জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি -১/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

বার্লিন শহর।

বার্লিনের ডায়েরি -১
চিত্রা ভট্টাচার্য্য   

ছুটির নিমন্ত্রণে 

  আকাশ কালো করে ছায়া ঘনিয়ে আসে, উথাল পাথাল  শ্রাবণের ধারায় বৃষ্টি ভেজা দুপুর গুলো বড্ড মন উদাস করে। শ্রীময়ী র একাকী শূন্য ঘরে সারাদিন শুধু ঝরঝরে বৃষ্টির সাথে মধুর মিতালি। ওর একাকীত্বের সঙ্গী শুধুই দূর আকাশের উড়ো মেঘেরা। অহর্নিশি রোদ বৃষ্টিতে ভেজা নিঃসঙ্গ গাছ গুলো, মেঘাছন্ন দিন গুলোর মত রাশিরাশি চিন্তার ঢেউ  দুকূল ভাঙা নদীর মত উথালিপাথালি আছড়ে পরে। ঝোড়ো বৃষ্টিতে , একটানা জানলায় বসে বৃষ্টির ছাঁটে  ভিজে ওঠে চোখের পাতা। উড়ো চুল গুলোর সাথে ভিজে যায় আটপৌরে শাড়ির আঁচল। বহু দূরের সাগর পাড়ের অজানা মহাদেশের প্রান্তে ছাই রঙা পাহাড়ে ঘেরা ব্যস্ততম অচেনা এক শহরে স্বপ্ননীল চোখে একাকী পথ চলা অদ্রিজার জন্য ভাবনা গুলো মনের ব্যাকুলতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।দমকা বাতাসে খোলা ডায়েরির পাতা এলোমেলো উড়তে থাকে। মন হারিয়ে যায় স্মৃতির গহীন মেঘের পারাবারে। 

 ল্যাপটপ খুলে বেশ কয়েক দিনপর শ্রীময়ী মেলবক্স চেক করতেই অদ্রিজার অভিমানে ভরা পর পর মেল-গুলো প্রায় একই ভাষায় কাতর অনুনয় 'মা' গো  ,''বলো কবে আসবে ?আমি কি out of sight out of mind '' হয়ে গেলাম "। তোমাদের আসার আশায় পথ চেয়ে আছি। দিন ফুরিয়ে রাত আসে ,বছর ও ঘুরে যায় যে?    একাকী ভালো লাগে না।  এবার আর কোনো অজুহাত , শুনবো না , টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছি।  বোঝোনা কেন? মনের ও একটা আকাশ আছে  আমার স্বপ্নের ঘুড়ি চাঁদিয়াল, চৌরঙ্গীরা সেখানেই বাঁচে।
  উফঃ বাবারে! অভিযোগ অনুযোগের শেষ নেই। সংসারের বেড়াজালে অসংখ্য কাজের ব্যস্ততা থাকলে ও শ্রীময়ীর ক্লান্ত মাতৃ হৃদয়ে প্রবাসী কন্যার জন্য অব্যক্ত বেদনার হাহাকার চারদেওয়ালের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে বদ্ধ হাওয়ায় হাঁপিয়ে ওঠে। মার মন দূর্বল হলে মেয়ের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন বালির দুর্গের মত ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। সংসারের অনেক না পাওয়া গুলো কে মেনে নিয়ে হাসি মুখে চলতে তিতির জানে, ওর মা কত টা  অভ্যস্থ ।    
আজকাল অদ্রিজার ঘরের কোণের আলমারীর তে রাখা এলোমেলো জামা কাপড় গুছিয়ে  ,পড়ার টেবিল বইয়ের তাকের ধুলো ঝেড়ে , শো কেসে সাজানো পুতুল গুলো নতুন করে সাজিয়ে নানা রঙের টেডিবিয়ার  গুলোর নরম তুলতুলে গায়ে আনমনে হাত বুলিয়ে সময় চলে আপন গতিতে। প্রায় আড়াই বছর টানা অদ্রিজা বার্লিনে , স্কাইপে রোজ দেখা ,কথা হওয়া নিত্যকার রুটিন হয়ে যাওয়াতে শ্রীময়ী ভাবে তবুতো দেখছি ,দুধের স্বাদ না হয় ঘোলেই মিটছে।
 গল্প চলে জার্মানির ষোলোটি রাজ্য দ্বারা বেষ্টিত ব্রান্ডেনবার্গের ও তার রাজধানী ইতিহাসের নগরী পটসডামের। ল্যাপটপের পাতায় ভেসে ওঠে ঐতিহাসিক বার্লিনওয়াল ,বার্লিন গেট আরো কত দেখার জায়গা। শীত আসার আগে শিশিরে ভেজা পাহাড়ি মাটির গন্ধ ওঠে,প্রকৃতির বুকে যেন ছড়িয়ে থাকে  নিবিড় আশ্রয়ের আশ্বাস। শহরের হাই ওয়ের ধারেই  সবুজে ভরা কনিফারের ক্ষেতে সদ্য মাথা ঝাড়া দিয়ে বেড়ে ওঠা চারা গাছ গুলো হাওয়ায় দোলে। আঙ্গুরের ক্ষেতে লতা গুলো ভরে ওঠে মিষ্টি ফলের  সুবাসে। অনেকটা সময় ধরে স্নেহ মায়া মমতার মত অনুভব করা যায় প্রকৃতির কত মায়াময় রূপ।গল্প শোনে, শীতের তুষার পাতে সাদা চাদরে ঢেকে যাওয়া রাস্তা গুলোর। মেঘলা আকাশ ,স্বচ্ছ নীল জলে ভরা স্রোতস্বিনী স্প্রীনদীর। শান্ত স্নিগ্ধতায় ভরা শহুরে জীবন দূরের নীল পাহাড়ের পায়ের তলে সবুজের ছোঁয়া লাগা মাঠ প্রান্তর কৃত্রিম বন উপবন দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে মায়ার বাঁধনে। বিদেশে ছুটির দিনের একাকী মুহূর্ত গুলো অদ্রিজার মন খারাপ লাগে বাড়ির জন্য , দুশ্চিন্তা গুলো যখন ঘুণ পোকার মত কানের কাছে ধুন বাজায়  ।
বার্লিন। স্বচ্ছ জলের লেক

   আকাশ ভরা নির্মল হাসির ছোঁয়ায় ,গনগনে কড়া  রোদের ঝলকানিতে নির্জন ভাদুরে দুপুরের ছাতে মাদুর পেতে ড্যাম্প লাগা পুরোনো বইয়ের বাক্স উপুড় করে দিয়ে ক্ষণিকের অবসরে বই পত্র উল্টে পাল্টে দেওয়ার ঠিক আধা ঘন্টাও হয়নি , কালো মেঘ নিমেষে চারপাশ ঢেকে দেওয়ায় তড়িঘড়ি চিলেকোঠার ঘরে বইগুলো রাখতে গিয়ে মলাটের বাঁধন আলগা হয়ে শ্রীময়ী র হাতে উঠে এলো ২০১৫ র লেখা বার্লিনের ডায়েরি। প্রতিদিনের খুঁটিনাটির বিবরণ অনেক সময় ডায়েরি না জুটলেও সাদা খাতার পাতায় তারিখ বসিয়ে লিখে রাখা ওর  ছোটবেলার অভ্যাস। ওর জীবনের নানা ওঠা পড়ায়,অন্তহীন টালমাটাল পথ পরিক্রমায় এক দিনের তরে ও  ভুল হয়নি সে কাজের। দিনের পর দিন মাসের পর মাস , সংসারের বারোমাস্যা --দিবা রাত্রির কাব্য গাঁথা ওর একান্ত আপন ডায়েরি। অদ্রিজার সাথে কাটানো বার্লিনের দিনগুলো, সেই পুরোনো স্মৃতি যা বয়সের ভারে মনের মনিকোঠা থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল। ডায়েরির পাতা উল্টে দেখে অবাক হয়ে যায়। স্মরণের আবরণে মন তাকে যত্নে ঢেকে রেখে দিয়েছে কালো কালির আঁচড়ে। আজ জীবন সায়াহ্নে লেখা লেখা খেলার  নেশায় মেতে  সেই মধুর দিনের স্মৃতিরা ভীড় জমিয়েছে গল্পের ঝুলিতে। আর খেয়ালী মন মেতেছে তাকে সাত রঙের আড়ম্বরে গুছিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ এক মালা গাঁথার ছন্দে। ভাবছে আট বছর আগের সেই বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবে নতুন ভ্রমণ উপন্যাস ''বার্লিনের ডায়েরি ''।

          ঋষভের ট্রান্সফারের চাকরিতে যেখানে সেখানে জীবনের বহু মূল্যবান সময় চড়কির মত শ্রীময়ী কে সংসার নিয়ে ঘুরতে হয়েছে।  আজ ঋষভের রিটায়ারের পর বাড়িতে স্থিতু হয়ে বসায় সামান্য তম ও ইচ্ছে করে না নিজের জায়গা ছেড়ে বিদেশ বিভুঁই এ বিশেষ করে সাগর পাড়ের ডাকে ,অন্য কোথাও অন্যকোনো দূর দেশে ভ্রমণের সওয়ারী হয়ে আবার পাড়ি জমাতে। দেশের মধ্যে দশ বারো দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া তবুও চলতে পারে। কিন্তু বিদেশ পাড়ি ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। ওর অবসর প্রাপ্ত এমন ছুটির দিন গুলোয় নিভৃত গৃহ কোণ টি বড়োই সুখের। পাসপোর্ট ,ভিসা টিকিট ,ডলার এক্সচেঞ্জ সিকিউরিটি চেক বোর্ডিং পাস ইমিগ্রেশন ইত্যাদির সাথে বিদেশের বরফ পড়া আবহাওয়ার কথা চিন্তায় এলেই শরীর ও মন দুই ই অবশ হয়ে যায়। পাসপোর্টের ভাবনা নেই ,সে তো সেই পাঁচ বছর আগেই ইউ.এস যাবার সময় থেকে হয়ে আছে। তবে জার্মানীতে যাওয়ার জন্য জরুরি ভিসার এপ্লাই করা। তার আবার কত রকম বায়নাক্কা।   
  তিতিরের আকুতি অগ্রাহ্য করে কান চাপা দিয়ে থাকলেও   কোনো তারায় ভরা রাতে অথবা জোৎস্না ভেজা আকাশ তলে যখন ছাতের ওপর আপন মনে একাকী পায়চারি করে ,দূর থেকে কে যেন ইশারায় ডাক দিয়ে যায়। রাতের নীরবতা ভেদ করে প্লেন গুলো যখন স্বগর্বে মাথার ওপর দিয়ে আকাশের গায়ে দাগ ফেলে শূন্য থেকে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়,ওর কঠিন মন তখন গভীর প্রত্যাশায় গ্লোবের ওপর অন্য মহাদেশের অবস্থান টি খুঁজে বেড়ায়। আত্মজাকে কাছে না পাওয়ার ব্যথাতুর মন হারায় এক অচীন পুরের অজানা রাজধানীতে ।  
🍂
           সকাল সাত টা পাঁচে বর্ধমান লোকাল -- মানকুন্ডুর প্ল্যাটফর্মে ভোরের কুয়াশা  কাটিয়ে ঢিকি ঢিকি করে ঢুকতেই পুরোনো অভ্যাস মত লেডিস কামড়ার জানলার ধারের সীটে শ্রীময়ী নিশ্চিন্তে গুছিয়ে বসলো। আসলে তিতিরের বহু দিনের পুরোনো এক অসমাপ্ত গুরুত্ব পূর্ণ কাজ এখনো বাকী রয়ে গিয়েছে। সেদিন ঝোড়ো হাওয়ায় পুরোনো ডায়েরির পাতা মনে করিয়ে দিলো  ভারতবর্ষ ছেড়ে জার্মানীর রাজধানী বার্লিনের উদ্দেশ্যে পোষ্টডকে যাবার আগে অদ্রিজার নিজের সংগৃহিত পোষ্ট গ্রাজুয়েট ক্লাসের পদার্থ বিদ্যার ও কোয়ান্টম থিওরীর মূল্যবান বই গুলো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরী তে প্রফেসর দিব্যেন্দু বোসের হাতে তুলে দিলে বই গুলো জমা হতো  বুক ব্যাঙ্কে। বিদেশ যাবার ঠিক আগে নানা কাজের চাপে তিতিরের সময় না হওয়ায় শ্রীময়ী সাগ্রহে দায়িত্ব নিয়েও বই গুলো পৌঁছে দিতে পারে নি।হয়নি প্রায় দুই ঘন্টা ট্রেন জার্নীর পর ইউনিভার্সিটি তে যাবার। সে সময় শ্রীময়ী সাগ্রহে নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিল বই গুলো পৌঁছে দেবার।নিজেকে বড়ো অপরাধী লাগছে যতক্ষণ না বই গুলো যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারছে। বছর ঘুরে গেছে কবে ,বই পৌঁছয় নি লাইব্রেরীতে। আজ অনেক দিন পর প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ হওয়ায় শ্রীময়ী  চলেছে ''কথা দেওয়ার কথা রাখতে '' সোজা ইউনিভার্সিটির  লাইব্রেরী হলে। 
                                                                                        চলার পথের ছোট্ট ছোট্ট দৃশ্য গুলোয় মন হারায়। সেই পুরোনো দিনের মত দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ময় শ্যামল সবুজ দূর্বাদল, বন বাদার পার হয়ে ট্রেন ছুটছে। জনপদ বধু দের পুকুরের পানায় ভরা শ্যাওলা রাঙা জলে টুপ করে ডুব দিয়ে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ের ওপর লাল গামছা জড়ানো গায়ে ,কলস কাঁখে গল্প করে মিষ্টি হাসিতে  দল বেঁধে ঘরে ফেরা। অঘ্রাণের শুরুই হয় নি , তবু ও সকাল বেলায় হেমন্তের শিশির ভেজা হাওয়ায় চমক লাগে।  তবুও দূর থেকে দুরন্ত গতির ঝিকঝিক শব্দের সাথে হাওয়ায় ভেসে আসে একরাশ ঘুম পাড়ানি ঠান্ডা। গ্রামের পর গ্রাম নিমেষে পার হয়ে যায়। দিগন্ত বিসতৃত শুকিয়ে যাওয়া বিবর্ণ কাশফুলের মেলায় বিজয়ার বিদায়ী বাঁশির করুণ সুরের মূর্ছনা জাগে।অঘ্রাণ পৌষের ক্ষেতের সতেজ সবুজ সরলতায় কাঁপন ওঠে। উর্বরা ধানের জমি গুলোর মাথা নাড়ার দোলানি তে কত আশ্বাস ,কত সম্ভাবনা কত আশার আলোয় ভরা ভাবী কালের সোনালী ফসলের ইঙ্গিত। সবুজের মাথা ছুঁয়ে হলুদ প্রজাপতির গুঞ্জন ধানের ক্ষেতে সাড়া জাগায়। আলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তাল তমালের ডালে সার বেঁধে বাবুই নিশ্চিন্তে ঠোঁট দিয়ে পাতা সেলাই করে কি সুনিপূণতায় উল্টো কুঁজোর মত ঘর বেঁধে চলেছে।
স্প্রি নদী

সবার জীবনে ছকে বাঁধা অপরিসীম ব্যস্ততা। রেল লাইনের ফেন্সিংয়ে কাঁটা তারের বেড়ায় বেগনে রঙ্গের উজ্জ্বল বুনো আইভি লতায়  ভরে আছে। আঁশশেওড়া ঝোঁপের জঙ্গলে মৌটুসির নাচ ,গাংশালিক আর গাঢ়  শ্যাওলা রাঙা খুঁদে টুনটুনির কিচির মিচির,ঝগড়া দেখতে দেখতে পালসিট পার হয়ে বর্ধমান জংশন এসে গেল ।  চারদিকের নীরবতা ভেঙে ব্যস্ততা। এবারে পাবলিক বাসে সোজা ইউনিভার্সিটি। সেবারে মহারাষ্ট্রের থাকার সময় ঋষভ চিনিয়েছিল সেগুনের ফুল কেমন হয়। শ্ৰীময়ী অবাক হয়েছিল সেগুন গাছে ও ফুল!  এখানে ও ঠিক তেমনি পথের পাশে সারি  দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেগুনের মাথায় আজো  থোকা থোকা সাদা ফুলের রাশিতে  ভরে আছে । শিরিষ যেমন ভরে আছে সবুজ পাতার মাঝে ঝিরিঝিরি দুধেআলতা রঙা পাঁপড়ির ফুলের বাহারে। গোলাপ বাগের রাস্তা জুড়ে ছাতিম তলে শুকনো পাতার পাহাড় আজো ঠিক তেমনই  জমে আছে।                                                                                                                                       ক্রমশঃ 
  

Post a Comment

0 Comments