জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি --২/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

অমলতাস

বার্লিনের ডায়েরি --২
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

সময়ের স্রোতে অনেক গুলো দিন মাস পার হয়ে বছর ও ভেসে গিয়েছে। তবু ছবির মত মনে পড়ে বর্ধমানের এই শহরে অদ্রিজার ইউনিভার্সিটি তে MSC ক্লাসে ভর্তি হয়ে হোষ্টেল জীবনের সেই শুরুতে প্রথম আসার দিন টিকে। তখন প্রকৃতির পান্থশালা থেকে বসন্ত বিদায় নিলে ও তার রেশ রেখে গিয়েছিল নিঝুম আকাশের আঙিনায় পথে প্রান্তরে, গাছের ডালের সবুজের সোহাগে। সেই মরশুমে চারদিকে রক্তিম রাগে লালে লাল হয়ে ভুবন মেতে ছিল কৃষ্ণচূড়া শিমূল পলাশের সাথে হোলী খেলায় অমলতাসের বাসন্তী বাহারে। কৃষ্ণচূড়ার আবীর লালের সাথে মিশেছিল রাধাচূড়ার হলুদ । গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সারল্য ,মফস্বল শহরের জাঁক জমক হীন সাধারণ জীবন মনের মাঝে এক অদ্ভুত প্রাপ্তির ভালোলাগায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

 শ্রীময়ীর অনুভূতিতে পরশ লাগে। কত দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ দৃশ্যতে মন জেগে ওঠে । শস্য সবুজ ফসলের ক্ষেত , উন্মুক্ত মাঠ প্রান্তরের শেষ সীমানায় তাল তমালের সঙ্গীহীন নীরবতা , বৈশাখীর ঝড়ে এলোমেলো গাছগাছালি , কত বিচিত্র রঙ্গীন পাখির কলরবে ঘুম মোছা চোখে সকালের আলোয় দিনের শুরু। ঋষভ বলে এই আমাদের নিজের দেশ। মাতৃভূমির মত শান্ত স্নিগ্ধ অপরূপ কোমলতার স্পর্শ পৃথিবীর আর কোথাও গেলে কি ঠিক এমন টাই খুঁজে পাবো ? আজকাল পরবাসী হয়ে দিন কতক অন্যত্র কাটাতে ও ওর প্রবল অনীহা।   

 তিতিরের  MSC র final year এর সময় এখানে মাঝে মাঝেই কাটিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি  দিনের স্মৃতিরা শ্রীময়ীর খোলা জানলায় উঁকি দিয়ে যায়। সে সময়ে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে প্রায়ই ভোরের বেলায় সূর্যালোকের এক কলস তরল সোনা গড়িয়ে পরা টৈটুম্বুর রানী সায়রে ছোট্ট ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে জেলে দের মাছ ধরা দেখতে কত যে ভাল লাগতো। গোধূলী শেষে সন্ধ্যে নামলে সায়রের বুকে বাতাস কাঁপিয়ে  দূরান্তে প্রতিধ্বনিত হতো মাঝিদের গলায় ভাটিয়ালী গানের সুর। সাদা হাঁস গুলোর দল বেঁধে লাইন দিয়ে সায়রের জলে সাঁতার কেটে অদ্ভুত প্যাক প্যাক শব্দ করে জলে ভেসে বেড়িয়ে আপন মনে ঘরে ফেরা।

ঋতু পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলার পল্লীগ্রাম গুলোর এমন আন্তরিক মায়াময় সৌন্দর্য খেয়ালী বৈচিত্র্যের প্রকাশ আর কোথায় দেখেছে ? মনে পড়ে না। পৃথিবী ব্যাপী পরিবর্তনের ঢেউয়ে ভেসে কেমন আছে এখন সে শহর ?  
                                                                                    রাজবাড়ির ক্যাম্পাসে বড়ো ঝিল টার পাশ দিয়ে গাছেদের ছায়ায় পা চালিয়ে শাল মেহগিনী সেগুনের বাগান পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির ভিতরে কখন ঢুকে পড়েছে খেয়াল নেই। আশপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে প্রাসাদের মত বাড়িটার বিশাল চত্বর পার হয়ে পুরোনো দেওয়াল অলিন্দর সোঁদা গন্ধে মন ডুবিয়ে ,সব ডিপার্টমেন্টে উঁকিঝুঁকি দিতে গিয়ে  শ্ৰীময়ীর হঠাৎ খেয়াল হয় ,ইউনিভার্সিটির সাইন্স বিল্ডিং গোলাপবাগে।  অটো নিয়ে গোলাপবাগের সাইন্স ক্যাম্পাসে পৌঁছে বিশাল প্লে গ্রাউন্ড পেরিয়ে ইউক্যালিপ্টাসে ঘেরা করিডোরের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছলে প্রফেসার দিব্যেন্দু বোসের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরীর বিশাল কক্ষটিতে। যেখানে শুধুই রয়েছে চোখ ধাঁধানো পাহাড় প্রমান বইয়ের সংগ্রহ।

 প্রফেসারের সাথে কথাবার্তা কুশল বিনিময়ের পর বইপত্র জমা দিতে বেশী সময় লাগেনি। তিনি ছাত্রী টি কে মনে রেখেছেন এবং তার সাফল্যে শিক্ষকের যে কত আনন্দ ,সে কথা ও জানালেন। বার্লিনের প্রসঙ্গ উঠলে শ্রীময়ী অকপটে বলে যায় তিতিরের কাছে শোনা,স্কাইপে দেখা ছবির গল্প। স্নো ফল ,বার্লিন ওয়াল   রাস্তা ঘাট ,ঘর বাড়ির সাথে হিমেল মৃদু বাতাসে শান্ত স্প্রী নদীর ছলাৎ ছল বয়ে যাওয়া ,তীরে বসে আড্ডায় মশগুল ইয়ংষ্টার ছেলে মেয়েদের কলকোলাহল। ড্রাম গীটার স্যাক্সোফোন বাজিয়ে সংগীত চর্চা ও ঘর ছাড়া কলেজ পড়ুয়াদের দলের গল্প ,এক স্বাধীন মুক্ত জীবনের ছবি। যেন নিজেই সেখানে কতবার বেড়িয়ে এসেছে ।
রানিসায়র

 ওর মাতৃ হৃদয় অদ্ভুত এক আত্মতুষ্টিতে ভরে ওঠে। নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবে বিস্মৃত প্রায় অতীতে মনের অবচেতনে একদিন কত রামধনু রাঙা স্বপ্ন আঁকা ছিল।নাগালের বাইরে তারা ভেবে কোনোদিন হাত বাড়ায় নি।পরিস্থিতির ঘন কালো মেঘে সে রঙ চাপা পড়ে ধূসর মলিন হয়ে গিয়েছে।  কিন্তু তিতির এ যুগের মেয়ে। ওরা সাহসী অকুতোভয়ী ,ওরা পারবে অসাধ্য সাধন করে এগিয়ে যেতে। সেই আশায় সর্বস্ব পন করে ওর এগিয়ে চলায় নীরবে পাশে থাকতে পেরেই  শ্ৰীময়ীর খুশির অন্ত নেই। ঝরা বকুলের সুগন্ধ নিয়ে নিজেকে মাতিয়ে রাখে।

 চেনা শহরে টাতে নিজের মত সারাদিন কার্জনপার্ক , রাজবাড়ি ,রানীসায়র ,গোলাপবাগ ,ডিয়ার পার্কে ঘুরে বেড়ানোর পর এবার ঘরে ফেরা। অনেক গুলো সিঁড়ি পার হয়ে  ওভারব্রীজের ওপর উঠে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকে ডাউন বর্ধমান লোকালের ঘোষণার অপেক্ষায়, কোন প্লাটফর্ম থেকে কখন ছাড়বে মেন লাইনের ট্রেন টি। 
🍂
    ওর ব্যাকুল হৃদয়ে  চিন্তার শেষ নেই। বেপরোয়া অবাধ্য মন একাকী পাগলা হাওয়ায় কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে স্বর্গ রচনায় মেতেছে। এমন যদি হতো নীল আকাশের অসীম শূন্যের গায়ে পাখা মেলে ওড়া বলাকার মত  নিষেধের বাঁধার সীমানা পেরিয়ে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে নিমেষে পৌঁছে যেত আরএক মহাদেশের দ্বার প্রান্তে। যেখানে অদ্রিজার ঘরের দক্ষিণ খোলা ছোট্ট ব্যালকনিতে পৌঁছে টুকটুক করে বন্ধ জানলার কাঁচে টোকা মারতো। নয়তো দরজায় ঝনঝনিয়ে কড়া নেড়ে চমকে দিতো তিতির কে।  

পরন্ত বেলার  নির্মল আকাশে  চলছে ঘুড়ির লড়াই। এতো উঁচুর থেকে ও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাঁদিকের ধুঁধুঁ মাঠ দিগন্ত রেখায় যেখানে আকাশের নীল ,মাটির অনন্ত সবুজের সাথে মিলেমিশে আছে সেখানে প্রকান্ড এক পেটকাটি ঘুড়ির তলে লেজ জুড়ে  মাঞ্জা দেওয়া সূতো হাতে আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ছুটছে কিশোরের দল। আঙুলের কারসাজিতে অবাধ গতিতে  ভাসছে  চাঁদিয়াল ,ময়ূর কন্ঠি ,মোমবাতিরা। উর্দ্ধমুখী হয়ে অমন উঁচুতে তাকিয়ে থাকতে ওদের ক্লান্তি নেই।  শ্রীময়ীর মনে হয় এই বুঝি গোত্তা খেয়ে নীচের দিকে ঘাড় মটকে পড়বে। অথবা ভোকাট্টা হয়ে  ইলেক্ট্রিকের তারে বা গাছের মগ ডালে লটকে থাকবে । হাওয়ায় বারেবারে ঠোক্কর খেয়ে উড়তে গিয়ে এক সময় ছিঁড়ে হয়তো লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। ঘুড়ির মালিকের হাতে সূতোর লাটাই ,সবাই প্যাঁচ খেলতে চায়। কে কোথা দিয়ে টান মেরে কাকে ধরাশায়ী করবে ,কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে জল্পনা চলে --আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর কৈশোর থেকে সদ্য যুবক ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া ধারালো সূতো হাতে প্যাচ খেলুড়েরা ।    
                                                                                    আকাশের দিকে তাকিয়ে দুঃস্বপ্নেরা ভীড় জমায় শ্রীময়ীর চেতনায় , এক তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসে। এমন পূর্ণ স্বাধীনতায় উড়তে থাকা ঘুড়ি কে কেউ হয়তো আচমকা প্যাঁচে ফেলে ভোকাট্টা করবে। এমন যদি হয়, তিতিরের আকাশের গায়ে ভাসা স্বপ্নের চাঁদিয়ালের অসময়ে প্যাঁচ লেগে যায়। যদি সূতো কেটে ভেসে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে অচেনা বিশ্বে ? তাসের ঘরের মত মনের মাঝে গড়ে তোলা ইমারত ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ? ভয়ে আশঙ্কায় ওর মুখ শুকিয়ে যায়। বুকের ভেতর কে যেন অদৃশ্যে থেকে অনবরত হাতুড়ি পেটাতে শুরু করে। ভীত মাতৃ হৃদয়ে জাগে অসংখ্য প্রশ্ন। অহেতুক আবোল তাবোল ভাবনায় বিমর্ষ হয়ে একাকী সময় পার হতে থাকে।

 ওর মনে জমে থাকা ইচ্ছে সওয়ারীরা চারিদিকে ধূলো উড়িয়ে বেলাগাম ছুটতে থাকে। ভবিষ্যতের যত আশার রঙ্গীন ছবি অন্তরের অন্তস্থলে নিমজ্জিত ছিল, সব পলকে বদলে বিভীষিকার এক কালো ছায়া এঁকে দিয়ে যায়। সাগর পাড়ের উদাসী হাওয়ায় রূপকথার গল্পের দৈত্য দানব গুলো ভীড় করে দাঁড়িয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। দূরপাল্লার ট্রেনের হর্ন --তীব্র  হুইসেল বাজিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যায়। এক অসম্ভব রূঢ় কল্পনার জগৎ থেকে শ্ৰীময়ী বাস্তবে ফিরে আসে।  

ষ্টেশনের মাইকের কর্কশ আওয়াজে তন্ময়তা ভাঙলে ধীরে ধীরে নেমে আসে চার নম্বর প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে। ডাউন বর্ধমান লোকালে উঠে গুছিয়ে বসতেই গ্যালপ ট্রেন উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়োয় । পরন্ত বেলায়  লাল গোলার মত সিঁদুরে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। অস্ত যাবার বেলায় নারিকেলের পাতার ফাঁকে মৃদু হেসে মুখ লুকোয়। হৈমন্তীর সাঁঝে শীতল হাওয়া চোখে মুখে ঝাপ্টা মেরে ওকে ডেকে নিয়ে চলেছে আরো দূরে বার্লিন শহরের পথের প্রান্তে। 
 
   শ্রীময়ী যেন ছবির মত দেখতে পাচ্ছে অবিস্মরণীয় সে শহর কে। মন চলেছে  সপ্ত সিন্ধু পার হয়ে অন্তহীন তেপান্তরের সীমানায়। এক মায়াবিনী রূপের মোহনীয় আকর্ষণে বিদেশ ভূমির মহানগরী। তুষার স্নাত জলে ভেজা শহর ,শীতল তম দিনে কেঁপে উঠে মনের দরজার সামনে ওভারকোটে মুড়ে এসে দাঁড়ায় । স্মৃতির সাগরের হাজার হাজার ঢেউ গুলো জীবনের বালুকা বেলায় আছড়ে পরে অজস্র পদ চিহ্ন এঁকে চলে। তাকে পাথেয় করে এগিয়ে যেতে গিয়ে মাঝে মাঝেই  বাস্তবের দৌরাত্মিতে হারিয়ে যায় অজানা পথের ভুলভুলাইয়ায়। একরাশ চিন্তার বোঝা কাঁধে নিয়ে শ্রান্ত শরীর অবসন্নতায় ঝিমিয়ে পরতে চায়। ঝনঝনিয়ে ছোট্ট মোবাইল সেট তীক্ষ্ণ আওয়াজে বেজে ওঠায় অন করতেই দূর মহাদেশের অন্য এক প্রান্ত থেকে অদ্রিজার কাঁপা গলার স্বর দূরভাষে ভেসে আসে।  

    শোনা যায়  ''কোথায়  তুমি ? বর্ধমানে ?
 এবারে বার্লিনের ফেস্টিভ্যাল শুরুর ছুটিতে তোমাদের আসা চাই। 
আসতেই হবে, কবে আসবে বলো ? 
অন্যমনস্ক শ্রীময়ী ঘাড় কাত করে বলে আসছি রে আসছি । যত তাড়াতাড়ি পারি ভিসা পেলেই আসবো । 
   '' ঋষভ কে রাজি করিয়ে ছুটির নিমন্ত্রণে 'বার্লিনে এবার নিশ্চয়ই  যাবে শ্রীময়ী মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করে। মনে মনে জপ করে  বলে '' '   আমায় ডেকে ছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে।" দেখ আমার আর হবে না দেরী। আমার আর হবে না দেরী।।
                                            
   ক্রমশঃ 

  ,

Post a Comment

0 Comments