জ্বলদর্চি

প্রাত্যহিকীর প্রাঙ্গণে /সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাত্যহিকীর প্রাঙ্গণে

সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়
            
আকাশবাণী কলকাতা -এই নামটি উচ্চারণ এর সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আপামর বাঙালির। ৯২ বছর ধরে এই প্রচার মাধ্যম তার নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা মনোরঞ্জন করে চলেছে পশ্চিমবাংলা বাসীর। বর্তমানে ডিটিএইচ পরিষেবার মাধ্যমে তা সারা বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশবাণী মানেই নাটক, মহিলা মহল,শিশুমহল, সংগীত শিক্ষার আসর, সংবাদ, খেলার ধারাবিবরণী, অন্বেষা, অনুরোধের আসর, যাত্রা কিংবা বিবিধ ভারতী যুববাণী কলকাতা গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা,এফএম চ্যানেল। আমাদের অনেকের কাছেই বাবা-মা বা শিক্ষক শিক্ষিকার মত আকাশবাণী। নান্দনিকতা এবং ঐতিহ্য এই দুইয়ের বোধের মেলবন্ধনে  সে আজও সুস্থ সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা নিয়ে উজ্জ্বল।

প্রতিদিন সকালে এমনই এক সৃষ্টি সুখের উল্লাস নিয়ে কোলকাতা গীতাঞ্জলি প্রচার তরঙ্গ (পূর্বতন কলকাতা ক)তে হাজির হয় প্রাত্যহিকী। প্রতিদিনের বিশেষ কিছু তাৎপর্য, কলকাতার নানা স্থানে কোথায় কি অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে, দেশ বন্দনায় দেশাত্মবোধক গান, ট্রেন পৌঁছানোর খবর, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং -এই এবং টি নিয়েই   কথা বলব। প্রতিমাসে দুটি পক্ষ দুটি বিষয়। সেই বিষয় নিয়ে শ্রোতারা চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পাঠ হয় প্রত্যেক পক্ষে। একজন সেরা পত্রকার নির্বাচিত হন। যে মাসে তিনি সেরা হন তার পরের মাসে সেই পক্ষেই তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়, পুনরায় প্রচারিত হয় তাঁর সেই চিঠিখানি এত গেল এখনকার কথা কিন্তু কি ভাবে শুরু হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান সেও ভারী আকর্ষণীয় গল্প।

১৯৮০ র এপ্রিল মাস। বাংলা ১৩৮৭ সাল পয়লা বৈশাখ। শুরু হলো প্রাত্যহিকী। তারপর ১৯৮৪সালের ৭  এপ্রিল থেকে প্রাত্যহিকীর  পরিবর্তন শুরু হয়। প্রত্যেক মাসে একটি করে বিষয় দেওয়া হতো এবং সেই বিষয়গুলির ভিত্তিতে শ্রোতারা চিঠি লিখতেন। আকাশবাণী কলকাতা বলতেই যে স্বর্ণ কন্ঠ গুলি আমাদের কানে ভাসে সেই কন্ঠে প্রচারিত হতো এসব চিঠি। এভাবে চললো ১৯৯৬ সাল অবধি। তার পর প্রত্যেক মাসে পক্ষে দুটি বিষয় দেওয়া হতো। পশ্চিমবাংলা এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে অগণিত শ্রোতা শুরু করলেন চিঠি পাঠাতে। পত্র লেখক লেখিকাদের আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা সেসব চিঠি যখন প্রচারিত হতে লাগলো  বেতারে আনন্দে ভেসে যেতে শুরু করলেন লেখক-লেখিকারা। একে অপরের কাছাকাছি চলে আসতে থাকেন তাঁরা। একটি চিঠি যেন রচনা করত এক একটি সেতুর যার দ্বারা বেতারের ওপ্রান্তে উপস্থাপক উপস্থাপিকা এবংএপারের পত্রকারদের  পারস্পরিক যোগাযোগ হতে শুরু করল।

ঠিক এই ভাবনাটা থেকেই শুরু হলো প্রাত্যহিকী সম্মেলন। ভাবছেন তো এ আবার কেমন সম্মেলন। প্রাত্যহিকী তে ৯থেকে ৯০ সব বয়সের মানুষ লিখে থাকেন.।সদা ব্যস্ত ডাক্তার বাবু, প্রথিতযশা অধ্যাপক, ডাকসাইটে শিক্ষক, ছোট বড় ব্যবসায়ী, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, দশটা-পাঁচটার কলম পেষা হরিপদ কেরানি কিংবা অবসরপ্রাপ্ত মানুষ সকলেই স্বমহিমায় উপস্থিত।প্রাত্যহিকীর এই বিস্তীর্ণ অঙ্গণে।  এই মানুষগুলিকে পারস্পারিক পরিচিতি করানোর জন্য প্রাত্যহিকী সম্মেলনের সূচনা। সে আজ ২৬ বছর আগের কথা। উত্তর ২৪ পরগনায় খড়দাতে  বাস করতেন প্রাত্যহিকীর লেখক ও শ্রোতা করবীবরণ মুখোপাধ্যায়। তার বাড়ির নাম ভুবন ভবন। ভুবন ভবনের এই বাসিন্দা প্রাত্যহিকী ভুবনকে একত্রিত করার কাজটি করলেন। স্থানীয় একটি সংস্কৃতি পরিষদ এর দুই দিন ধরে চলা বার্ষিক অনুষ্ঠানের একটি দিন ধার্য করলেন প্রাত্যহিকীর বন্ধুদের জন্য। শুরু হলো প্রাত্যহিকীর মিলন মেলা। লেখক লেখিকা ছাড়াও উপস্থাপক উপস্থাপিকা এবং অগণিত শ্রোতা  উপস্থিত থাকতেন এই উৎসবে। পরিচয়পর্ব, সাহিত্য আলোচনা, সংগীত পরিবেশন, পারস্পরিক চিন্তার আদান-প্রদান এসব নিয়ে প্রাত্যহিকী সম্মেলন পরিণত লো সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালির চতুর্দশ পার্বণে।
২৫বছর ধরে চলছে এই সম্মেলন। ডা.অসিত দত্ত.,দেবেন বিশ্বাস, নন্দ দুলাল রায় চৌধুরী, প্রকাশ বিশ্বাস, শিশির কুমার ঘোষ, ডা.পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী ধারাবাহিকভাবে একক উদ্যোগে প্রাথমিক সম্মেলন সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন।  ২০০৪সালে গঠিত হলো সর্বজনীন প্রাত্যহিকী সম্মেলন পরিচালন সমিতি। 
🍂
বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ ক'জন দায়িত্ববান লেখক লেখিকা যুক্ত হলেন সেই কমিটিতে। আরো সুষ্ঠুভাবে প্রাত্যহিক সম্মেলন সংঘটিত হতে লাগল। খড়দহ থেকে দুর্গাপুর, হরিপাল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন, কৃষ্ণনগর থেকে শ্রীরামপুর, শ্যামনগর থেকে বালি কোথায় না কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সম্মেলন। মার্চ মাস থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ছাপানো হয় আমন্ত্রণপত্র, পাঠানো হয় লেখক লেখিকাদেরবাড়ির ঠিকানায়। আকাশবাণী রপ্রাত্যহিকীতে  দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন। তারপর শারদীয়া দুর্গাপূজা, শ্যামা পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজার পালা সাঙ্গ হলে একদল প্রাত্যহিকী প্রেমী মানুষ ভিড় জমান প্রাত্যহিকী সম্মেলনে র খোলা ছাদের তলায়।দিনভর খাওয়া-দাওয়া, গল্পগাছা, গান বাজনা, ক্যুইজ কি না থাকে এখানে। প্রকাশিত হয় লেখক লেখিকাদের প্রাত্যহিকীতে  পঠিত চিঠি শ্রুতিলেখা। সম্মেলনের টানে মেদিনীপুরের ফুল কুমার বেরা রাত থাকতে উঠে প্রস্তুতি নেন আসবার জন্য। কৃষ্ণনগরের ইনাসউদ্দিন আর বীরভূমের আশিস কুমার চিত্রকর একই থালা থেকে ভাগাভাগি করে খাবার খান শ্রীরামপুরের নন্দিতা সিনহার আবৃত্তি শুনে তারিফ করেন বাংলাদেশের জগন্নাথ নন্দী। প্রীতি সম্মেলনে নতুন নতুন ভাইয়ের সন্ধান করে রাখি পাঠান মেমারীর তপতী বর্মন। পান্ডুয়ার একই পরিবারের তিন প্রজন্মের তিনজনের লেখা সম্বলিত শ্রুতিলেখা  নিয়ে গর্ববোধ করেন। যখন বাঁকুড়ার সাধন মুখোপাধ্যায় গান ধরেন হয়তো তোমারি জন্য কিংবা  ডা.অভয় সামন্ত গুন গুন করে বলে ওঠেন আমাদের প্রাত্যহিকী সম্মেলন ও সে সব হতে আপন তখন পরিতৃপ্ত হন সকলে।

প্রতিমা বিসর্জনের পর একদল মানুষ যেমন কঠিন প্রতিমার কাঠামো তুলে আনেন পরের বারের পুজোর প্রস্তুতির জন্য তেমনই এক সম্মেলন শেষ হলে শুরু হয়ে যায় অপর এক সম্মেলনের প্রস্তুতি। যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে কি করে আরো ভালোভাবে করা যায় সেই ভাবনায় মশগুল থাকেন কমিটির লোকেরা। এখন যখন চারদিকে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে তখন আকাশবাণীর প্রাত্যহিকী অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই যে পরিবার গড়ে উঠেছে তা যেন আরো দৃঢভাবে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। একে অপরের পাশে সারা বছর ধরে সুখে দুঃখে থাকবার আরেক নামই তো প্রাত্যহিকী পরিবার উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন ২০২৩ এর সর্বজনীন প্রাত্যহিকী সম্মেলনের আসর বসবে আগামী ২৬নভেম্বর ২০২৩ রবিবার হুগলির চন্দননগর খলিসানী বিদ্যামন্দিরে।প্রকাশিত হবে শ্রুতিলেখা। সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি চলা সেই আনন্দ যজ্ঞে শামিল হবার আমন্ত্রণ রইল সকল বেতারপ্রেমীর।। বেতারের একটি অনুষ্ঠান ঘিরে দূর-দূরান্তের মানুষেরএই ভরপর  আবেগ দেখে মনে হবেই 

এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু কত রঙ্গে ভরা।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇



Post a Comment

0 Comments