বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
অষ্টম পর্ব
বরাহপুরাণের মতে বৃন্দাবনে বারটি বন, বারটি তীর্থ এবং পাঁচটি স্থল নিয়ে ব্রজমন্ডল। এই বারটি বন হল - বৃন্দাবন, তালবন, মধুবন, কুমুদবন, কাম্যবন, বহুলাবন, ভদ্রবন, খাদিরবন, মহাবন, লৌহবন, বিল্ববন ও ভান্ডীরবন। বৃন্দাবনে আবার বারোটি উপবন আছে। সেগুলি হল - অটলবন, কেবারিবন, গোচারণবন, কালীয় দমনবন, গোপালবন, নিকুঞ্জ বন, নিধুবন, রাধা বাগ, গহবর বন ও পপড়বন। স্কন্দপুরাণের মথুরা খন্ডে বলা হয়েছে বৃন্দাবনের আয়তন ৮৪ ক্রোশ পরিমিত স্থান নিয়ে অর্থাৎ বর্তমানের হিসেবে ২৭৫ কিলোমিটার। আবার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বৃন্দাবন নগরীর বিস্তৃতি বর্ণনা করা হয়েছে পঞ্চযোজন রূপে (এক যোজন মানে চার ক্রোশ)। যমুনা নদী বৃন্দাবনকে তিন দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। শ্রীকৃষ্ণের অংশ থেকে রাধার সৃষ্টি। দেহ আলাদা হলেও তাঁরা একই ঐশী সত্তার ভিন্ন রূপ। শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধা। তাই তিনি বৃন্দাবনের অধীশ্বরী। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভজনা করেছেন 'দেহি পদপল্লব মুদারম' বলে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করবার জন্যই শ্রীরাধার জন্ম। যিনি কৃষ্ণের আরাধিকা তিনিই রাধা বা রাধিকা। শ্রীকৃষ্ণ ভগবান আর রাধা মানবাত্মা। রাধাময় বৃন্দাবন জুড়েই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোপিদের লীলা। গো শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়, পী শব্দের অর্থ পান করা অর্থাৎ কৃষ্ণ রস পান করা। এই গোপীরা পূর্ব জন্মেছিলেন ঋষি। ভগবানকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য বৃন্দাবনে গোপীরূপে জন্ম নেন। বৃন্দাবনের অধীশ্বরী হলেন শ্রীরাধিকা। রাধা শব্দের অর্থ 'রা' মানে দান করা আর 'ধা' মানে নির্বাণ অর্থাৎ যিনি নির্বান দান করেন তিনিই রাধা। আবার কৃষ্ণ শব্দের অর্থ মোক্ষ। 'কৃষ' মানে মোক্ষ এবং 'ণ'কার মানে উৎকৃষ্ট অর্থাৎ যিনি উৎকৃষ্ট মোক্ষদান করেন তিনিই কৃষ্ণ।
যদিও প্রায় সমস্ত পুরানেই বৃন্দাবনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তবু কয়েক শতাব্দী ধরে এই পবিত্র পুরী জনমানবশূন্য বনভূমি রূপে পড়েছিল। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের নির্দেশে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীরূপ গোস্বামী, শ্রীসনাতন গোস্বামী এবং তাঁদের সহযোগী বৈষ্ণব আচার্যগন লুপ্ত বৃন্দাবনকে জনসমক্ষে প্রকট করেন। অবশ্য এর পরেও বৃন্দাবনের মন্দিররাজি ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করেছিলেন এবং বর্তমানে বৃন্দাবনের এই আধুনিক রূপ হয়েছে ব্রিটিশের আমলে। এখনো বলা হয় বৃন্দাবনে প্রায় চার হাজারের উপর মন্দির আছে কিন্তু সেগুলি সকলের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। যে সকল মন্দিরগুলি উল্লেখযোগ্য আমরা সেই সকল মন্দিরে গিয়ে দর্শন করব।
বৃন্দাবনের মন্দিররাজি
বিকেলে আমরা ভারত সেবাশ্রম সংঘ থেকে পদব্রজে মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সকালে চশমা 'হাইজ্যাক' হয়েছিল বলে সাবধানতাবশতঃ বিকেলে আর চশমা চোখে লাগালাম না। অবশ্য চশমা না লাগানোয় আমার দেখার কোন অসুবিধে হবে না। কিছুদূর যাবার পরে ওখানকার একজন স্থানীয় লোকের দেখা পেলাম যাকে শখের 'গাইড' বলা যায়। সেই ভদ্রলোক আমাদের কয়েকটি মন্দির দেখিয়ে সেই মন্দিরগুলি সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য আমাদেরকে বলবেন এবং তার জন্য তিনি পঞ্চাশ টাকা দক্ষিণা চাইলেন। আমরা তাঁর কথাতে রাজী হতে তিনি আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলেন মথুরা-বৃন্দাবন রোডে শ্রীগোবিন্দ মন্দিরে। মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে তিনি আমাদের এই মন্দিরের ইতিহাস বলতে শুরু করলেন। ষোড়শ শতকের প্রথম পাদে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের নির্দেশে তাঁর শিষ্য শ্রীরূপ গোস্বামী এবং শ্রীসনাতন গোস্বামী এসেছিলেন বৃন্দাবনে - উদ্দেশ্য বিভিন্ন সময়ে যবন আক্রমণে লুপ্তপ্রায় ব্রজভূমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থলগুলি উদ্ধারের জন্য।
🍂
পুরান কথা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র তের বৎসর বয়স্ক বজ্রনাভ একদিন তাঁর ঠাকুমাকে (প্রদ্যুম্নের স্ত্রী) জিজ্ঞেস করেন তার দাদু শ্রীকৃষ্ণ দেখতে কেমন ছিলেন। ঠাকুমার মুখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপের বর্ণনা শুনে বজ্রনাভ তিনটি মূর্তি গড়েন। প্রথম মূর্তির চরণ দুখানি শ্রীকৃষ্ণের চরণ যুগলের অনুরূপ, দ্বিতীয় মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের শরীরের মধ্যভাগের ন্যায় এক মূর্তি এবং তৃতীয় মূর্তির মুখাবয়ব শ্রীকৃষ্ণের মুখাবয়বের ন্যায় নয়ন মনোহর। প্রথম মূর্তি মদনমোহন নামে, দ্বিতীয় মূর্তি গোপীনাথ নামে এবং তৃতীয় মূর্তি গোবিন্দদেব নামে পুজিত। এখন আমরা এই গোবিন্দদেব মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলাম শ্রীকৃষ্ণের পাশে রাধারানী বিরাজিত। সারা দিনে মন্দিরে সাতবার আরতি ও ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে রাত্রি নটা পনেরো মিনিট পর্যন্ত মন্দির প্রাঙ্গণ খোলা থাকে এবং সেই সময়ে যে সাতবার ভোগ নিবেদন করা হয় সেগুলি যথাক্রমে মঙ্গলা ভোগ, ধূপ ভোগ, শৃঙ্গার ভোগ, রাজভোগ, গাল ভোগ, সন্ধ্যা ভোগ এবং শয়ন ভোগ নামে পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা ও জন্মাষ্টমী উৎসব এখানে আড়ম্বর সহকারে পালিত হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ এই মন্দিরকে বলেন শ্রীরাধা গোবিন্দজীউর মন্দির। প্রচলিত বিশ্বাস যে বৃন্দাবনে এসে প্রথমে এই মন্দির দর্শন করতে হয়। রাস্তা থেকে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলে দেখা যাবে বাঁদিকে বৃন্দা দেবীর ছোট একটি মন্দির আর সামনে শ্রী গোবিন্দদেবের মন্দির। গোবিন্দদেবের এই লাল পাথরের সুবিশাল মন্দির উত্তর ভারতের হিন্দু শিল্প-সংস্কৃতির একটি সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ইন্দো-গ্রীক স্থাপত্য কলার সংমিশ্রণে এই মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরের বহির্ভাগের দেওয়ালগুলি প্রায় দশ ফুট চওড়া। নাটমন্দিরটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১০০ ফুট করে এবং নাটমন্দিরের মধ্যখানে অনেক গুলি স্তম্ভ আছে। নাটমন্দিরের উপরে সিলিংয়ের সূক্ষ্ম স্থাপত্য শিল্প আজও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাটমন্দিরের পরে গর্ভগৃহে সিংহাসনের উপরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গিরিধারী রূপে বিরাজিত। বামে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, ডাইনে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, তার নীচে রাধাগোবিন্দ এবং তার নীচের ধাপে জগন্নাথ মহাপ্রভুর বিগ্রহ। নটি চূড়াযুক্ত সাত তলা বিশিষ্ট এই মন্দিরটি ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে জয়পুরের রাজা মানসিংহ তার গুরুদেব শ্রীরূপ গোস্বামীর নির্দেশে তৈরী করেছিলেন। রাজা মানসিংহ এই মন্দির নির্মাণের জন্য শিল্পীদের মজুরী বাবদ ব্যয় করেছিলেন তখনকার মুদ্রায় তের লক্ষ টাকা। প্রত্যহ সন্ধ্যায় মন্দির শীর্ষে যে ঘৃতের প্রদীপটি জ্বালা হত তার আলো নাকি আগ্রা রাজপ্রাসাদ থেকে দেখা যেত। কাফের হিন্দুদের মন্দিরের এই আলো দেখে ধর্মান্ধ সম্রাট আওরঙ্গজেব তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মথুরা ও বৃন্দাবনের সকল মন্দির ভেঙে চূর্ণ করে দিতে।
পরবর্তী অংশ নবম পর্বে
0 Comments