বার্লিনের ডায়েরি --৩
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
আকাশে আকাশে।
হেমন্ত গোধূলির শেষবেলার বিদায়ী লগ্নে ক্লান্ত সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসে। নির্জন সদ্য পিচ ঢালা ন্যাশনাল হাইওয়ের ঝকঝকে আঁকাবাঁকা রাস্তাটি ধরে কলকাতার নেতাজীসুভাষ ইন্টার ন্যাশানাল এয়ারপোর্টে শ্রীময়ীর গাড়ি পৌঁছলো। এয়ারপোর্টের যাবতীয় ফর্মালিটি সেরে দুবাই গামী এমিরেটস এয়ার ওয়েসের প্লেন ছাড়তে এখোনো দেরী । ঘন দুধের তৈরী কড়া কফির দুটো ঢাউশ মগ হাতে নিয়ে দুজনে নির্বাক লাউঞ্জে বসে আছে । পুরু মোটা কাঁচের দেওয়ালের বাইরে চলছে এমিরেট্স এয়ারওয়েসের প্লেন ওঠা নামার অনবরত তীব্র গতির আওয়াজ মাটিতে ছুটে চলার সাথে তর্জন গর্জন করে আকাশে ওড়ার কঠিন সংকল্প। যদিও সে আওয়াজ shock proof , sound proof কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে কানে প্রবেশ করে না। শ্রীময়ী ডায়েরির পাতায় মনোনিবেশ করে ক্রমশ সাজিয়ে চলে এই বিশেষ দিন গুলোর বেহিসেবী মনের হিসেব।
বিস্তর ভাবনা চিন্তার ঝড় কে উড়িয়ে দিয়ে কন্যার ডাকে সাড়া দিয়ে পিতৃ হৃদয়ে মানসিক শান্তিতে গত মাসের প্রথমেই ঋষভ জার্মানীর ভিসার আবেদন করেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও ভিসার দেখা নেই। প্রতিদিন প্রতীক্ষায় ,উদ্বেগে অশান্তিতে কাটে। সে সময় ২০১৫র সেপ্টেম্বর ,স্মার্ট ফোন বাজারে বিশেষ আসেনি। দিনের শেষে মেল বক্স খুলে শ্রীময়ীর আশা -নিরাশার দোলায় মনের প্রস্তুতির উদ্যম টুকু ও ধ্বংসের মুখে । ভিসা অথৈজলে জার্মান কনস্যুলেট ,অফিসের কোনো হেলদোল নেই । ধৈর্য্যের বাঁধ শেষ বিন্দুতে পৌঁছলে এক বিকেলে ডেস্কটপ খুলতেই ও দেখেছিল আইনি বাঁধা পার হয়ে ঠিক ৩৪ দিন পর অবশেষে ভিসা মঞ্জুর হয়েছে।গভীর উত্তেজনায় তিতির কে মেল ফরোয়ার্ড করার এক ঘন্টার মধ্যেই এয়ার এজেন্ট দন্ডপানি বাবু যোগাযোগ করেছিল এবং বার্লিনের যাবার টিকিট একদিনেই হাতে এসে গেলে শ্রীময়ীর অতি প্রিয় ঘরের কোণ প্রতিদিনের নিশ্চিন্ত শান্তির নীড় টি ছেড়ে মেঘ মুক্ত শরতের নীলাম্বরী আকাশ ,ভাগীরথীর নিরন্তর তির্তিরিয়ে বয়ে যাওয়া তীরের শান্ত সৌন্দর্য পিছনে ফেলে, মুহূর্তে সাগর পাড়ের ভিনদেশী সেই রূপ কথার রাজ্যে পাড়ি দিতে সপ্তরথের ঘোড়ায় চড়ে অবিরাম দৌড়- দৌড়- দৌড় লাগায় সে ।
আকাশে আকাশে
অন্ধকার রান ওয়েতে সশব্দ গর্জনে ধরণী কাঁপিয়ে বুক ভরে দম নিয়ে বিশাল এক চক্কর লাগিয়ে আকাশ পথে বাহু মেলে দিয়েছে প্লেন টি । তারপর দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রাঞ্জিট করে এয়ারবার্লিন ধরতে হবে। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাতের আকাশের বুক চিড়ে সশব্দে বিজয় গর্বে শূন্য থেকে মহাশূন্যে ভাসবে এবার যান্ত্রিক বিহঙ্গ,একালের রূপালী রথ টি । অজস্র চিন্তায় মগ্ন হয়ে -- প্লেনের উইন্ডো সিট থেকে শ্রীময়ীর চোখ কালো আকাশের নীচে ঐ মাটির পৃথিবীর দিকে। ছেড়ে যাওয়া প্রিয় শহর কলকাতা তখন আলোক মালায় সজ্জিত। যেন অজস্র স্বর্ণালঙ্কারে রানীর মত আভরণে সেজেছে তিলোত্তমা। মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে প্লেন যত ওপরে উড়ছে উজ্জ্বল রত্নমালায় ভূষিত রাতের রানী চোখের সামনে থেকে নিষ্প্রভ হয়ে দূর থেকে সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে । বিদায়ী বেলায় নীরবে বলে ''ভালো থেকো কলকাতা। আমি আবার আসবো ফিরে। চোখ দূটো অজান্তে তপ্ত জলে ভরে ওঠে।
সুদূর দিগন্তে মেঘের রাজত্বে নিবিষ্ট মনে আকাশ পারের আবছা আলোয় মেঘের মেলায় মাটির পৃথিবীর সাথে সব বন্ধন ছিন্ন করে এমন ভেসে থাকতে যেন পরম নিশ্চিন্তে এক সুখের সাগরে ভেসে যাওয়া। ক্লান্তি বিহীন একটানা বসে থেকে গান শুনে ,সিনেমা , রোড ম্যাপ আর ঘড়ি দেখে সময় কাটানো ছাড়া কোনো কাজ নেই। মেঘবালিকারা মিষ্টি হেসে চা কফি হাতে মধুর আপ্যায়ন করে,সঙ্গে থাকে স্বাদে গন্ধে মন চঞ্চল করা চেনা অচেনা রেসিপির খাবার।
আকাশের প্রান্তে , প্রায় ৩৯ হাজার ফুট উঁচু তে উজান বেয়ে উড়ে চলা প্লেনের যাত্রা পথের রোড ম্যাপের দিকে তাকিয়ে ঋষভ বলে ভারতের আকাশের সীমানা পেরিয়ে এলাম। আলো বর্জিত চাঁদ তারা হীন অনন্ত অন্ধকারে ঘন মেঘেদের রাজ্যের অতিথি হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রীময়ী কত রকম গল্পের ছবি আনমনে এঁকে যায়। রাত বাড়ছে , প্রায় চার ঘন্টার মত কেটে গিয়েছে এবং নীচের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণালোকে মোড়া ঐশ্বর্যের আস্ফালনে গর্বিত রাতের রানী দুবাই কে দেখে মোহিত হয়ে ওঠে। ককপিট থেকে ঘোষিত হয় "খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা দুবাই এয়ারপোর্টে অবতরণ করবো ।" এবং আকাশ পথ ছেড়ে ঢেউ খেলে পাক খেয়ে নীচের দিকে প্লেন ক্রমশঃ সশব্দে রানওয়ের মাটি ছুঁতে চলেছে ।
আবার ইমিগ্রেশন চেকিং বোর্ডিংপাস ইত্যাদি ঝামেলার অন্তনেই ।যদিও এখানে ঘন্টা দুয়েকের লে-আউট। বেশ কিছুটা এগিয়ে পথ নির্দেশিকায় চোখ পড়তেই ঋষভ বলে যেতে হবে প্রায় দেড়-দু কিলোমিটার মত লম্বা পথের শেষ ঠিকানায় ২৭ নম্বর গেটে। এখানেই ট্রানজিটে এয়ার বার্লিনের প্লেনে উঠবো । প্রতিটা পা মেপে ফেলে ভীত সন্ত্রস্ত শ্রীময়ীর মনের ভাব টা কত দূরে সে গেট ? কোথায় গেলেই বা পাবো তারে ? সবে মাত্র তিন নম্বর গেট , আরো বিস্তর পথ পরিক্রমা বাকী , দুশ্চিন্তায় মন আছন্ন হয় । সামনে কার্পেট পাতা বিশাল রাস্তা আদি অন্ত নেই ? শুধু এক চিন্তা মাথায় ঘোরে ''এত রাস্তা চিনে সব ফর্মালিটির শেষে বার্লিনের প্লেনে উঠতে পারবো তো'' ?
🍂
বাপরে ! ওর বিস্ময়ের সীমা নেই। অবাক চোখে চেয়ে দেখে কী বিশাল , কী দারুণ অপরূপ সাজে সজ্জিত বিলাস বহুল দুবাই এর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। পৃথিবীর অন্যতম তৃতীয় বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম বিমানবন্দর টিতে সব আছে । চারদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মধ্যরাতের তন্দ্রা জড়ানো ঘুম ঘুম চোখে যেন স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করেছে।কিন্তু এতো ঐশ্বর্য্য , শপিং সেন্টারের সাজিয়ে রাখা নানা রকমের পারফিউমের শিশি গুলো ,স্পা -ম্যাসাজ -বিউটি পার্লার,থেকে পোশাকের মল , ডায়মন্ড জুয়েলারি ,সোনার গয়নার অলংকার কত রকম লোভনীয় সামগ্রী। চোখ ধাঁধানো শো রুম । কত রকমের বাহারী টুপি , লেডিস পার্স ,জেন্টস ব্যাগ ,চটি, জুতো, ড্রেস, শার্ট,প্যান্ট প্রসাধনী দ্রব্য থেকে শুরু করে যা কিছু উপহারের সামগ্রী চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্য্যর বিপুল সম্ভার। বিদেশী মেনুর উপকরনের সম্ভারে সাজানো রেস্তোরাঁ ছাড়াও মিষ্টি কেক চকলেট , কোল্ড ড্রিঙ্ক তো আছেই , নানা ধরণের মদ জাতীয় পানীয়র ডিউটি ফ্রী শপিং মল। ফুলের বোকের চমৎকার সংগ্রহ দেখার শেষ নেই । ওর মনে হয় কলকাতা এয়ারপোর্ট যেন এর তুলনায় একেবারে রিক্ত দৈন্য ।
কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ে বেশ বড়ো আকারের অনেক ঘড়ি সাজানো যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, মহাদেশের স্ট্যান্ডার্ড টাইম শোভিত হচ্ছে। শ্রীময়ীর মনে হয় এ এয়ারপোর্ট নয়, দুবাই এর আধুনিক কালের বিলাস বহুল উৎসব মুখর নগরী। যেখানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে স্বর্ণ ও মুদ্রার বিপুল ঝনঝনানি। সেন্টার্ড এসির মধ্যদিয়ে চলেছি ফুলের বাগান , অর্কিডের শোভা, এক্যুরিয়ামে রঙ্গীন মাছ, কৃত্রিম ফাউন্টেন চলার পথে মুগ্ধতায় ভরে রাখে । ঋষভ বলে ,এ টু জেড পৃথিবীর সব প্রয়োজনীয় দ্রব্য ,বিলাসীতার সন্ধান এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি তে নিমেষে পাওয়া যাবে ,যেন আরব্য উপন্যাসের রূপকথার গল্পের আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের মত।
শ্ৰীময়ীর মনে কিশোরীর কৌতূহল হাঁ করে লোভাতুর চোখে গিলেই চলেছে ,যা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। মনে ভাবে একটা দেশ, ও তার শহর কত ধনী সমৃদ্ধ শালী হলে তার এয়ারপোর্ট এমন বৈভব পূর্ণ বিলাস বহুল হতে পারে ? ঋষভ, রীতিমত বিরক্ত হয়ে একটু জোরেই ধমক লাগিয়ে বলে অমন হাঁ করে দেখছো কি ? তাহলে কানেক্টিভ এয়ার বার্লিন এর প্লেন ধরে কাজ নেই । শপিং মল দেখে ই রাত কাটাই কেমন ?
বিস্তর পথ ,হাতে সময় ও কম, প্লেন এবারে নির্ঘাৎ মিস হবে। বকুনি খেয়ে সচেতন হয়ে জোরে পা চালায়।সম্ভবতঃ দুই কিলো মিটারের ও বেশী পথ হেঁটে অবশেষে কিছুটা রোলারওয়েতে পার হয়ে নির্দিষ্ট গেটে এসে পৌঁছে দেখে দুবাই ঘড়ি তে প্লেন ছাড়তে যথেষ্ট সময় এখনো বাকী। এখানেও রাত গভীর ,তবে ভারতীয় সময় থেকে বেশ পিছিয়ে আছে। প্রচুর ভারতীয় ও বাংলা দেশী যাত্রী লাউঞ্জে অপেক্ষা রত দেখে শ্রীময়ী আনন্দে আত্মহারা। পুলকিত হয়ে ঋষভের হাতে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে দেখ চেয়ে ,কত ভারতবাসী। বার্লিনের প্লেনের নির্দিষ্ট আসনে সীটবেল্ট বেঁধে নিশ্চিন্তে বসলে ঠিক সময় মত প্লেন ডানা মেলে মেঘের আড়ালে গো গো শব্দ তুলে গা ঢাকা দিলো।
এয়ারপোর্ট রানওয়ে (কলকাতা)
রাত কত বড় ! সুগভীর ঘন অন্ধকার যেন শেষ হতেই চায় না । কত অজানা দেশ ,মহাদেশ পার হয়ে শহর নগর মরু প্রান্তরের ওপর দিয়ে কত পাহাড় পর্বত ঝর্ণা নদী সমুদ্র ডিঙিয়ে শুধুই মেঘের সাথে উড়ে চলা। এক অবোধ্য অচেনা মানসিক তাড়নায় আকুলি বিকুলি মন, তন্দ্রা জড়ানো চোখের পাতায় নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম জড়িয়ে আসে। আর আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘাড় থেকে মাথা এলিয়ে পরে। ঘুম মোছা চোখে এক চিন্তা আর কতক্ষণ ? তখন কোন মহাসাগর ,মহাদেশ আর তুষারাবৃত শ্বেত শুভ্র আল্পসের কত ওপর দিয়ে কত হাজার হাজার মাইল মেঘের সাথে ভেসেছিল মনে পড়ে না। বার্লিনের টেগেল এয়ারপোর্টে ,যখন কাক ভোরে পৌঁছেছিলো , আকাশে তখনো শিশু সূর্য চোখ ভরা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ভারী অলসের মত আবার শীতের কম্বল মুড়ি দিয়েছে। মেঘ ও তাকে পরম যত্নে আদরে গভীর স্নেহে কালচে ফিকে নীল শাড়ির আঁচলে ঢেকে রেখেছিল।
ক্রমশ ::
,
0 Comments