দূর দেশের লোকগল্প—ফ্রান্স (ইউরোপ)
ছোট রাজকুমারির বিয়ে
চিন্ময় দাশ
এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজার বউ ছিল না। রাজার ছেলে ছিল না। তাহলে কি কেউ ছিল না রাজার?
তা কেন গো? মেয়ে ছিল রাজার। কেবল একটা মেয়ে নয়। কেবল দুটি মেয়ে নয়। তিন তিনটি মেয়ে ছিল সে দেশের রাজার।
রাজার মেয়ে বলে কথা। সুন্দরী তো হবেই তারা। বড় মেয়েটি সুন্দরী। মেজ মেয়েটিও সুন্দরী। তবে, ছোট মেয়েটি আরও সুন্দরী। সবার চেয়ে সুন্দরী সে।
যেমন সুন্দরী, স্বভাবেও ভারি মিষ্টি সেই মেয়ে। রাজবাড়ির সবার মুখেই ছোট রাজকুমারির কথা। সবাই তাকে ভালোবাসে।
একবার রাজামশাই যুদ্ধে গেল। হাতি সাজল। ঘোড়া সাজল। নানা গড়নের পোষাকে সেনারা সাজল। রামসিঙা বাজিয়ে, বাহিনী সাজিয়ে, সবাই বেরিয়ে গেল।
বাবা যুদ্ধে গেল। বড় রাজকুমারির কিছু এলো না। মেজ রাজকুমারির কিছু গেল না। তারা খায়-দায়, ঘুরে বেড়ায়।
এদিকে যেদিন রাজা যুদ্ধে গেল, ছোট রাজকুমারির মন খারাপ। ভালো করে খায় না। ভালো করে পরে না। কথা বলে না কারও সাথে। ঘর ছেড়ে, বাগানে গিয়ে বসে থাকে।
কখনও হরিণকে দানা দেয়। কখনও হাত বুলায় পোষা ময়ুরের পিঠে। কখনও গিয়ে সরোবরে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। আনমনে এটা করে, ওটা করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে রাজবাড়ির সদর দেউড়ির দিকে। কান পেতে থাকে, কখন তুরি-ভেরি বেজে উঠবে। তার বাবামশাই ফিরে আসবে যুদ্ধে জয়ী হয়ে।
একদিন সত্যি সত্যি তুরি-ভেরি বেজে উঠল। শিঙা বাজল দেউড়িতে। দূত এসে জানিয়ে গেল, রাজা ফিরেছে জয়ী হয়ে। রাজবাড়িতে হুল্লোড় পড়ে গেল।
রাজামশাই ভিতরে এল। তিন মেয়ে গিয়ে ঘিরে ধরল বাবাকে। ঘর ভর্তি লোক। রাজামশাই বড় রাজকুমারিকে বলল—তোমার কী চাই, বলো।
বড় রাজকুমারি বলল—তুমি নিশ্চয় আমার জন্য একটা হিরের আংটি এনেছ।
রাজামশাই শুনে খুশি হল। মেজ রাজকুমারিকে বলল—তোমার কী চাই, বলো।
মেজ রাজকুমারি বলল— মণি-মুক্তোর কাজ করা একটা বীণা চাই আমার।
রাজামশাই শুনে আবার খুশি হল। এবার ছোট রাজকুমারিকে বলল—তোমার কী চাই, মা?
ছোট রাজকুমারিটি সিধে সরল মানুষ। সে বলল—আমার কিছু চাই না, বাবামশাই। তুমি জয়ী হয়ে ফিরে এসেছ। এতেই আমি খুশি।
রাজা বলল—তা কি হয়? কিছু তো চাও। আমার আদরের মেয়ে বলে কথা।
ছোট রাজকুমারি বলল—দেবেই যদি, আমাকে একটা মাটির ভাঁড় দাও। আমার হাত ধুতে সুবিধা হয় তাতে।
রাজার মাথায় যেন আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল। রাজার মেয়ে। তার লজ্জা নাই, শরম নাই। একটা মাটির ভাঁড় চেয়ে বসল সবার সামনে। দাস-দাসীরাও এর চেয়ে অনেক ভালো কিছু চাইবে।
ভয়াণক রেগে গেল রাজা। হাঁক ছেড়ে বলল—কোতোয়াল কোথায়? তাকে ডেকে নিয়ে আয়।
কোতোয়ালের নাম শুনে, সবাই ভয়ে থর থর করে উঠল। কী সর্বনাশ হতে চলেছে, কে জানে!
হুকুম পেয়ে কোতোয়াল এলো। মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল রাজার সামনে।
🍂
রাজা গর্জন করে উঠল—এটাকে নিয়ে যা আমার সামনে থেকে। বনে গিয়ে কেটে ফেলবি একে। কলিজা আর জিভ কেটে এনে, দেখাবি আমাকে।
হায় হায় করে উঠল গোটা রাজবাড়ি। কিন্তু রানি নাই এ রাজ্যের। কে বাধা দেবে রাজাকে!
ছোট রাজকুমারি মুখ ফুটে কিছু বলল না। চোখের জল ফেলল না। মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল।
রাজার মেয়ে একা গেল না। পিছন পিছন আরও কয়েকজন চলল। রাজকুমারির খাস দাসিরা চলল। পোষা বাঁদর ছিল, সে চলল। কুকুর ছিল একটা, সেও চলল। মাথা নীচু করে কোতোয়াল চলল, সবার পিছনে।
বনের মধ্যে ঢুকেছে সবাই। রাজকুমারির সামনে এসে দাঁড়াল কোতোয়াল। এখনও তার মাথা নীচু। বিড় বিড় করে জানালো, তার উপর কী হুকুম হয়েছে।
তখন শুরু হোল এক বিবাদ। দাসীরা বলে আমাদের মারো রাজকুমারির বদলে। কুকুর আর বাঁদর বলে আমাদের মারো। নিজেদের ভিতর ঝগড়া বেধে গেল তাদের। কিছুতেই মেটে না সে বিবাদ। সবাই মারা পড়তে চায়, রাজকুমারিকে বাঁচাবে বলে।
বাঁদরটা এক কাণ্ড করে বসল। তরতর করে একটা গাছের মগডালে উঠে ঝাঁপ মেরে দিল। মারা পড়ল বটে, কাজ কিছু হোল না তার দ্বারা। কোতোয়াল বলল—এর কলজে আর জিভ এতোটাই ছোট যে, রাজামশাইকে বোঝানো যাবে না।
পোষাকের আড়ালে লুকিয়ে ছুরি এনেছিল এক দাসি। নিজের বুকে গেঁথে, সে মারা পড়ল। কলজেটা পাওয়া গেল বটে, তার জিভের রঙ আলাদা। সেটা মিলল না। তখন কুকুর এগিয়ে এল কোতোয়ালের খাঁড়ার তলায়। তার জিভ কাজে লেগে গেল। তিনজনকে মাটি চাপা দিয়ে, কোতোয়াল ফিরে গেল রাজবাড়িতে।
এখন এই গহীন বনের ভিতর সে একা। রাজকুমারি ভাবল, কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজতে হবে, মাথা গোঁজবার মত। বনের ভিতর হাঁটতে লাগল একা একা।
কতটা পথ চলবার পর, সামনে একটা ভেড়াকে দেখতে পেল। অবাক ব্যাপার হোল, ভেড়াটার শরীর নানা অলঙ্কারে মোড়া। গায়ে একটা কোট। সে বলল—এসো, রাজকুমারি। এই গভীর বনে তোমাকে স্বাগত।
কথা শুনে বেশ ভালো লাগল রাজকুমারির। সে সাথে সাথে চলল। কিন্তু তার ডেরায় পৌঁছে হতভম্ব। ছাগল-ভেড়ার খোঁয়াড় ছাড়া সেটা আর কিছু নয়।
ভেড়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল—ঘাবড়িও না গো রাজার মেয়ে। আমিও একজন রাজপুত্র। এক পরী আমাকে আটকে রেখেছে এখানে। শয়তানিটা চায়, আমি তাকে বিয়ে করি। এখানে আর যেসব ছাগল ভেড়া দেখছো, সবই সেই শয়তানির শিকার। সবাই কোন না কোনও দেশের রাজার ছেলে। যাকগে সে সব। তা, তুমি তো মেয়ে, তোমার ভয় পাওয়ার কোন দরকার নাই। আমি তোমাকে প্রাণ দিয়েও বাঁচাবো।
পরীটা শয়াতানি হলে কী হবে, ছাগল ভেড়াগুলোকে রেখেছে বেশ সুখে। বিশেষ করে যেসব গয়নাগাঁটি পরে থাকে তারা, বেশ ঈর্ষা করবার মত।
এইভাবে বেশ কতোদিন গেল। একদিন পরী নিজে এসে হাজির। রাজকুমারিকে ডেকে বলল—একটা খবর আছে গো, মেয়ে। তোমার বড়দিদির যে বিয়ে লেগেছে।
শুনে মন ভারি আনচান রাজকুমারির। সে বলল—আমাকে একবার যেতে দেবে বিয়েবাড়িতে?
পরী বলল—যেতে পারো। আপত্তি নাই। তবে, একটা কথা। বিয়ে শেষ হওয়া মাত্র বেরিয়ে আসতে হবে সেখান থেকে। কেউ যেন তোমাকে চিনতে না পারে।
রাজকুমারি তো ভারি খুশি। তবে, তার খুশি হওয়ার আরও বাকি ছিল। পরী বলল—কিন্তু খালি হাতে কি আর বিয়ে বাড়ি যাওয়া যায়? বিশেষ করে নিজের দিদির বিয়ে। সেটা আবার রাজার বাড়ি! এক বাক্স গয়না দেব। নিয়ে যেও হাতে করে। উপহার দিয়ে আসবে।
দামী সাজপোষাক পরে, গয়নাগাটিতে সেজে, বিয়েবাড়িতে হাজির হোল রাজকুমারি। ভিড়ের ভেতরে আলাদা করে তাকে খেয়াল করল না কেউ। বিয়ের আসর না ভাঙতেই, গয়নার বাক্স রেখে, বেরিয়ে এলো রাজবাড়ি থেকে।
কিন্তু রাজার চোখ এড়ায়নি। এমন ঝলমলে জমকালো পোষাক পরা, কে এই মেয়ে? তার উপর বাক্সভর্তি হীরে-মুক্তোর এমন মহার্ঘ সব অলঙ্কার! কে হতে পারে?
কিছুদিন বাদে আবার এসেছে পরী। জানাল—তোমার মেজো দিদির বিয়ে যে গো।
আবার দামী দামী পোশাকে সাজল রাজকুমারি। মূল্যবান গয়নাগাটি পরল। গয়নাভর্তি বাক্স নিয়ে বিয়ে বাড়িতে এসে হাজির হোল।
পরী বলল—সময় মতো ফিরে এসো কিন্তু। দেরী করলে, লোক পাঠিয়ে ধরে আনতে হবে। তখন কিন্তু শাস্তি আছে কপালে। ছাগল-ভেড়া হয়ে থাকতে হবে বাকি জীবন।
এদিকে হয়েছে কী, রাজামশাই ছিল তক্কে তক্কে। কে এই মেয়ে জানতেই হবে। ছোট রাজকুমারি ঢোকামাত্রই, রাজবাড়ির সবগুলো ফটক আটকে দেওয়া হল। এমন চুপিসারে হোল যে, ছোট রাজকুমারি টেরটিও পেল না।
বিয়েবাড়ি মিটতে না মিটতেই উঠে পড়ল মেয়েটি। ফটকে এসে দেখল , সেটা বন্ধ। ভয়ে কেঁপে উঠল মেয়ে। বাকি জীবন কাটাবে কীভাবে?
ততক্ষণে সেপাইরা এসে, গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে। তখন রাজামশাইও এসে গেল। পরিচয় জানতে চাইল মেয়ের। মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ছোট রাজকুমারি।
রাজামশাই তখন একটা দাসীকে ইঙ্গিত করল। সে মেয়ে ছুটে গিয়ে এক ভাঁড় জল নিয়ে এল।
মাটির ভাঁড়ে জল দেখে, সব ভুলে গেল ছোট রাজকুমারি। ওড়নার আড়াল সরে গেল মুখ থেকে। আনন্দে বলে উঠল—এই তো আমার মাটির ভাঁড়ে জল।
রাজামশাই হেসে উঠল, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সারা বাড়ি আনন্দে মেতে উঠল।
এদিকে সময় তো ফুরিয়ে গিয়েছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে পরীর। শেষমেশ ভেড়াকে ডেকে বলল—তুমিই এনেছিলে এই মেয়েকে। তুমিই যাও, তাকে তুলে আনতে।
ভেড়া বলল—একটা ভেড়াকে কি রাজবাড়িতে ঢুকতে দেবে? আমি পৌঁছব কী করে?
পরী বলল—সেটা অবশ্য ঠিক কথা। ঠিক আছে, এই সোনালি সুতোগাছি নিয়ে যাও। তেমন বুঝলে, গলায় জড়িয়ে নিও। তোমার আগের চেহারা ফিরে আসবে।
ভেড়া বলল—কিন্তু মেয়েকে ফিরে পেয়ে, রাজা কি তাকে ছেড়ে দেবে? তাছাড়া, সৈন্যসামন্ত আছে সেখানে। আমাকেও আটকে দেবে।
পরীর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে এসব শুনে। বলল—যদি আনতে না-ই পারো, ঝামেলায় জড়িয়ো না। আমার গয়নাগাটি ফেরত নিয়ে, চলে এসো।
এমন মওকা কেউ ছাড়ে না কি? ভেড়া চলে গেল রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির ফটকে ঢোকার আগেই, রেশমের সূতো গলায় জড়িয়ে, নিজের রাজকুমার চেহারা ফিরে পেল ভেড়াটা। গটগট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
সোজা রাজকুমারির সামনে গিয়ে বলল—দ্যাখো তো, চিনতে পারো আমাকে?
কী করে চিনবে রাজকুমারি? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল অপরূপ সুন্দর যুবকটির দিকে। রাজকুমার বলল—আমি সেই ভেড়া, যে তোমাকে আমাদের খোঁয়াড়ে নিয়ে গিয়েছিল।
তারপর আর কী? রাজামশাই আসতে দিল না তাকে। আদর করে আটকে দিল রাজবাড়িতে। ধুমধাম করে ছোট রাজকুমারির সাথে বিয়ে হয়ে গেল রাজার ছেলের।
0 Comments