দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
সপ্তম পর্ব
মথুরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটি অটো করে আমরা বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্টেশন থেকে বৃন্দাবনের দূরত্ব প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার। রাস্তায় দেখতে পাচ্ছি কাতারে কাতারে লোক বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। এত লোকের সমাগম হবে এ কথা ভাবতেই পারিনি। এ যেন গত বৎসরের হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় দেখা জনসমাগম। কেউবা অটোতে, কেউবা টাঙ্গাতে, আবার অনেকেই মাথায় কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে স্ত্রী, সন্তানসন্ততি বা দেশওয়ালী লোকেদের সাথে একত্রে পদব্রজে চলেছেন। উদ্দেশ্য একটাই - বৃন্দাবনে ঠাকুরজি ও রাধারানীর দোল উৎসব প্রত্যক্ষ করা এবং ইহজীবনে সামান্য পুণ্য অর্জন করা। আমাদের উদ্দেশ্য দ্বিবিধ - পুণ্য অর্জন এবং অগণিত জনসমুদ্রের মিলন মেলায় সামিল হওয়া। বৃন্দাবন যাওয়ার রাস্তায় প্রতিটি মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিছুদূর যাবার পরে যানবাহনের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল বৃন্দাবনের পথে মায়াবতী হাসপাতালের সম্মুখে এসে। এখানে ব্যারিকেড পেরিয়ে পুনরায় একটি টোটো করে কিছুদূর আসার পরে আবার বিধি-নিষেধের বেড়াজালে পড়লাম। এখান থেকে কিছুটা পথ পদব্রজে পেরিয়ে পুনরায় একটি টোটোর সওয়ারী হয়ে বৃন্দাবনে আমাদের সাময়িক আবাসস্থল 'ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে' এসে পৌছালাম সকাল ন'টায়। দীর্ঘ ৩৯ঘন্টা যাত্রাপথের পরিসমাপ্তি।
আশ্রমে প্রবেশ করে রিসেপশনে তাপস ব্রহ্মচারীর কাছে আশ্রমে থাকার অনুমতিপত্র গ্রহণ করে আমাদের নির্ধারিত রুমের উদ্দেশ্যে গেলাম। তাপস ব্রহ্মচারী জানালেন দুপুরে আশ্রমের ভোগ প্রসাদ পাওয়া যাবে সাড়ে বারোটায়। সঙ্ঘগুরু স্বামী প্রাণবানন্দজীর সুদৃশ্য মন্দিরের ডানদিকে বাথরুম সংলগ্ন একটি ঘর দেওয়া হল আমাদের। মন্দিরের পিছনে আশ্রমের ভোজন কক্ষ যেখানে একসাথে প্রায় ৮০ জন যাত্রী খেতে পারবেন। ঘরের চাবি খুলে দিলেন আশ্রমেরেই এক কর্মচারী শ্রী রাম মাহাতো। তার কথার টান শুনে কথায় কথায় জানতে পারলাম রামের বাড়ী পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম জেলায় গোপীবল্লভপুরের নিকটবর্তী এক গ্রামে। রামের কথায় ঝাড়গ্রাম জেলার আদিবাসী টান। ঝাড়গ্রাম জেলার সাথে আমি পূর্বপরিচিত কারণ কর্মসূত্রে আমাকে বার-তিনেক ঝাড়গ্রাম জেলায় যেতে হয়েছিল। যাইহোক ধান ভানতে যেয়ে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্র ঘরের মধ্যে রেখে জলখাবারের উদ্দেশ্যে আশ্রম থেকে বেরিয়ে ১০০ মিটার দূরে সামনের চৌরাস্তায় যেয়ে পৌঁছানো মাত্র আমার চোখ থেকে চশমাটি শ্রীরামচন্দ্রের দাস ভক্তবীর হনুমানের কাছে 'হাইজ্যাক' হয়ে চলে গেল। বৃন্দাবনে আসার পূর্বে হনুমানদের দৌরাত্মের কথা যদিও শুনেছিলাম তথাপি এত তাড়াতাড়ি তাদের কাছ থেকে অভ্যর্থনা পাবো আশা করিনি। যাইহোক স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় চশমাটি হনুমানের দখলদারি থেকে আমার কাছে ফিরে এলো সামান্য খুত অবস্থায়। অবশ্য তাতে আমার কাজ চালাতে কোন অসুবিধা হয়নি। আর চশমা ফেরত পাওয়ার জন্য আমাকে দুটি 'ফ্রুটি'র প্যাকেট প্রণামী দিতে হয়েছিল ভক্তবীরকে।
🍂
আশ্রমে ভোগ প্রসাদ পাওয়ার পরে সুমিতা আমাকে জিজ্ঞেস করল "সকালে তো মথুরার ইতিহাস ও নামের উৎপত্তি বিশদে জানিয়েছ কিন্তু এখন আমাকে বৃন্দাবনের নাম মাহাত্ম্য ও ইতিহাস আমাকে বল"। তার জানার আগ্রহ দেখে বললাম "তোমাকে আগে বৃন্দাবন নামের উৎপত্তি বলছি। সত্যযুগে কেদার নামে সত্যবাদী ও ধর্মপরায়ণ এক রাজা ছিলেন। তিনি শ্রীহরির একান্ত ভক্ত ছিলেন। কমলার অংশস্বরূপা বৃন্দা নামে তাঁর এক কন্যা ছিল। বাল্যকাল থেকেই বৃন্দা শ্রীহরির তপস্যা করতে ভালোবাসতো। বিবাহের সময় আগত হলে সে তার পিতাকে বলল পিতা আমি বনবাসী হয়ে শ্রীহরির তপস্যা করব। একদিন রাজা কেদারের গৃহে মহামুনি দুর্বাসা এসে উপস্থিত হতে বৃন্দা তাঁর কাছ থেকে হরিমন্ত্র গ্রহণ করে তপস্যার জন্য বনে গমন করলেন। এক হাজার বৎসর বনবাসে শ্রীহরির তপস্যা করার পরে ভক্তবৎসল শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন "তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট, তুমি আমার কাছে তোমার ইচ্ছামতো বর প্রার্থনা কর"। বৃন্দা বলেছিলেন "আমার অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা নেই শুধু আপনি আমার পতি হন এই আমার প্রার্থনা"। 'তথাস্তু' বলে শ্রীকৃষ্ণ সেই নির্জন বনস্থলীতে বৃন্দার সঙ্গে বহুকাল বিহার করেছিলেন। তারপরে বৃন্দা ইহজীবন ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোলকধামে গিয়ে শ্রীরাধিকার সমান সৌভাগ্যশালিনী ও গোপীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা হলেন। বৃন্দা যেখানে তপস্যা করেছিলেন বা যেখানে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করেছিলেন তাই আজকের এই বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ। অপর একটি পৌরাণিক আখ্যানে বলা হয়েছে পুরাকালে কুশধ্বজ নামে এক রাজার তুলসী ও বেদবতী নামে দুই কন্যা ছিলেন। দুই কন্যাই সংসার বিরাগিনী হয়ে দীর্ঘকাল কঠোর তপস্যা করেন। তপস্যার ফলস্বরূপ বেদবতী নারায়নকে পতিরূপে পান। পরবর্তীকালে এই বেদবতী ত্রেতাযুগে জনকনন্দিনী সীতা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। আর তুলসী শ্রীহরিকে পতি রূপে কামনা করে দুর্বাসার অভিশাপে অসুর শঙ্খচূড়কে পতিরূপে লাভ করেন। ভগবান শঙ্করের আশীর্বাদে শঙ্খচুড় অজেয় ছিলেন। সেই শঙ্খচূড়কে হত্যা করার অভিপ্রায়ে শ্রীহরি শঙ্খচূড়ের বেশ ধরে এসে তুলসীর সতীত্ব নাশ করেন এবং তুলসীর অভিশাপে শ্রীহরি শালগ্রাম শিলারূপে বিরাজিত হন। সেই শ্রীহরির অভিশাপে তুলসী বৃক্ষরূপ ধারন করে চিরকাল শালগ্রাম শিলার উপরে বিরাজিত হয়ে শ্রীহরির বক্ষে আশ্রয় লাভ করেন। তুলসী যে স্থানে তপস্যা করেছিলেন সেই স্থানকেই বৃন্দাবন বলা হয়েছে। আবার শ্রী রাধিকার রম্য ক্রীড়াবন বলেও বৃন্দাবন বিখ্যাত। গোলোকের বৃন্দাবনের অনুরূপ এই বৃন্দাবন স্বয়ং বিশ্বকর্মা সৃষ্টি করেছিলেন দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল রূপে।
গর্গসংহিতায় বলা হয়েছে গোলকপতি শ্রীকৃষ্ণ ভুলোকে অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্প করে তার প্রাণাধিকা শ্রী রাধিকাকে ভূলোকে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করলেন। তখন শ্রীরাধিকা বললেন "যত্র বৃন্দাবনং নাস্তি ন যত্র যমুনা নদী। যত্র গোবর্ধনো নাস্তি তত্র মে ন মনঃসুখং। এর অর্থ হল যেখানে বৃন্দাবন, যমুনা নদী আর গোবর্ধন পর্বত নেই সেখানে গিয়ে আমি মনে শান্তি লাভ করতে পারব না"। শ্রীরাধিকার কথা শুনে গোলকপতি শ্রীকৃষ্ণ গোলকধাম থেকে বৃন্দাবন, যমুনা ও গোবর্ধন পর্বতকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। এই বৃন্দাবনে ২৪টি বন সমাযুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার বৃন্দাবন লীলার সাক্ষী হলেন।
(পরবর্তী অংশ অষ্টম পর্বে)
0 Comments