জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৩ /সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —২৩
সুমিত্রা ঘোষ

যাক পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। রানির যখন ৫৪ বৎসর বয়স তখন তিনি ঠিক করলেন কাশীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর দর্শন করবেন। তখনকার দিনে মহিলাদের কাশী যাওয়ার প্রবণতা বর্তমান কালের তুলনায় একটু বেশিই ছিল। সাধারণ লোকের কথা বাদ দিয়ে বলা যায় ধর্মভাবাপন্ন মানুষেরা সুযোগ পেলে তীর্থ দর্শনে বেড়িয়ে পড়তেন। স্বামী বিবেকানন্দ, ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদাও অনেক তীর্থ ভ্রমণ করেছেন। ঠাকুরের উদ্দেশ্য ছিল তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে নারায়ণ বেশী দরিদ্র মানুষের সেবা করা। এ ব্যাপারে তিনি যখন সেজবাবু মথুরামোহন বিশ্বাসের সঙ্গে তীর্থ ভ্রমণে যেতেন তখন মথুরকে বলে মনের অভিলাষ চরিতার্থ করেছেন। রানি রাসমণিও এমন চরিত্রের ছিলেন। রানি কাশী যাবার মনস্থ করলে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা মায়ের সঙ্গী হতে চায়। রানির চার মেয়ের মধ্যে এই কন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্যান্য মেয়েদের থেকে আলাদা ছিল। জগদম্বা বাড়ির গুরুজনদের অমতে মেমদের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। গুরুজনদের অমত বলতে তাঁর ঠাকুমা, ঠাকুমার মা প্রমুখের। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জগদম্বার বাবা রাজচন্দ্র দাস এবং হবু স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস। মা রাসমণি মেয়ের লেখাপড়ায় পূর্ণ সমর্থন জানালেও শুধু পরিবারে ভয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন। সংসারে শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি ও পিসিশাশুড়ি প্রমুখদের মুখের উপর রানি কোনদিন কিছু বলেননি। নীরবে সবকিছু সহ্য করেছেন। তবে শ্বশুর মশাই প্রীতরাম দাস এবং স্বামী রাজচন্দ্র দাস, রানির প্রতি কোনো অশোভন ব্যবহার  বা কটু কথা বলেননি। সেই সময় তীর্থ করতে যেতে হলে জলপথ এবং হাঁটাপথ একমাত্র ভরসা ছিল। কিছু কিছু জায়গায় রেলপথ চালু হলেও কলকাতা থেকে কাশী পর্যন্ত রেল হয়নি। রানিকে কাশী যেতে হলে জলপথে যেতে হবে।
🍂
এর পূর্বে রানি বেশ কয়েকটি তীর্থ ভ্রমণ করে এসেছেন। মথুর তাঁর সঙ্গে থেকেছে। কাশী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাজবাড়িতে এলাহি কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। রানির কাশী যাওয়া বলে কথা। কলকাতার - বিখ্যাত ধনী রানি রাসমণির জন্য পঁশিচখানা বজরা তৈরি হল, সঙ্গে যাবে দাস-দাসী - ঠাকুর-কর্মচারী আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন প্রকার খাদ্যসামগ্রী জামা-কাপড় পোষাক- বিছানাপত্র ইত্যাদি সে এক মস্ত ব্যাপার।রানির যেন কোন অসুবিধা না হয়, বাইরে গিয়ে কোন-জিনিসের অভাব যেন না হয় সেই মত চিন্তাভাবনা করে জিনিস পত্র গোছগাছ চলল দিন কয়েক ধরে।

বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী রানি রাসমণির পাশে তো সেই মানুষটি নেই। স্বামী-রাজচন্দ্র দাস সদাসর্বদা নির্ভর একটি ছায়ার মতো রানির সঙ্গে সর্বত্র বিচরণ করতেন। সেই মানুষটির পরমায়ু খুবই কম ছিল। ১২৪৩ বঙ্গাব্দে ইংরাজি ১৮৩৬ সাল রাজচন্দ্র পঞ্চাশ বছরও পেরতে পারলেন না । উনপঞ্চাশেই সন্ন্যাস-রোগে আক্রান্ত হয়ে  ইহলোক ত্যাগ করলেন। রানি রাসমণি কাশী যাত্রার মনস্থ করলেন ১২৫৪ বঙ্গাব্দ। রাজচন্দ্র দাসের ইহলোক ত্যাগের প্রায় ১১ বছর পরে। তবে তাঁর জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস রানিকে নিজের মাতৃজ্ঞানে মান্য করতেন এবং যারপরনাই রানি রাসমণিকে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহযোগে দেখভাল করতেন। রানির বড় জামাই রামচন্দ্র আটাও রানিকে যথেষ্ট মান্য করতেন এবং শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। সব সময় উপযুক্ত কর্ম করতে পারতেন না রামচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী পদ্মরানির কুব্যবহারের জন্য, পদ্মরানি যথেষ্ট উগ্র স্বভাবের এবং বিষয়াসক্ত ছিলেন। পুত্র মহিমকে সদাচার শিক্ষা দিতে পারেননি পদ্মরানি। এই নিয়ে সংসারে অশান্তি দেখা দিয়েছে। সেই সময় রানিকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। তিনি আড়ালে - আবডালে গৃহদেবতার কাছে সব জানিয়ে চোএক্সখের জল ফেলে সকলের মঙ্গল কামনা করেছেন।
ক্রমশ
 

Post a Comment

0 Comments