বাংলা গানের জগতে সলিল চৌধুরী
সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়
' বরাত ফরাত',' বোকার হদ্দ',' পিশাচেরা',' চিচিংফাঁক',' ডাইনি সর্বনাশী রাক্ষসী',' তুষারিত',' গোষ্পদ' - এই শব্দগুলো বাংলা গানে খুব বেশী নেই। কিন্তু যে কটি আছে তার সবকটাই যিনি প্রয়োগ করেছেন তিনি সলিল চৌধুরী।
আসলে বাংলা গানে এক স্বতঃউৎসারিত ঝর্ণাধারায় স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তার আরেক নাম সলিল চৌধুরী। সুরের বৈচিত্র্যে সহজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন এক নিজস্ব ঘরানা। রাগরাগিণীর এবং পাশ্চাত্য গানের প্রয়োগে যে ট্রিটমেন্ট সেখানে সলিল চৌধুরী আনলেন অভিনবত্ব। বহু ক্ষেত্রে রিদমিক প্যাটার্নের মূল কাঠামোয় শব্দ এবং ভাব অনুযায়ী সুর আনলেন।কীর্তনের সুরে তৈরি করলেন প্রতিবাদের গান, মোজার্টের সিম্ফনি, রাশিয়ান বা হাঙ্গেরীয়ান সুরের চলনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করলেন। স্কেল বা কর্ড নিয়ে চলতে লাগলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা।নীচু স্বর থেকে হঠাৎ উঁচু স্বরে বা উঁচু থেকে পলকে নিচে নেমে এসে জার্ক দেওয়ার প্রবণতা ঘটালেন নিজের কম্পোজিশনে। এছাড়াও স্কেল চেঞ্জ করে বৈচিত্র্য আনার রীতি অনুসরণ করলেন। গানে হঠাৎ কোমল থেকে শুদ্ধ বা কড়িতে তাঁর সুর ষড়জের মত পাল্টে যেত। এসব তত্ত্বকথা ছাড়াও সলিলসুরের প্রধান উপাদান ছিল উচ্ছলতা এবং সাবলীলতা যা ঝর্ণার মত সঞ্চারমান, গতিময় এবং চঞ্চল ছিল। আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারতেন বলেই সলিল চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন ট্রেন্ডসেটার।
সলিল চৌধুরী গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কম্পোজার কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লিখেছেন 'ড্রেসিংটেবিল'এর মতো গল্প বা 'অরুণোদয়ের পথে' -র মতো নাটক। কিংবা 'শপথ' বা 'চাবি' র মতো কবিতা। ছড়াও লিখেছেন যেগুলো কন্যা অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে গান হিসেবে গাইয়েছেন। পরিচালনা করেছেন হিন্দি ছবি 'পিঁজরে কে পনছি' ' দো বিঘা জমিন' এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে সলিল চৌধুরীর অবদান আজও আমাদের কাছে বিস্ময়।এমনকি যখন কোনও ছবিতে একটিও গান ব্যবহার না করে শুধু আবহসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন সেখানেও রেখেছেন স্বকীয়তার স্বাক্ষর।বাংলা বা হিন্দি গান ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের নানা ভাষাতেও সুর করেছেন তিনি।সারা ভারতবর্ষের বিশিষ্ট সব শিল্পীরা গেয়েছেন সেসব গান।এভাবেই সঙ্গীতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন স্রষ্টা সলিল চৌধুরী।
সলিল চৌধুরী যে সময় বাংলা গানের জগতে এলেন তখন এক বাংলা গানের ক্ষেত্রে এক যুগগসন্ধিক্ষণ।ইতিহাস তখন বদলাতে শুরু করেছে।রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন,কবি নজরুলের সৃষ্টি গিয়েছে থেমে,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় সারা পৃথিবী স্তম্ভিত,হিটলারের আগ্রাসনে পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নর মুখোমুখি।ভারতবর্ষে চলছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন।প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ।বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।এমনই এক সময় সলিল চৌধুরী তাঁর সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে এলেন।বলা বাহুল্য এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক পরের বছরের গল্প।১৯৪৮ সাল।সেসময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতেন ইন্দ্র রায় রোডে।গণনাট্য সংঘের তরুণ তুর্কী সলিল চৌধুরী এসেছেন তাঁর কাছে।প্রাথমিক আলাপের পর হেমন্তকে বেশ কয়েকটা গণনাট্য সংঘের গান শোনালেন সলিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পছন্দও হলো কিন্তু সেই গান রেকর্ড করতে পারা যাবে না বলে তিনি জানালেন।ভবিষ্যতে আবার নতুন গান তৈরি করে সলিল চৌধুরী আসবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তা অবধি চলে এসেছেন সলিল চৌধুরী।সঙ্গে হেমন্তও আছেন।একটি অর্ধ সমাপ্ত গানের কথা সলিল হেমন্তকে বললেন।আবার দুজনে ঘরে বসলেন।প্রথম অংশের শুরুটা ছিলো এরকম
'কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো'। গানটি শুনে চমকে উঠলেন হেমন্ত এমনভাবে গানের কথা লেখা যায়! সলিলকে গানের শেষভাগটুকু লিখে আনতে বললেন হেমন্ত। সেদিন রাত্রেই সলিল চৌধুরী লিখলেন,
' ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী এল পিশাচেরা এল রে'
দিন দুয়েকের মধ্যেই হেমন্তর হাতে পুরো গানটি এসে গেলো ' গাঁয়ের বধূ'। ১৯৪৯ সালে রেকর্ড করলেন হেমন্ত সেই গান।এরপর যেন বাংলা গানের সংজ্ঞাই বদলে গেলো। এরপর সলিল হেমন্ত জুটি সঙ্গীতরসিক শ্রোতাদের উপহার দিলেন 'রানার',' পাল্কির গান',' অবাক পৃত্থিবী',' ঠিকানা'। ইত্যাদি কাব্যগীতি।
এইসময় সলিল চৌধুরী আর একটি মনে রাখার মতো কাজ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ' কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক'- গানটিকে দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় রূপান্তরিত করলেন ' সেই মেয়ে 'গানে।' হয়তো তাকে দেখো নি কেউ কিংবা দেখেছিলে' গানটি ১৯৫০ সালে রেকর্ড করলেন সুচিত্রা মিত্র। রাতারাতি সাড়া পড়ে গেলো শ্রোতাদের মধ্যে।এইসময় সলিল চৌধুরী কিছু কিছু গান এমন সৃষ্টি করলেন যেখানে শুধু ব্যক্তি নয়,পরিবেশ,সমাজ,দেশ- এসব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। ১৯৫২ সালে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গাইলেন' শ্যামলবরণী ওগো কন্যা'। এই গানে প্রকৃতি যেন প্রেমিকা যে গানের বর্ণনায় দেশে পর্যবসিত হলো।গায়ক গাইলেন' ওগো তুমি বুঝি মোর বাংলা'।১৯৫৩ সালে কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের কথায় সলিল চৌধুরীর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেন ' উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা'৷ সেই গানে যেন চৈত্রদিনের এক ছবি ফুটে উঠলো।ঐ একই বছর সলিল চৌধুরী নিজের কথায় ও সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ালেন ' আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে'। বৃষ্টি নিয়ে প্রচলিত রোম্যান্টিকতা উধাও।পরিবর্তে বাস্তব জীবন,দারিদ্র্যের হাহাকার এবং বিপুল প্রত্যাশার পরশ এই গানের শব্দে শব্দে ১৯৫৪ সালের দুটি গান আবার বাংলা গানের মোড় ফেরালো।নিজের কথায় ও সুরে সলিল চৌধুরী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ালেন এবং অন্নদাশংকর রায়ের কথায় নিজের সুরে বাণী ঘোষালকে দিয়ে রেকর্ড করালেন ' তেলের শিশি ভাঙলো বলে'। ১৯৫৭ সালে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তর লেখা দুটি কবিতা রেকর্ড করলেন। 'রেখো মা দাসেরে মনে' এবং' আশার ছলনে ভুলি'।এইভাবে সলিল চৌধুরী বাংলা গানকে কয়েক ধাপ যেন এগিয়ে দিলেন।
🍂
সলিল চৌধুরী গান লিখতেন,সুর করতেন গান গাইতেন।একাই যেন শাসন করতেন সঙ্গীত জগৎটিকে।এইসব গান যখন হয়েছে তার অন্তরালে গল্পও ছিলো নানারকম।কিছু কিছু গল্প বলবার লোভ সামলাতে পারছি না।
১৯৫৬সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি পেলো রাজকাপুর প্রযোজিত ও অভিনীত ' একদিন রাত্রে'।সুরকার সলিল চৌধুরী।আর কে ফিল্মসের ব্যানারে এই প্রথম সলিল চৌধুরীর কাজ।একটি গান তিনি লিখলেন
'এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় সব সত্যি
ঘুরি এই দুনিয়ার লাট্টু ভগবান হারিয়েছো লেত্তি'।
ছবি বিশ্বাস এক মাতালের ভূমিকায়।মান্না দে গাইলেন সেই গান।এই গান রেকর্ডিং এ মান্না দে বেশ অভিনয় করে এই গান গেয়েছিলেন।ছবি বিশ্বাস গান শুনে গেলেন রেগে। মান্না দের কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন ছবি বিশ্বাসের বন্ধু তিনি মান্না দেকে বেশ বকুনি দিলেন।কিন্তু গান হলো সুপার হিট।বিশেষ করে সলিল চৌধুরী গানে এমন সব কথা বসালেন যা সেইসময় ভাবাই যেতো না।' মানিব্যাগ',' ফলং ফলং ফলা' ইত্যাদি শব্দগুলির প্রয়োগ ঘটালেন অনায়াসেই।বাংলা ছবির গান বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো এই গানটির মাধ্যমে।
সন্তোষকুমার ঘোষের কাহিনীনির্ভর কিনুগোয়ালার গলি ছবি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে।সেই ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে।সবিতা চৌধুরী গাইবেন' দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে'।গোরখকল্যাণ রাগে বাঁধা এই গান হারমোনিয়ামে বাজাচ্ছেন সলিল চৌধুরী।পাশে তবলায় আছেন রাধাকান্ত নন্দী। সারা স্টুডিও স্তব্ধ।সলিলের হারমোনিয়ামবাদনে প্রত্যেকে মুগ্ধ।অবশেষে সবিতা গাইলেন।সে গান আজ ইতিহাস।
কিশোরকুমার সলিল চৌধুরী জুটি এক অনবদ্য। জুটি।সংখ্যার বিচারে মান্না দে বা মুকেশ তাঁর সুরে হিন্দিতে অনেক গান হয়তো গেয়েছেন কিন্তু কিশোরকুমার যে কটি গান গেয়েছেন সবকটিই হিট করেছে।
মুসাফির,নৌকরি,হাফ টিকেট,অন্নদাতা,মেরে আপনে - এরকম অসংখ্য ছবির কথা বলাই যায়।তখন সলিল চৌধুরী বম্বেতে পেডার রোডের ফ্ল্যাটে থাকেন।অন্নদাতা ছবির গান রেকর্ডিং হবে।একটি গান গাইবেন কিশোরকুমার তাই তাকে সলিল চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছেন।কিশোরকুমার তাঁর সলিলদার গান করতেন খুব সিরিয়াস মুডে।সেদিনও তাই এসেছেন। সোফায় সলিল বসে কিশোরকুমারকে গান শেখাচ্ছেন —
'গুজর যায়ে দিন দিন দিন
কি হর পল গিন গিন গিন
কিসিকি হায় ইয়াদোঁ মে'
শেষ তিনটি শব্দ শুনেই কিশোরকুমার সোফা থেকে নেমে মাটিতে বসে পড়লেন।মুখ নীচু।
সলিল চৌধুরী অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন।কি এমন হলো যে কিশোরকুমার মাটিতে বসে পড়লেন!
তখনও কিশোরকুমার মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছেন।কিছুক্ষণ পরে বললেন,
- আমাকে মাফ করুন সলিলদা।আপনার সমান উচ্চতায় বসে আমি এ গান শিখতে পারবো না।কি সুর করেছেন।
এই বলে বাকি সময়টা মাটিতে বসেই কিশোরকুমার গানটা তুললেন।সেই গান হিট হলো খুব।
বিমল রায়ের আর একটি বিখ্যাত ছবি নৌকরি।এই ছবিতে নায়ক ছিলেন কিশোরকুমার।সলিল চৌধুরী কিশোরকুমারকে ডেকে পাঠালেন গান গাওয়ার জন্য।সেই ফোন পেয়ে কিশোরকুমার বললেন,
- রাতে স্বপ্ন দেখলাম তুমি আমাকে দিয়ে গান গাওয়াবে বলে ধরতে আসছ।আর আমি ছুটে পালাচ্ছি।পিছু পিছু তুমিও ছুটে আসছো।আমি বলছি আমাকে ছেড়ে দাও,তোমার ঐ শক্ত সুরে আমি গান গাইতে পারবো না।তুমি চিৎকার করে বলছ পালাস না,আমি সহজ করে সুর করেছি।
এই বলে কিশোরকুমার হাসতে লাগলেন।হাসছেন সলিল।
যে গান কিশোরকুমার স্বপ্নে দেখেছিলেন সেই গান লিখেছিলেন মজরুহ সুলতানপুরী।' ছোটা সা ঘর হোগা' গানটি হিট করেছিলো খুব।
হৃষীকেশ মুখার্জি যখন আনন্দ ছবি পরিচালনা করবেন বলে ঠিক করলেন তখন ডাকলেন সলিলকে।এই ছবিটি প্রথমে বাংলায় হওয়ার কথা ছিলো।অভিনয় করবার কথা রাজ কাপুর ও উত্তমকুমারের।কিন্তু সেই কাজটি বাস্তবায়িত হয় নি।হিন্দিতে যখন ছবিটি হওয়ার কথা হলো ছবির নায়ক আনন্দ এর মুখে সলিল চৌধুরী দুখানি গান রাখলেন ' ম্যায়নে তেরে লিয়ে' এবং' কাঁহী দূর যব দিন ঢল যায়ে' প্রথমটি গুলজারের লেখা দ্বিতীয়টির গীতিকার যোগেশ।একটি গান সলিল যোগেশকে দিয়ে লেখালেন সেই গানটি হলো ' জিন্দেগী ক্যায়সি ইয়ে পহেলি হায়' এই গান গাইলেন মান্না দে।এই গানটিকে ব্যাকগ্রাউন্ড গান হিসেবে রাখা হলো।কিন্তু নায়ক রাজেশ খান্না গানটি শুনে আবদার করলেন যে এই গানটি তাঁর চাই।এমন একটি গান ব্যাকগ্রাউন্ডে হতেই পারে না।তিনি লিপ দেবেন এই গানে।সুরটা এত টাচি যা রাজেশকে আকৃষ্ট করেছে।
এই গানের সূচনাতে সলিল চৌধুরী ব্যবহার করলেন ট্রাম্পেট।বাজালেন মনোহারী সিং।এর আগে হিন্দি ছবিতে কোনও গানে কোনও সুরকার এইভাবে লো টোনে ট্রাম্পেটের ব্যবহার করেননি।
বম্বেতে শুরুটা হয়েছিলো দারুণভাবে।পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক।তখন কলকাতা থেকে এক ঝাঁক শিল্পী বম্বেতে গিয়েছেন।বিমল রায়,শচীন দেব বর্মন,হৃষীকেশ মুখার্জি,মান্না দে,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।হৃষীকেশ মুখার্জি ছিলেন সলিল চৌধুরীর বন্ধু তাঁর মাধ্যমে বিমল রায়ের সঙ্গে আলাপ সলিলের।সলিলের লেখা রিক্সাওয়ালা গল্পটি তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে তিনি এই গল্পনির্ভর একখানি হিন্দী ছবি করতে চান।ছবির নাম হলো ' দো বিঘা জমিন' এই ছবির চিত্রনাট্য লিখবেন সলিল এমনটাই ঠিক হলো।
হৃষীকেশ মুখার্জি বিমল রায়ের কাছে প্রস্তাব রাখলেন যাতে সলিল এই ছবির সুর করেন।বিমল রায় সবসময় নতুনদের সুযোগ দিতেন।এককথায় তিনি রাজী হয়ে গেলেন।সলিল চৌধুরী প্রথম হিন্দি ছবিতে সুযোগ পেয়ে ঢেলে দিলেন নিজেকে।গান লিখলেন শৈলেন্দ্র।
' ধরতি কহে পুকারকে,
বীজ বিছা লে প্যার কে
মৌসম বিতা যায়'
এবং ' হরিয়ালা সাবন ঢোল বাজাতা আয়া'
মান্না দে ও লতা মাঙ্গেশকরের দ্বৈত কন্ঠে গাওয়া এই গানদুটি লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো।হিন্দি ছবির আবহাওয়াটা কেমন বদলে গেলো।সলিল চৌধুরী বিমল রায় জুটির জয়যাত্রা শুরু হলো তারপর থেকে।
সালটা ছিলো ১৯৬২।রেকর্ড প্রকাশিত হবে নবাগত গায়ক জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের।সুরকার। রেকর্ডের দুদিকে দুখানি গান।দুটি গানেরই অর্ধেক অংশ সলিল চৌধুরী জটিলেশ্বরকে শিখিয়ে তিনদিন পরে রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।তখনও শিল্পী পুরো গান শেখেন নি।প্রচন্ড চিন্তা নিয়ে জটিলেশ্বর হাজির হলেন স্টুডিওতে।একটি গানের প্রথম অন্তরা কয়েকবার রিহার্সাল দেওয়ার পর জটিলেশ্বর সলিল চৌধুরীকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে স্টুডিওর পিছনের লম্বা সিঁড়ির ওপর ধুলো মলিন পরিবেশে তিনি বসে আছেন।হাতে রয়েছে কাগজ ও কলম।জটিলেশ্বরকে দেখতে পেয়েই বললেন যে গান তৈরী হয়ে গিয়েছে।কাগজ দেখে বেশ কবার অভ্যাসও করলেন জটিলেশ্বর।দুটি গানই হলো সুপারহিট। যতদিন জটিলেশ্বর জীবিত ছিলেন এই দুটি গান তাঁকে অনুষ্ঠানে গাইতেই হতো গানদুটি হলো ' পাগল হাওয়া কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে' এবং অন্যটি ' আমার এ জীবনে শুধু'।
ঠিক এর পরের বছর।১৯৬৩ সাল।এক দারুণ ব্যাপার ঘটলো।সেবার নির্মলা মিশ্রর দাদা সলিল চৌধুরীর কাছে আবদার করলেন নির্মলা মিশ্রর জন্য তিনি যদি দুখানি গানে সুর করেন।পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন গান।পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় সলিল চৌধুরী জুটি খুব বিরল ঘটনা।সেই বিরল ঘটনাটিই ঘটলো সেবার।পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা দুটি গানে সুর করলেন সলিল।গানদুটি নির্মলা মিশ্র গাইলেন। ' এ মন মোর জানি না কোথা যে হারালো ' এবং ' আমার এ বেদন মাঝে'। বলা বাহুল্য এই দুটি গানও হলো হিট।
একটু আগে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানের প্রসঙ্গে বলেছিলাম সলিল চৌধুরীর প্রথমেই সম্পূর্ণ গান না লেখার গল্প।এই অভিজ্ঞতা রয়েছে অরুন্ধতী হোমচৌধুরীরও। সেবার অরুন্ধতীর গান করবেন সলিল চৌধুরী।অরুন্ধতী হোমচৌধুরী স্টুডিও তে এসে দেখলেন যে সলিল চৌধুরী তখনও গানটি লেখেন নি। ওদিকে যন্ত্রশিল্পীরা তৈরী কিছুক্ষণের মধ্যেই সলিল গান লিখলেন,সুরও করলেন।অসাধারণ যন্ত্রাণুষঙ্গ সহ সেই গান অরুন্ধতী হোমচৌধুরী রেকর্ড করলেন।একদম অন্যরকম ভাবনার একখানি গান।
' কেন ঘুম আসে না সারারাত জেগে ' ১৯৮২ সালে রেকর্ড করা এই গানখানি অরুন্ধতী হোমচৌধুরীর এক অন্যতম গান হিসেবে ধরা হয়।
এই ১৯৮২ সালে ঘটলো আর এক ঘটনা ১৯৬৭ সাল থেকে এইচ এম ভির নিয়মিত শিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্ত।বহু সুরকারের সুরে প্রতি বছর তিনি গান রেকর্ড করে চলেছেন।জনপ্রিয় হচ্ছেও সেসব গান। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ এই যে সলিল চৌধুরীর সুরে আর গান রেকর্ড করা হয় না।তখন গ্রামাফোন কোম্পানীর অধিকর্তা শ্রী বিমান ঘোষকে বনশ্রী অল্প অনুযোগ করলেন এই নিয়ে। বিমান ঘোষ আর এক কর্তাব্যক্তি দিলীপ সেনগুপ্তকে নির্দেশ দিলেন এইব্যাপারটা দেখতে। সলিল চৌধুরী সবসময় নতুন নতুন শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে সবসময় অগ্রণী। সেবারও তাই হলো।বনশ্রী সেনগুপ্তর জন্য চারটি চার রকমের গান করলেন সলিল।গানগুলি হলো ' কেন মন কেমন কেমন সারাক্ষণ করে গো',' একবার দুইবার তিনবার কইলাম'' মন মন মন থাকাটাই যন্ত্রণা',' এই তো ফের এলাম এই ফিরে পেলাম'। সেবছর বনশ্রী সেনগুপ্তর এই চারখানি গানের জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে।
১৯৬১ সাল।সঙ্গীতজগতে মাধুরী চট্টোপাধ্যায় তখন নবাগত।তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৬০ সালে মেগাফোন থেকে সবে তাঁর একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে।সেই বছর মেগাফোনের কর্ণধার শ্রী কমল ঘোষ যোগাযোগ করলেন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। তখন সলিল চৌধুরী সঙ্গীতজগতে একটি এমন নাম যে নামের ম্যাজিক অপরিসীম।তুলনায় নবাগতা মাধুরী চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সলিল চৌধুরী অভিভাবকের মতো মাধুরীর ভয় ভাঙিয়ে দিলেন।দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশিত হলো সলিল চৌধুরীর সুরে।একপিঠে ' নিজেরে হারায়ে খুঁজি ' এবং অন্যপিঠে ' এবার আমার সময় হল যে'।যতদিন মাধুরী চট্টোপাধ্যায় জীবিত ছিলেন ' নিজেরে হারায়ে খুঁজি ' বিভিন্ন জলসায় তাঁকে গাইতেই হতো।আজও গানপাগল বাঙালী এই গান শোনেন।
এর দুবছর পর ১৯৬৩ সালে সলিল চৌধুরীর সুরে মাধুরী চট্টোপাধ্যায় আবার জুটি বাঁধলেন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে।একটি গান ' কি আর কহিব বল' এবং অন্য আর একটি গান হলো ' আজ শরতের আকাশে'। দ্বিতীয় গানটিতে শারদীয়া উৎসবের মূল সুরটি যেন ধরা পড়লো।
এরপর মাধুরী চট্টোপাধ্যায় এইচ. এম. ভি র শিল্পী হলেন।সেখানেও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হলো।১৯৬৭ সালে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে মাধুরী চট্টোপাধ্যায় আবার গান রেকর্ড করলেন।' 'গুন গুন ফাগুন শেষ হলে ' এবং ঐ যে সবুজ বনবীথিকা ' এই গানদুটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরী করেছিলেন সলিল চৌধুরী সেই গানদুটর জনপ্রিয়তা আজও অম্লান।
সুচিত্রা মিত্রকে দিয়ে গান গাওয়ানোর গল্প আগেই করেছি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে গান গাওয়ানোর কথা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।দুটি গান সলিল কণিকার জন্য করেছিলেন। ' আমার কিছু মনের আশা' এবং ' প্রান্তরের গান আমার'। গানদুটি কণিকা প্রথমে রেকর্ড করলেন।টেস্ট প্রিন্ট হলো কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সলিলকে চিঠিতে লিখলেন যে শান্তিনিকেতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন এই গান কণিকার গাওয়ার অনুমতি মিলবে না।কিছুটা নিরাশ হলেও সলিল সেই দুটিগান উৎপলা সেনকে দিয়ে গাওয়ালেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত উৎপলা সেনের গলায় রেকর্ড করা এই গানদুটিও ফিরতে লাগলো লোকের মুখে মুখে।
১৯৯০ সাল।সেই বছর হৈমন্তী শুক্লার জন্য সুর করলেন সলিল চৌধুরী। যেহেতু হৈমন্তী শুক্লা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্ট পারদর্শিনী ছিলেন তাই সলিল চৌধুরী সুযোগ পেলেই তাঁর জন্য রাগভিত্তিক গান সৃষ্টি করতেন।সেবারও তাই হলো।একখানি গান করলেন ' মন বন পাখি চন্দনা'। গানটি নন্দকল্যাণ রাগে। গানের শেষের দিকে একখানি বোলতান ছিলো অল্প সময়েই হৈমন্তী সড়োগড়ো করে ফেললেন সেই বোলতানের অংশটুকু।সলিল চৌধুরী খুব প্রশংসা করে বললেন গানটি পন্ডিত রবিশংকরকে শুনিয়ে দিতে কারণ তিনি হৈমন্তীর গলায় এই ধরনের গান শুনলে আরও খুশি হবেন।
১৯৯০ সালেরই আর একটি গানের ঘটনা।এই গানটি তিনি কন্যা অন্তরাকে দিয়ে গান গাওয়াবেন।তখন অন্তরা বেশ বড়ো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সে তালিম নিচ্ছে। সলিল চৌধুরী দেশ রাগের ওপর একটি গান তৈরি করলেন অন্তরার জন্য। গানটি হলো ' এমন সঘন বরষায় তুমি কেন এলে না'।অসাধারণ মিউজিক এরেঞ্জমেন্টে অন্তরা গাইলেন সেই গান।
নিজের সৃষ্টি করা সুর বারে বারে প্রয়োগ করেছেন নতুন নতুন কথায়।তাতে সেই গানটির গ্রহণযোগ্যতা কোনও ভাবেই কিন্তু ম্লান হয়ে যায় নি।গানের সুর হয়তো এক হয়েছে কিন্তু কথাগুলি পরিবর্তিত হয়েছে সলিল চৌধুরীর স্বকীয় ভাবনায়।আকাশবাণী কলকাতার রম্যগীতির জন্য সলিল চৌধুরী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে একখানি গান করিয়েছিলেন।গানটি হলো ' গুরু গুরু গুরু মেঘ গরজে '। এর পরে এইগানের সুর একই রেখে কথা দিলেন বদলে। ১৯৭৭ সালে এবার সবিতা চৌধুরী রেকর্ড করলেন ' তুমি কি কখনও সেই গান শোনো'।আরও পরে আবার কথা বদলালেন সুর রইলো একই।১৯৮৮ সালে লতা মাঙ্গেশকর গাইলেন' সবার আড়ালে সাঁঝ সকালে'। এরকম উদাহরণ আরও আছে।আসলে সব সময় নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদ যেন সলিল চৌধুরীকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো।আর সমৃদ্ধ হতো বাংলা বা হিন্দি গানের জগৎ।
১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিন ভারতীয় সঙ্গীতজগতের এই মহান শিক্ষক চিরতরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে সুরকার নৌশাদ বলেছিলেন
"One of the seven notes of music had been lost"। ৫০ বছরের বেশী সৃষ্টিশীল থাকার পরও তিনি অনায়াসেই বলতে পেরেছিলেন
" When I started my music career I imagined the whole world of music as a very tall tower for me to climb and now after all these years I see that the tower has remained as tall as before"
সারা জীবন বিশ্বাস করেছেন যে পৃথিবীর সঙ্গীতজগৎ কে ভারতীয় সঙ্গীতের অনেক কিছু দেওয়ার আছে।ভারতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শান্তি ও সহিষ্ণুতার বাণী অনুরণিত হবে বিশ্বসঙ্গীতের দুনিয়ায়।ভারতীয় সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল আলোর পথযাত্রী ছিলেন সলিল চৌধুরী।
সৃষ্টিকর্তা এমন এক ক্ষণজন্মা শিল্পীকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছিলেন।বাংলা গানের ৫০ বছরের ইতিহাস সলিল আলোয় আলোকিত।আজ তিনি সশরীরে নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁর অসংখ্য কাজ।সেসব নিয়ে আমাদের নিত্য পথচলা। স্রষ্টা সলিল চৌধুরীকে জানাই প্রণাম।
0 Comments