জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক চিন্মোহন সেহানবীশ/ নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক চিন্মোহন সেহানবীশ 
                 
নির্মল বর্মন

প্রখ্যাত  প্রাবন্ধিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, ও ইতিহাসবিদ্ এবং চিন্তানায়ক চিন্মোহন সেহানবীশ ‘প্রগতি লেখক সংঘ'-এর  প্রধান সংগঠক এবং ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ'-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ । ৮ ই ডিসেম্বর ১৯১৩ সালে পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। আদিবাস  বাংলাদেশের রংপুরে হলেও পিতার কর্মক্ষেত্র লাহোরে জন্ম হয়েছিলেন। পিতা অধ্যাপক বিনয় মোহন। রানীগঞ্জ স্কুল থেকে বৃত্তিসহ মেট্রিক পাশ করেন পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এস.সি পাস করেন। 
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করেন। হিন্দুস্থান কর্পোরেশনের চাকরি করতেন পরে বুক ম্যান প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে বুক ম্যান ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং হাউস এর সাথে মিলিত হওয়ার ফলে সুনাম অর্জিত হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, সেই সময় প্রেসিডেন্সি জেল  ও বক্সা দুর্গে বন্দী শিবির কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি পান। শিক্ষাব্রতি ও সমাজসেবিকা উমা সেহানবীশ তাঁর সুযোগ্য পত্নী ছিলেন। ৭০ বছর বয়সে ১৯৮৭ এর ১৯শে মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
           প্রাবন্ধিক সেহানবীশ পরিচয়' সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন । বিগত শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকে নামডাক সম্পন্ন ‘অগ্রণী’, 'নতুন সাহিত্য’, ‘আন্তর্জাতিক’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত প্রগতিশীল সাহিত্য সমালোচনামূলক রচনা লিখতেন। প্রাবন্ধিক "রবীন্দ্রনাথ" সম্পর্কে সমাজ সচেতন প্রাবন্ধিক বিশেষ আগ্রহ ও যত্নসহকারে পড়াশুনা করতেন।  গান্ধীজির আদর্শ কৈশোরকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। অব্যবহিত পরে মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হন এবং ১৯৪১-এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করে‌ পাক্কা কমিউনিস্ট বনে যান।
🍂
কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.  ( অর্থনীতি) পাশ করেছিলেন । কিন্তু গবেষক  চিন্মোহন সেহানবীশ মহোদয়ের গবেষণার বিষয়  "ইতিহাস"।  প্রাবন্ধিক সেহানবীশ এর তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে "মুক্তি সন্ধানে ভারত" গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সারস্বত সমাজে শোরগোল পড়ে যায় ।
       প্রাবন্ধিক, গবেষক চিন্মোহন সেহানবীশ রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল :-
     "লেনিন ও ভারতবর্ষ",  "রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক চিন্তা", "রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ'', "রুশ বিপ্লব ও প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী"  ," দুই শতাব্দীর বিপ্লব", "সোভিয়েত বিজ্ঞান", "৪৬ নং নম্বর একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে" প্রভৃতি। এছাড়াও কয়েকটি ইংরেজি গ্রন্থ হল:-
 " What is communism", "Fifty year of communist press"   ও "Tagore and the world"! ইত্যাদি।
 ‌    বুদ্ধিজীবী চিন্মোহন সেহানবীশ সারাজীবন রবীন্দ্রভক্তানুরাগী , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক ভাবনা চিন্তা নিয়ে গবেষণালব্ধ গ্রন্থ রচনা করে বাংলার সারস্বত সমাজকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।১৯৬৯ এর অক্টোবরে ‘বহুরূপী' পত্রিকায়   সেহানবীশ বাবুর নাট্য বিষয়ক প্রবন্ধ "নবান্নের পৃষ্ঠপট" প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্ৰাম বাংলার মানুষ মনোনিবিষ্ট । "নবান্ন " নাটকের অভিনয়ের সমালোচনার অন্তিম পর্বে 'গণনাট্য' সম্পর্কে মূল্যবান মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : - 
 “ 'গণনাট্য সংঘ' প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সোভিয়েত সুহৃদ সংঘ, 'ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে'র উদ্যোগে ও নতুন নাটক অভিনয়ের কিছু কিছু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা একটা নতুন নাট্য- আন্দোলন শুরু করার জন্য ততটা নয়, যতটা উদগ্র প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে মানুষের কাছে সব থেকে হৃদয়গ্রাহী পন্থায় তুলে ধরার। ...নাটক তথা আর্টের ভবিষ্যৎ মানুষ আর মানুষের রাজনীতির পথেই।”
"বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৫" এর 'পরিচয়' পত্রিকায় "কার জন্য লিখি"?  - প্রবন্ধে  প্রাবন্ধিক চিন্মোহন  'কাদের জন্য কীভাবে লিখবেন' তা বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। বুদ্ধিজীবী  চিন্মোহন সেহানবীশ এর সাহস মন্দ নয়, "মাও সেতুং" -এর বক্তব্যকে স্মরণ  ও পাথেয় করে প্রাবন্ধিকের মন্তব্য গ্ৰহনযোগ্য: --
  “নতুন সাহিত্যের পাঠক হবে মজুর, কিসান, সৈনিক ও মধ্যবিত্তশ্রেণী—বিশেষ করে প্রথম তিনটি দল—তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন যে এঁদের জন্য লিখতে হলে ভালো করে এঁদের জানতে হবে—অভ্যস্ত মধ্যবিত্তসুলভ ধ্যানধারণা ও অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে হবে।”
সমাজমনস্ক গবেষক সেহানবীশ যে মানুষগুলির কথা লিখেছিলেন এবং যাঁদের জন্য লিখেছিলেন তাঁদের সঙ্গে লেখক ও সাহিত্যিকের সংযোগ থাকা জরুরি , এবং সেই সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং উপযুক্ত প্রকাশভঙ্গি আয়ত্ত্ব করাই  আসল ভাবনা —একথা প্রাবন্ধিক অকপটে স্বীকার করেছেন। তাই চটজলদি প্রাবন্ধিক, গবেষক ও বুদ্ধিমানব্যক্তিত্ব সেহানবীশ লিখে ফেলেছেন:-
      “বাঙালী মধ্যবিত্ত লেখক যখন আপন দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর ঘটিয়ে অগণিত পাঠক সাধারণের স্বীকৃতির মধ্যে তাঁদের নবসৃষ্টির সার্থকতা খুঁজবেন তখন তারাও নিশ্চয়ই একটা সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যিক শূন্যতা থেকে শুরু করবেন না। 'কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা অর্জন' করে 'কিষানের জীবনের শরিক' হওয়ার চ্যালেঞ্জ তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই দিয়ে গেছেন তাঁদের সামনে।”
 প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য বর্তমান সময় ও সমাজের কবি সাহিত্যিক ও সম্পাদক দেবাশিস প্রধান মহোদয়ের মন্তব্য আদরণীয়:-
           "প্রাবন্ধিক চিন্মোহন সেহানবীশ স্বচ্ছ ও মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে  তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলির প্রকাশভঙ্গির অনবদ্যতা পাঠককে বিমোহিত ও গুনমুগ্ধ করেছে। তথ্যসমৃদ্ধ, যুক্তিনির্ভর প্রবন্ধগুলির  সরস রূপ ও ভাবনা পাওয়ায় সাহিত্যগুণ যথার্থ সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছে"!
 ‌‌          পরিশেষে প্রাবন্ধিক চিন্মোহন সেহানবীশ সারাজীবন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করেছেন, প্রচুর পরিমাণে সমাজ , সংস্কৃতিওৎ বিনোদন নিয়ে কাজ করেছেন,বেশ কয়েকটি মূল্যবান ও কালজয়ী বাংলা ও ইংরেজি গ্ৰন্থ রচনা করেও কালের অমোঘ আকর্ষণে পর্দার ভিতরে অর্থাৎ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হলেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪


Post a Comment

0 Comments