাই বেশী। যাইহোক ''ইকোনমিক্লাসে ''ও  ফাঁকা প্লেনের সীটে এবারে যাত্রা হবে কষ্ট করে বসে তো নয়ই ,শুয়ে ঘুমিয়ে। এমন মজার প্লেন জার্নীর অভিজ্ঞতা অবশ্যই আমার এ জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।  
হোটেল ম্যারিয়ট। নিউজার্সি এয়ারপোর্ট।
                                                        
 ডোমেস্টিক প্লেন নেই ,তাই  নিডলস্  আরিজোনা নিউমেক্সিকো ওক্লাহামা, টেক্সাস  ,আরকানসা ,টেনেসি হয়ে ক্রসকান্ট্রী করে উত্তরআমেরিকার পশ্চিমদিকের ক্যালিফোর্ণিয়া ছেড়ে ব্রতীন অতনুর পিকআপ ট্রাক ট্যাকোমা আবার  চলেছে লংড্রাইভে। অবশেষে -পৌঁছেছিলাম পূর্ব প্রান্তের নর্থক্যারোলিনায়। এবং বেশ কয়েকদিন হয়ে গিয়েছে এখানে থাকছি। অনেক পুরোনো পরিচিত বন্ধু অটম ,ন্যান্সি , বরিস ,ক্রিশ ,বব তো এখানের বাসিন্দা। ,মিষ্টার গ্যারি সাহেব ও তার একান্ত আপন চির সবুজে ভরা শ্যামল উপত্যকায় এসেছে। এই  বাড়িতে আমি আগের বার এসেছিলাম।  জোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে সবুজে নীলে একাকার দেখে ,ভালবেসে এ বাড়ির নাম রেখেছিলাম "নীলনির্জনে"। ক্রিশ বলেছিল এমন ঢালাও ক্লাসিক সবুজ তুমি আমেরিকার আর কোথাও পাবে না। ওকে প্রায়ই কত সময় দেখেছি  প্রকৃতির সেই কবির মত ঘাসের ওপর শুয়ে মাটিতে কান পেতে থাকতে।  ও বলে ছিল ,নর্থক্যারোলিনা থেকে নিউজার্সী মাত্র দশ ঘন্টার ড্রাইভ। আর নিউজার্সী থেকেই মুম্বাই ডাইরেক্ট প্লেন মাত্র চৌদ্দ ঘন্টা।নো টেনশন আন্টি। তোমরা একদম ঠিক মত ঘরে পৌঁছোবেই। ক্রিশ  ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। লকডাউনে প্রায় দশ মাস প্লেন গুলোকে সার সার এয়ারপোর্টে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর খারাপ লাগায় বুক ফেঁটে চোখে জল আসে। নিশীদিন শুধু মনে পড়ে প্রাণহীন বিশাল কায়ার যান্ত্রিক দানব গুলোর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য।                                                                                              স্তব্ধ নীলাকাশের বুক চিরে বন পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে প্লেনের চাকা দুরন্ত গতিতে চোখের পলকে আজ আর দেশান্তরী হয়না। ক্রিশের থেকেই শুনেছি ,এয়ারপোর্টে যারা পার্মানেন্ট নয় ঠিকে কাজ করে তারা সব বেকার হয়ে গিয়েছে। গ্যারিসাহেব বলেন এই দুর্দিনে আমাদের  সবচেয়ে বড়ো অভাব কাজের ,মূলতঃ আমি ট্রাক চালাই ,আমার স্ত্রী ডরোথী গভীর সমুদ্রে ট্রলার ভাসিয়ে মাছ ধরতে যেতো। এই অনির্দিষ্ট কালের  লকডাউনে দুইই বন্ধ হওয়ায় আমরা এই ধনী শহরে জবলেস হয়ে দিন আনা দিন খাওয়া পাবলিক হয়ে গিয়েছি। সংসারের  আয় বেশ কিছুদিন নেই বললেই চলে। সরকার থেকে মাথা পিছু ১৮০০ ডলার করে পেয়েছি ,তাই অভাব তেমন কাবু করেনি । তাছাড়া হস্পিটালে ট্রিটমেন্ট পেতেও কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে এখানেও প্রচুর হাঘরে, জবলেস মানুষ আছে। সেই যে তোমরা  লাসভেগাসের আন্ডার গ্রাউন্ডের বস্তি দেখেছিলে ,সেখানে গায়ে গায়ে লাগানো মানুষ গুলোর তেমন প্রটেকশন নেই ,শুনেছি ওরা বিরাট সংখ্যায় অসুস্থ হয়েছে ,মারা ও গিয়েছে। পৃথিবীর চতুর্দিকে লাগাম ছাড়া মৃত্যুর খবরে হাঘরে দের বাঁচাবে কে ? মিষ্টার গ্যারী বলেন মানুষ এই সুন্দর পৃথিবীতে নিজের মত করে বাঁচার জন্য এক স্বপ্নের জগৎ গড়ে তোলে। সবার সব স্বপ্ন সফল হওয়ার আগেই ওপারের ডাক এসে যায় স্বপ্ন সফল হয় না। এই যেমন দেখো না ,ডরোথীর ভারী ইচ্ছে ছিল শেষ বারের মত প্রশান্তর ফিরোজা রঙের জলের ঢেউয়ে দুলে মাঝ সাগরে ট্রলার ভাসিয়ে মাছ ধরতে যাবে। হলো না তো ! ,স্বপ্ন যে অধুরাই রয়ে গেল ।    

মিঃগ্যারীর কথা শেষ হয় না।-- ''কোভিড আক্রান্ত হয়ে ডরোথী ঘরে ফিরে এলে ভেবেছিলাম এ যাত্রায় ও বেঁচে গেলো। কিন্তু  ওর কিডনী ডিজিজ তো মারাত্মক বেড়ে যায় লাষ্ট সেপ্টেম্বারে আবার হস্পিটালাইজড হয়। এবারে ডায়ালিসিস চলা কালীন মাল্টিওর্গান ফেলিওর হলে আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যায়। ওকে ছাড়া বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ফেলেছি। জীবন বোধহয় এমনি। ব্রতীন বলেছিল '',গ্যারী সাহেব নর্থ ক্যারোলীনায় এসেছেন এখানে ডরোথীর সাধের একটা মাছ ধরার নৌকা এবং ছোট্টো একটি প্রপার্টি বিক্রি করে দিতে।'' আমি যদিও আগেই পারভীনের কাছে  শুনেছি ডরোথী নেই। তবু চুপ করে থাকি মৃত্যু শোকে সান্ত্বনা বা সহানুভূতি জানানোর মত মানসিক অবস্থা আমার একেবারেই নেই। বায়ু সমুদ্রে ভেসে চলেছি অনেক লম্বা পথ দিনের উজ্জ্বল আলোয় শুধু মেঘের অপরূপ কারুকার্য্য দেখছি আর ভাবছি ডরোথী ,রীয়ম ,পরাগ ও আমার চেনা জানা আরো অনেকে যাঁরা অসময়ে চলে গেল ''ধরণীর ঐ  বেদনা নিবিড় গভীর অন্ধকারে,'' তাঁরা  অত সুন্দর মেঘের মীনারের ইন্দ্রজাল থেকে  বেরিয়ে এসে বলবে আরে অত  ভাবছো কেন ? এই দেখ , আমি তো এখানে জ্বরা ব্যাধি রোগ শোক জ্বালা যন্ত্রণা সব জয় করে নীলাম্বরে চিত্ত সুখে রয়েছি। নিজের অজান্তেই  মন একমনে গুনগুনিয়ে  ওঠে ,                                                                                         
               '' আমার সুর গুলি পায় চরণ                                                                                              আমি পাই নে তোমারে।/                                                                                                                            বাতাস বলে মরি মরি /আর বেঁধে রেখোনা তরী। /                                                                                      এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয় মাঝারে''।                                                                                                                            মাঝে মাঝেই মন টা ডুকরে ওঠে। হয়তো বাড়ি ফিরে আরো কত অসীম শূন্যতা--দেখবো আরো কত হারিয়ে যাওয়া ,কত  নেইয়ের পালা। রোজ রোজ কত খবর পেয়েছি আমার দেশের ,সেখানে মৃত্যু নিয়ে চলেছে কালোবাজারী ,চিকিৎসা নিয়ে চলেছে মুনাফা লোটার ধান্দা , ডেডবডি সৎকারে ও চলেছে মনুষ্যত্বের অমানবিক পরিচয়। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শাসন যন্ত্রের দাদাগিরিতে সাধারণ মানুষ গুলোর অবস্থা যেন বলির পাঁঠার মত। এদেশে ও কি এমন টা হয় ? না এমন হৃদয় বিদারক , লাজ লজ্জাহীন অসভ্যতার খবর এখনও তেমন শুনিনি।     
              সবুজে সবুজ নর্থক্যারলীনা
                                                              
গতকাল  সাত সকালে রওনা হয়েছিলাম নর্থক্যারোলীনা থেকে।  প্রায় দশ ঘন্টা ড্রাইভ সে ও এক অন্য গল্প। অনবদ্য অভিজ্ঞতা। অনেক দিন পরে আবার কখনো পুরোনো ডায়েরির পাতা উল্টে সে কাহিনী কে মনের অনুরাগে সাজিয়ে তুলবো।  কিন্তু এই কলোরাডোর এই ভ্রমণ পর্বে গল্পের ঝুড়ি ভরা থাক আমার ইয়ং বাহিনীর স্মৃতি সুধায়।

নিউজার্সীর সুসজ্জিত এয়ারপোর্ট হোটেল ম্যারিয়ট এ এসে যখন পৌঁছলাম আকাশ কালো করে বৃষ্টি ঝুপঝুপ করে নামলো। খুব ঠান্ডা তবে পার্কিং লটে শেড থাকায় একটু ও ভিজতে হয়নি। এত বড়ো হোটেল টি তে যাত্রী সংখ্যা মুষ্টিমেয়। কোনো হৈচৈ বা ব্যস্ততা বিন্দুমাত্র নেই। আমার চরৈবেতি মনে তখন বেড়ানোর আনন্দ নেই কী এক ভয় দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে মনের সব সুখ কেড়ে নিয়ে অজস্র বেড়াজালে আটকে দিয়েছে। আজ ইয়ম ,পারভীন নেই ব্রতীনের সাথে অতনু এসেছিল সী অফ করতে। তবু সেবার হ্যারি সাহেব --গ্র্যান্ডপা ' র নিমন্ত্রণে সবাই একত্রিত হয়েছিলাম।                                                                              
কিন্তু ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে আসার দু দিন আগের বিকেল টিকে ভোলা যায় না।  এই নির্বান্ধব জনহীন লস্গাটসের বাড়িটি  জন সমাগমের আনন্দে হৈ চৈ হাঁক ডাকে ভরপুর হয়ে রইলো। সবাই মুখে মাক্স পড়ে দূরত্ব বজায় রেখেই একসাথে হয়েছি লাম  এবং প্রথম ডোজের টিকা ও নেওয়া হয়েছে। ছেলেরা লম্বা কাঠের ডেকে জুড়ে বিরাট এক টেবিল পেতেছে অন্তত দশ বারো জন যাতে অনায়াসে একসাথে বসতে পারে। আমাদের সাথে সেদিন ইয়াম পারভীন রাবেয়া ছিল।   জ্যাকব ও মুনিয়া  রিমো এবং ,টিউলিপ কে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।  আমাকে চমকে দিয়ে ব্রতীন দের  দুই বন্ধু ডন ,ও কৃষ্ণরাজ্ এলো। --ডন যদিও চাইনিজ কৃষ্ণরাজ্  নর্থ ইন্ডিয়ান। এখানে  ইয়ং গ্রূপের সব ছেলে মেয়েদের , প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের এমন আত্মিক যোগ ,বন্ধুত্বের বন্ধন দেখে আনন্দিত হই । যেন ওরা সবাই মিলে মিশে এক যৌথ পরিবার। আমাদের দেশে ফেরার আগে এই গেটটুগেদারে  সন্ধ্যের দিকে হৈ হৈ রবে নির্জন পাহাড় মাতিয়ে পুরোনো জাম্বোরী ডেভিডসন মোটর বাইকটি তে সাঙ্ঘাতিক গর্জন তুলে সিড কে নিয়ে  বাড়ির ড্রাইভ ওয়ে কাঁপিয়ে হ্যারি সাহেব ও এলেন।  সেদিন  সবাই কে এই ভাবে পাশে পাবো ভাবিনি।  

         হ্যারি সাহেব অট্টহাসি হাসেন -- ''কেমন চমকে দিলুম বলো ! আমার বুড়ো হাড়ে এখনো কত জোর , এই পাহাড়ি রাস্তায় এমন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সাহস করে আমার থেকে ভারী ওজনদার বাইক চালিয়ে কেমন চলে এসেছি--- শুধু কন্যে ,তোমার সাথে দেখা করতে। হয়তো এ জীবনে এই শেষ  আড্ডা মারতে এসেছি  ''।  হ্যারি দাদুর আদরের  Grand son সিড ও ততোধিক উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলে ''আমি বুঝি কিছু নয় ?  আমিই রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে এলাম এই তস্য বুড়ো Old grand pa কে।   দাদু নাতির খুনসুটি ,--এমন ঝগড়ার সাথে আমরা বেশ পরিচিত। খুব  জমে উঠেছে ,হয়তো এক কালে ভারতীয় ছিল বলে এখোনো সেই সম্পর্কের ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।  বেশ উপভোগ করছি। হ্যারিসাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে সদ্য যুবক নাতি কে বলে তুই বেটা বুড়ো ! তোর বাপ্ বুড়ো ---বেশ  মজা করে বলেন --never mind ! I am more  young than my grand son Sid !  তাই নয় কি বলো তোমরা?  পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলি  , Oh ,sure-- you are absolutely correct ..এবারে নিজের কাঁধে জোরে এক ঝাঁকুনি  দিয়ে বলেন ,আমার এই ফাজিল বুদ্ধু নাতি টির কথা একদম  বিশ্বাস করবে না। কন্যে তোমার চলে যাবার খবর আগেই পেয়েছিলাম তাইতো ভাবছিলাম আসবো। তবে কোভিডের টিকা নেওয়াতে মনে দারুণ বল পেয়েছি।                                                                      
 এই বৃদ্ধ মানুষ টির স্নেহ প্রবণ বাৎসল্য ভালবাসায় ভরা হৃদয় আমার মনের কোণে উজ্জ্বল আসন  পেতে অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদেশে এমন একটি মানুষ যে একালে ভারী বিরল সম্পদ। রাবেয়া এখন হ্যারি গ্র্যান্ডপার মন্তেরে সাগর উপকূলের রিসোর্টের কীচেনের দায়িত্বে থাকায় পারভীন মায়ের জন্য বেশ চিন্তামুক্ত। রাবেয়াকে আর লেক টা হোর গ্রামে একাকী পড়ে থাকতে হবে না। মুনিয়ার লাসভেগা সের মুন লাইট রেস্তোরাঁ কোভিড চক্রে বন্ধ থাকায় --  ও আর পারভীন রেডক্রস সোসাইটির মেম্বার হয়ে গভর্মেন্টের এক স্বেচ্ছাসেবীসংস্থা  OVER COME এর সাথে নিজেদের নিযুক্ত করে আর্তের সেবায়  আত্মনিয়োগ করেছে। যেখানে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রুগী দের সেবা করা হয় এবং স্বজন হারানো অসহায় অরফ্যান শিশুদের প্রতিপালন করা হয়। রিমো টিউলিপ কে নিয়ে জ্যাকব  মহা আনন্দে  Blue sky  অনাথ আশ্রমে বাচ্চাদের দেখভালের দায়িত্বে সময় কাটায়। 

 হৈ হৈ আড্ডা গল্প ও যথারীতি জমে গিয়েছে।হ্যারি সাহেব ও কালো কড়া কফির মগ হাতে নিয়ে চুরুট ধরিয়ে বুড়ো রেড উড গাছের তলায় আমার ডেক চেয়ার টা দখল করে বসলেন। কাঠ কয়লার আঁচের  মাঝখানে এক উঁচু মত চুল্লি জ্বলছে। তার মুখের ওপর  জালির ফাঁক দিয়ে টকটকে লাল আগুনের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সবাই বেশ উষ্ণ আরামের স্পর্শ পাচ্ছি। সান্ধ্য আড্ডায় আমরা সব যে যার চেয়ার গুছিয়ে নিয়ে ছোটো থেকে বড়ো গোল হয়ে বসেছি। আর এক পাশে বারবিকিউয়ে চিকেন স্টিক ঝলসানো চলছে। আবার চিকেন পকোড়া আলুটিকিয়া ডিমের ডেভিলের সাথে কফি চুরুটের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে।  রিমো টিউলিপ ওদের পোষ্য তোজো কে নিয়ে জোরদার খেলায় মেতেছে।   অতনু ফায়ার প্লেসে মোটা দেখে লম্বা একটা কাঠ গুঁজে দিলে টকটকে লাল আগুন -- দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে ঘরের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিলো। নানা দেশের নানা গল্পে আড্ডায় একটু ও বিরতি পড়ে না বরং চলতেই থাকে। তারপর একসময় রাত বাড়তে থাকলে ডিনার টেবিল সাজাই মুরগীর ঝোল ,সরু চালের সাদা ভাত,ফ্রায়েড রাইস মাহী মাহী মাছের কালিয়া ও  চিংড়ির মালাইকারী  পালক পনির , মিক্সড ভেজিটেবিল ,চানা মশলা তার সাথে নানারকম ডেজার্ট।  যার যা খুশি পছন্দ দিয়ে জমিয়ে ভোজন পর্ব  চলতে থাকে। ঠান্ডা টা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে , বাতাসে ও বৃষ্টির গন্ধ ভেসে আসছে ,গানে গল্পে খাওয়া দাওয়ায় দারুণ আনন্দে রাত শেষ হলো। 
অবশেষে মুম্বাই। পাওয়াইলেক

নতুন দিনের আলোর পরশে বন পাহাড় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তখন সবে মাত্র সকাল আটটা হবে। পাভলোর গাড়ি এসে থামলো আমাদের ক্যাম্পাসে। ওরা কাল এসেছিল সান্হোসেতে  আজ এসেছে আমাদের সাথে দেখা করতে। রুনীর কোলে তিনমাসের এক অপরূপ সুন্দর ফুটফুটে শিশু টানা টানা চোখ দুটো নীল পদ্মের মত ওদের পুত্র Ocean ...আমরা সবাই মহা উল্লাসে ,মহা আনন্দে ওদের স্বাগত জানাই। ইয়ামের চোখ আনন্দাশ্রুর জলে ভাসছে।   শিশু টিকে আমার কোলে নিয়ে কবি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন গুলো ঠোঁটের গোড়ায় চলে এলো---আমার কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে উঠলো।                                      ''          ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর ? প্রলয় নূতন সৃজন বেদন !                                                                              আসছে নবীন --জীবনহারা অ - সুন্দরে করতে ছেদন!''--- 
রোজকার নিয়মে বাঁধা সংসারের গ্রন্থি থেকে মন এতক্ষন শুধুই অসীম শূন্যের গতি পথে  ছুটে চলেছিল --ফেলে আসা সাগর পাড়ের স্মৃতিতে মগ্ন  হয়ে ভাবনার অতল তলে ডুবে গিয়েছিলাম। এবারে কখন উঁচুর থেকে দেখতে পেলাম মুম্বাই শহরের উঁচু উঁচু অট্টলিকা গুলো ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে ,যেমন দেখতে পাচ্ছি আরব সাগরের জলে ঢেউয়ের দোলা লেগেছে।  ধীরে ধীরে প্লেন টি মুম্বাইয়ের মাটির সীমানা ছুঁয়ে রানওয়েতে ছুটতে শুরু করে নির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।  মেঘের রাজত্বে এক ঘেঁয়ে পথ বেয়ে একটানা বায়ু সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর পর ভূ খণ্ডের স্থলভাগের ওপর পা ফেলে ভারী শান্তি পেলাম। একাকী নীরবে ডাঙায় ঘুরে বেড়ানো একান্ত স্থলচর  প্রাণী টির আর কতক্ষণ ভালোলাগে একটানা বসে থেকে বায়ু সমুদ্রে শূন্যে ভাসতে ? এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেটে এসে দেখি শ্রী একগাল হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গেট পার হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার আশায়।                                                         সমাপ্ত।

Post a Comment

1 Comments

  1. বাঃ, খুব সুন্দর

    ReplyDelete