জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৪ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৪
সুমিত্রা ঘোষ

যাইহোক রানি রাসমণি জলপথে কাশী যাত্রা করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল জানবাজারের জমিদার বাড়ির পক্ষ থেকে। সেই মত গোছগাছ শুরু করা হয় এবং নিখুঁতভাবে শেষ হয়। পঁচিশখানি বজরা সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। পাঁজি-পুঁথি দেখে রানির কাশী যাওয়ার দিন স্থির হল। এ যেমন-তেমন লোকের কাশী যাওয়া নয় কলকাতার বিখ্যাত ধনী জমিদারনী রাসমণির কাশী যাওয়া বলে কথা। রানির সঙ্গে মথুরামোহন বিশ্বাস এবং তাঁর স্ত্রী জগদম্বা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জগদম্বার চরিত্র ভিন্নরূপ। যেমন সেযুগে লেখাপড়া শিখেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এতটুকু উচ্ছৃঙ্খলা প্রকাশ পেত না। মাতৃদেবীকে শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে সেবাযত্ন করতে কখনও গাফিলতি দেখায়নি। মেজদিদি করুণাময়ীর পুত্রকে পুত্রস্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছে। এই পুত্রের বিয়ের পর বউমা প্রসন্নময়ীকে কন্যা স্নেহ উজাড় করে দিয়েছেন জগদম্বা। স্বামী মথুরকে স্বামীজ্ঞানে যথোপযুক্ত ব্যবহার প্রদর্শন করেছেন। মা রানি রাসমণির মত ঠাকুরদেবতায় জগদম্বার অচলাভক্তি ছিল। রানি  রাসমণি যখন, কাশী যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন তখন জগদম্বা গৃহে অন্নপূর্ণা পূজা সমাপ্ত করেছেন। তাঁর অভিলাষ হল সঙ্গে কাশী গিয়ে ওখানে অন্নপূর্ণার ঘট বিসর্জন দেবেন। প্রিয় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানানো হচ্ছে, জগদম্বা কলকাতার ব্যারাকপুরে অন্নপূর্ণার মন্দির স্থাপন করিয়েছিলেন। তিনি অন্নপূর্ণার বিশেষ ভক্ত ছিলেন।
🍂
রানি রাসমণির কাশী যাত্রার দিন স্থির হয়ে গেল। উল্লেখ করা প্রয়োজন রানির কাশী যাত্রা প্রসঙ্গে দু-রকম মতভেদ  আছে।  এক মতে বলা হয় কাশী যাত্রার আগের দিন রানি স্বপ্ন দেখলেন, মা ভবতারিণী এসে বলছেন, ওরে তোর কাশী যাওয়ার দরকার নেই। এই গঙ্গার (ভাগীরথীর) তীরে মনোরম একটি জায়গায় আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা কর।আমি এই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে তোর নিত্য পূজা গ্রহণ করব। মা এই মূর্তি মানে বলতে চেয়েছেন  যে মূর্তিতে স্বপ্নে রানিকে দেখা দিয়েছেন।

আবার অন্য মতে জানা যায় রানি রাসমণি সমভিব্যাহারে বজরায় চেপে কাশী যাত্রা করেছেন এবং প্রথম দিন রাত্রিবাস কালে রানি স্বপ্ন দেখেন মা ভবতারিণী আবির্ভূত হয়ে রানিকে বললেন, তোর কাশী যাওয়ার দরকার নেই তুই ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূলে আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা কর। আমি এই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে তোর নিত্যপূজা গ্রহণ করব। স্বপ্ন দেখার পর রানির মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দেওয়ায় মথুরাবাবু, জগদম্বা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা উদ্বিগ্ন হলেন । এতবড় বিশাল আয়োজন করে রানি তীর্থযাত্রা করলেন এখন রানি বলছেন কাশী যাবেন না।

জানা যায়, স্বপ্ন দেখা রাত্রে রানির বজরা কলকাতার উত্তরে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত গিয়ে ওখানে রাত্রিবাস করার জন্য বজরা থামানো ছিল। দৈব নির্দেশ পেয়ে রানি কাশী যাওয়া বন্ধ করে জানবাজারে, ফিরে যাবেন বলে ঠিক করলেন । অন্যান্য সকলে আশ্চর্যান্বিত হলেও রানির স্বপ্নের কথা শুনে কেউ কিছু বলতে সাহস পেলেন না। মথুরামোহন সেই সময় ঠাকুর দেবতা বিশ্বাস করতেন না। পরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে এসে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-বিশ্বাস লাভ করতে থাকেন। অতএব রানি যখন জানবাজারে ফিরে যেতে চাইলেন তখন মথুরাবাবু নিজে ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হলেও রানির কথাকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁর মত সমর্থন করেছেন। জগদম্বার সাময়িকী মন খারাপ হয় কারণ সে আশা করেছিল কাশীতে অন্নপূর্ণার ঘট বিসর্জন দেবে সেই আশা অপূর্ণ রয়ে গেল। তবে জগদম্বা জীবনে কখনও মায়ের মতের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, সেদিনও করেনি।
ক্রমশ

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
 

Post a Comment

0 Comments