জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলে বয়ে চলা নদ-নদী /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯৮

জঙ্গলমহলে বয়ে চলা নদ-নদী

সূর্যকান্ত মাহাতো


"নদী নদী নদী
সোজা যেতিস যদি
সঙ্গে যেতুম তোর
আমি জীবন ভর।"(নদী/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, নদী যদি সোজা পথে যায় তাহলে তিনিও সঙ্গে যাবেন। কিন্তু কবির সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। কারণ নদী বাঁকা পথকেই অনুসরণ করে চলে। বাঁকা পথে চলাটাই তার ধর্ম। শুধু গতিপথটাই সাপের মতো বাঁকা নয়, গতিপথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে চলাটাও তার ধর্ম। কোথাও পুরনো পথ হারিয়ে ফেলেছে, কোথাও আবার নতুন পথে নতুন রূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। গবেষক নীহাররঞ্জন রায় তাই ঠিক কথাই বলেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে নদীর পুরাতন নামটি হারিয়ে গেছে, আবার নতুন নামেরও সৃষ্টি হয়েছে। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১২৭) জঙ্গলমহলে যে কয়েকটি প্রধান নদ-নদী রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'দামোদর নদ'। এই নদীর ঐরকম কত যে মরা খাত রয়েছে তার ঠিক নেই। কপিল ভট্টাচার্যও বলেছেন, "দামোদরের এরকম অনেকগুলো পরিত্যক্ত খাত রয়েছে।"(বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা, পৃষ্ঠা- ১৮) কিন্তু কেন এমনটা ঘটে? ঠুক কখন নদীর গতিপথের এইরকম পরিবর্তন ঘটতে পারে? প্রাচ্য বিদ্যার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, অনেক সময় ভূমিকম্পের ফলে এমনটা ঘটতে পারে, নয় তো নদীর পুরানো খাত বালি ও মাটি দ্বারা ভরাট হয়ে গেলেও নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে।(বিশ্বকোষ, নবম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫১১)

জঙ্গলমহলের বুক দিয়ে যে কয়েকটি প্রধান নদ-নদী কুলু কুলু করে বয়ে চলেছে তা তো কেবলই বয়ে চলা নয়। প্রতিটি মুহূর্তেই তারা নিজেদের অবদান জঙ্গলমহলের ভূপ্রকৃতি ও জনমানসে রেখে চলেছে। গবেষক নীহাররঞ্জন রায় বাংলার নদ নদী সম্পর্কেও এই সত্য কথাই বলেছেন, "এই নদ-নদীগুলি বাংলার প্রাণ। ইহারাই বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনো করিতেছে।"(বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১২৭) নদীগুলো কখনো কখনো যেমন আশীর্বাদ তেমনই আবার কখনো কখনো অভিশাপও হয়ে ওঠে। নদীর বৈশিষ্ট্যই এটা। কখনো বন্যা এনে যেমন পলিমাটির উর্বরতায় সোনা ফলায়, তেমনি অন্যদিকে ঘর বাড়ি ভেঙে ফেলে মানুষকে গৃহহীন ও পশুহীন করে তোলে। জঙ্গলমহলের নদীগুলি বেশিরভাগই এরকম বন্যা প্রবণ। হঠাৎ হড়কা বানে মাঝে মাঝেই প্রাণহানির আশঙ্কা ঘটে।

জঙ্গলমহল তথা বাঁকুড়া পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বুক দিয়ে যে কয়েকটি প্রধান নদী বয়ে চলেছে সেগুলো হল---
বাঁকুড়া জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী, শিলাবতী, গন্ধেশ্বরী, কাঁসাচর, জয়পান্ডা, শালি, বিড়াই ভৈরববাকি, কুমারী, ডাঙ্গরা, আমজোড়। 
পশ্চিম মেদিনীপুরের বুক দিয়ে বয়ে চলেছে, শিলাবতী, কংসাবতী (কাঁসাই) সুবর্ণরেখা, রসুলপুর, দ্বারকেশ্বর।
এদিকে পুরুলিয়া জেলায় যে তিনটি নদী রয়েছে কংসাবতী বা কাঁসাই, দ্বারকেশ্বর বা ধলকিশোর এবং শিলাবতী বা শিলাই এই তিনটি নদীরই উৎপত্তিস্থল হল পুরুলিয়া জেলা।

এদের মধ্যে অন্যতম হল 'দামোদর নদ'। প্রতি বছর প্রবল বন্যায় জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে প্রাণহানি ও ধন সম্পত্তি নষ্ট করত বলে তাকে 'দুঃখের নদ'ও বলা হয়। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের 'মনসামঙ্গল' কাব্যে এই নদীর কথা উঠে এসেছে। 'বেহুলার যাত্রাপথ' অংশে কবি ক্ষেমানন্দ বলেছেন,---
"প্রাণহীন পতি তার কোলে লখিন্দর
ভাসিয়া ভাসিয়া পাইল বাঁকা দামোদর।"
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের বর্ণিত 'বাঁকা দামোদর' যে 'দামোদর' নদেরই একটা অংশকে বোঝানো হয়েছে তার একটা অনুমান করেছেন নীহাররঞ্জন রায়। 'ফান ডেন ব্রোকের' একটি নকশা (১৬৬০) অনুযায়ী দামোদর নদের যে শাখাটি উত্তর-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে আম্বোনা কালনার কাছে ভাগীরথী নদীতে পড়েছে, তাকেই তিনি 'বাঁকা দামোদর' বলে অনুমান করেছেন। (বাঙ্গালীর ইতিহাস/ নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা- ১৩৪)  দামোদর নদের আবার দক্ষিণ বাহিনী প্রবাহ পথটি একসময় নাকি সরস্বতীর প্রবাহ পথ ছিল।(গ্রন্থ ঐ, পৃষ্ঠা- ১৩৫) সরস্বতী নদী সপ্তগ্রামে উৎপত্তি লাভ করে সোজা পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে দামোদর প্রবাহের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে যা 'বাঁকা দামোদর' সঙ্গমের কাছেই (গ্রন্থ ঐ,পৃষ্ঠা- ১৩৪। শুধু তাই নয়, 'দামোদর' ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে পুরুলিয়ার সীমারেখাও চিহ্নিত করেছে সাঁন্তালি থেকে পাঞ্চেত জলাধার পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ। বন্যা প্রবণ নদীগুলির মধ্যে দামোদর হল অন্যতম একটি। তার কারণ হিসাবে 'কপিল ভট্টাচার্য' বলেছেন, এই নদের উচ্চ উপত্যকার আয়তন নাকি অপেক্ষাকৃত বড়। তাছাড়াও বৃষ্টির জল নাকি এ অঞ্চলের শিলা, বালি, মাটিকে বহন করে এনে নদী গর্ভকে ক্রমশ উঁচু করে তুলে। (বাংলাদেশের নদ নদী ও পরিকল্পনা, পৃষ্ঠা ১৮)
🍂
নদী হল জীবনেরই একটা অঙ্গ। তাইতো নদীকে নিয়ে কতশত কবিতা ও সাহিত্য রচিত হয়েছে। সে রবি ঠাকুরের 'রূপনারাণের কূলে'-ই হোক আবার বিভূতিভূষণের 'ইছামতি' উপন্যাসই হোক। জঙ্গলমহলে প্রবাহিত নদীগুলিই সেখানে বাদ যায় কি করে! পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম দিয়ে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদীকে নিয়েও তাই কলম ধরেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক 'নলিনী বেরা'। তিনি নদীকে ঘিরে ও তার জনপদ নিয়ে রচনা করেছেন "সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা"। ২০১৯ সালে এই গ্রন্থটি 'আনন্দ' পুরস্কার সম্মানও লাভ করে। গবেষক নীহাররঞ্জন রায় নদ-নদীগুলোর নামকরণ নিয়ে বলেছেন, নদীগুলোর প্রকৃতি অনুযায়ী লোকে রাক্ষসী বা কীর্তিনাশা বলে যেমন গাল দিয়েছেন, তেমনি ভালোবেসে সুন্দর সুন্দর নামও রেখেছেন। 'সুবর্ণরেখা' নামটিও সেরকমই ভালোবেসে সুন্দর করে রাখা একটি নাম। এই নদীতে নাকি স্বর্ণ রেণু পাওয়া যেত এক সময়। সেই থেকে নদীর নাম 'সুবর্ণরেখা'। সাহিত্যিক 'নলিনী বেরা' এই নদীর কথা খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন তার "সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা" গ্রন্থে---
"শোনা যায় এ’নদীর বালিতে নাকি কোনো সময় সোনার রেণু মিলতো, সেই থেকেই এই নাম! কোনো মধ্যমানের মালভূমি থেকে বেরিয়ে নানা গ্রাম্য জনপদের পাশ দিয়ে বইতে বইতে এই নদী সাগরে গিয়ে মিশেছে নীরবে। এই অবোলা নদীটির কপালে জোটেনি কোনো হিমবাহ বা তুষারশৃঙ্গের আশীর্বাদ, মাত্র চারটি রাজ্যের মাটি ছুঁয়েই এর যাত্রা শেষ। এ পাড় ভাসায় না, এতে জাহাজও চলে না; পণ্যবাহী নৌকা আর প্রান্তিক মানুষজনকে পারাপার করিয়েই এর দিন কাটে। তবে স্মৃতিতে, গীতিতে, গল্পে-কাহিনীতে থেকে যায় সেই সোনার স্মৃতি। হীরে-জহরত, চূনি-পান্না নয়, সোনা-রূপোর আকরিকও নয় শুধুই গুঁড়োগুঁড়ো সোনা। যা মিশে থাকতো বালিতে। ভাগ্য সহায় থাকলে পরিশ্রমী কোনো কোনো মানুষ খুঁজে পেতো সেই সোনা..."(সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা/নলিনী বেরা)

তবে উৎপত্তিগত ভাবে একেবারে জঙ্গলমহলের নিজস্ব নদীর কথা যদি ধরতে হয়, তাহলে তিনটি নদীর কথা উল্লেখ করতেই হয়। কংসাবতী বা কাঁসাই, দ্বারকেশ্বর বা ধলকিশোর, এবং শিলাবতী বা শিলাই। এই তিনটি নদীই পুরুলিয়া জেলায় উৎপত্তি লাভ করেছে। এবং জঙ্গলমহলের জেলাগুলি দিয়ে বয়ে চলেছে। কাঁসাই নদীর জন্ম,'জাবড় পাহাড়'। যেটি ঝালদা থানার অন্তর্গত। আবার দ্বারকেশ্বর নদীর উৎপত্তিস্থল হল আদ্রা ও হুড়ার মাঝের একটি ঝিল। এই দ্বারকেশ্বর নদীই ঘাটালে শিলাবতীর সঙ্গে মিশে 'রূপনারায়ণ' নাম নিয়েছে। শিলাবতী নদীর উৎপত্তি স্থল হল পুঞ্চার এক উচ্চভূমি। এই নদীটি আবার দ্বারকেশ্বর নদীতে গিয়ে পড়েছে। এই তিনটি নদীরই বৈশিষ্ট্য হল, গ্রীষ্ম ও শীতকালে এদের খাত মরা থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে এদের রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। দুকুল ছাপিয়ে তখন হড়কা বান (flash flood) প্রবাহিত হয়।

কেবল জলের যোগান নয়, সারা বছর ধরে ঋতু অনুযায়ী ছোট থেকে বড় মাছও পাওয়া যায়। এখন তো আবার নদীর বালি সোনার থেকেও দামি হয়ে উঠছে। পৌষ মাসে মকরের সময় নদীগুলোর বুকেই বসে জঙ্গলমহলের সব থেকে বড় মকর পরবের উৎসব। নদীকে দেবদেবী জ্ঞানে পূজাও করা হয়। নদীকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। দামোদরে অনেকে অস্থি বিসর্জনও দেন। সুতরাং নদীগুলোর অবদান তাই অনেক।

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments