পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯৮
বাঁধনা পরব
ভাস্করব্রত পতি
একদিন মহাদেব ঠিক করলেন যে, তাঁর কথা সকল মর্ত্যবাসীকে মেনে চলতে হবে। তাই মর্ত্যে তাঁর প্রচারের জন্য গোরুদেরকে (ভগবতী) পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন, সবাই যেন স্নানের পর তিনবার তাঁর নাম নিয়ে দিনের শেষে একবার আহার গ্রহণ করে। কিন্তু গোরুরা পৃথিবীতে এসে দেবাদিদেবের বিপরীত প্রচার করে ফিরে যায়। এসব কিছু জানতে পারলেন মহাদেব। তিনি রেগে গিয়ে সকল গোরুদের অভিশাপ দেন এই বলে যে, মর্ত্যধামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে সব সময় কাজ করতে হবে গরুদের। তাঁদের মানুষের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাহায্য করতে হবে। সেইসাথে মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী দিতে হবে। এটা জেনে গোরুরা পৃথিবীর বুকে আসতে না চাইলনা। কিন্তু তাঁদের আসতে বাধ্য করা হল।
অবশেষে গোরুরা পৃথিবীতে এল। কিন্তু এখানে এসে মানবকূলের অমানবিক কাজকর্ম এবং অমানুষিক ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে আবার ফিরে গিয়ে মহাদেবের কাছে নালিশ জানাল মানুষের বিরুদ্ধে। মহাদেব তখন তাঁদের কথা দিলেন যাবতীয় সমস্যা সমাধানের। ফের তিনি তাঁদের মর্ত্যে পাঠালেন। এবার তাঁদের সঙ্গে পাঠালেন মহিষ। মহর্ষি নারদ কিন্তু মর্ত্যে মহাদেবের আগমনের খবর আগাম জানিয়ে দিলেন মনুষ্য জাতিকে। মানুষেরাও ধুরন্ধর। তাঁরা মহাদেবের ক্রোধ থেকে বাঁচতে তৈরি হল। সেইসাথে গোরুর মতো উপকারী প্রাণী যাতে হাতছুট না হয়ে যায়, সেজন্য সচেষ্ট হল। মহাদেবের আগমনকে কেন্দ্র করে যাবতীয় প্রস্তুতি সারা মানুষদের। তাঁরা জানতে পারলো যে কার্তিকের অমাবস্যার ঘোরতর অন্ধকারে মর্ত্যলোকে আসবেন মহাদেব। ফলে এই সময় তাঁরা গোরুকূলের প্রতি ভক্তি, অশেষ করুণা ও সেবার ব্যবস্থা করল। গোরুদের স্নান করানো, সিঙে তেল সিঁদুর মাখানো, দেহ বিভিন্ন রঙের ছোপ দিয়ে সাজানো, গরুদের থাকার গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, গোয়ালে প্রদীপ জ্বালানো ইত্যাদি সমস্ত উপচারই খুব যত্নের সাথে আয়োজন করল। নির্দিষ্ট সময়ে মর্ত্যধামে এসে মহাদেব সবকিছু দেখে ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন। গোরুদের প্রতি মানবজাতির সেবাপরায়ণতা দেখে আনন্দিত হলেন। সেইসাথে ফেরার সময় গোরুকূলকে মানবজাতির সাথে থাকার নির্দেশ দিলেন।
এই লোককাহিনীর ওপর নির্ভর করে মানভূমবাসীর বিশ্বাস যে, কার্তিকী অমাবস্যায় স্বয়ং মহাদেব তাঁদের মর্ত্যলোকে আসেন। এখানে তিন চার দিন কাটিয়ে যান। তাই এই সময় তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন গোরু মহিষের অযত্ন যেন না হয়। সেই থেকে শুরু হল গোরুদের বন্দনা এবং সারা দিনরাত ধরে গান আর নাচ --
'অহিরে... জাগে মাঞ লছমী, জাগে মাঞ ভগবতী
জাগে তঅ অমাবস্যার রাইৎ।
জাগে তঅ পতিফল দেবে মাঞ লছমী
পাঁচঅ পুতা দশঅ ধেনু গাই'।
'বাঁধনা' শব্দের মূল অর্থ হল বন্দনা করা। মূলত গো- বন্দনাই উৎসবের মূল দিক নির্দেশ করে।
বন্দনা > বাঁদনা > বাঁধনা
'বন্দনা' হল নবলক্ষণা বা ষোড়শলক্ষণা ভক্তির একতম লক্ষণ। এক বলে স্তবন। পাদস্পর্শপূর্ব্বক প্রণতি।
যদিও কেউ কেউ মান্যতা দেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে, বাঁধনা পরবের মূল উপচার হল 'গোরু খুঁটা' বা 'গোরু খুটান'। অর্থাৎ গোরুকে খুঁটিতে বেঁধে গান বাজনা সহযোগে উত্তেজিত করা। এই গোরুর ‘বাঁধন’ থেকেই সৃষ্টি ‘বাঁদনা’ শব্দের।
বাঁধন > বাঁধনা > বাঁদনা
গানের ভাষায় রয়েছে 'আমার লাজের বাঁধন, সাজের বাঁধন, খসে গেল'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'সংকল্প ও স্বদেশ'তে পাই 'সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে'। পুরুলিয়ার গবেষক অমরেশ মাহাতো লিখেছেন, 'বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের টোটেমিক কুড়মি জাতির অন্যতম প্রধান উৎসব হল বাঁধনা। এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কুড়মি জাতির সংখ্যাধিক্য ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের কারণেই এই পরব ক্রমে বিভিন্ন হিতমিতান জাতির মধ্যে সঞ্চালিত হয়েছে। তাই বাঁধনা আজ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমষ্টির মধ্যে'। এটি ঝাড়খণ্ড সহ পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার কুড়মি, কুইরি, কুমহার, মুণ্ডা, গোয়ালা, নাপিত, রাজোয়ার, ভূমিজ, লোধাদের কৃষিভিত্তিক উৎসব।
আরও একটি লৌকিক কাহিনীর সন্ধান মেলে বাঁধনার উৎপত্তি বিষয়ে। বহু আগে একসময় গোরু, মহিষ সহ সকল গৃহপালিত পোষ্যরা সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নিল যে, তাঁরা আর মানুষের বেগার খাটবেনা। মানুষের দাস হয়ে থাকবে না তাঁরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা রোদ জল সয়ে লাঙল চালায়, হাল করে, মই টানে। ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে তাঁরা গাড়ি টানে, দুধ দেয়, গোবর দেয়। তাঁদের লবেজান অবস্থা করে দেয় মনুষ্যজাতি। অথচ তাঁদের এই পরিশ্রমের পর সামান্য খাবারটুকুও দেওয়া হয় না। সারাদিন একটানা কষ্টের পর তাঁদের থাকতে হয় খানাখন্দে ভরা গোয়ালে। সেখানেই তাঁদের বিনিদ্র রাত কাটে। ক্রমশঃ গোরুকূলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে থাকে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ পর্যন্ত তো অনেক গোলামী খাটা হয়েছে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আর কখনও মানুষের গোলামী করতে রাজি নয় তাঁরা। তাঁদের সিদ্ধান্ত দেবাদিদেব মহাদেবকে জানিয়ে দিলে অবাক মহাদেব জিজ্ঞাসা করলেন তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ। তিনি তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পশুরা অনড়। কিছুতেই মানুষের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে রাজি নয় তাঁরা।
তখন মহাদেব তাঁদের জানান যে, তিনি নিজেই তাঁদের ওপর অত্যাচারের খতিয়ান সরেজমিনে দেখবেন। যদি কেউ অন্যায় করে, তাঁদের তিনি নিজেই শাস্তি দেবেন। এতে খুশি হল গোরুকূল। কিন্তু মানুষ তো বুদ্ধিমান। তাঁরা সবকিছু আগাম জেনে গিয়ে গোরুদের জব্দ করতে পরিকল্পনা করে নিল যথাসময়ে। তাঁরা ঠিক করল যে, কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত্রে সমস্ত পশুকে খুব খাতির যত্ন করা হবে। সেইসাথে গোয়ালঘর সুন্দর করা হবে, গোরুদের গা ধুইয়ে দেওয়া হবে, তাঁদের শিং ও পায়ে তেল সিঁদুর মাখানো হবে, গোয়ালঘরে প্রদীপ জ্বালানো হবে, রং বেরঙের ছবি দিয়ে তাঁদের চামড়া সাজানো হবে ইত্যাদি। আর এই সময় তিন চার দিন তাঁদের দিয়ে কোনো কাজ করানো হবে না। এদিকে মহাদেব অমাবস্যার রাত্রিতেই চলে এলেন। এসে তিনি এরকম সুন্দর সুন্দর কাজগুলো দেখে খুব খুশি। মনুষ্য সমাজের ওপর দারুণ সন্তুষ্ট হলেন। । বরং অসন্তুষ্ট হলেন গোরুদের ওপর। তাঁদের অভিযোগ যে ভুয়ো, তা তিনি বুঝলেন। তখন রেগে গিয়ে সকল গোরু মহিষদের অভিশাপ দিলেন সারা জীবন মানুষের সেবা করার জন্য। তখন থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস যে, অমাবস্যার রাতেই মহাদেব প্রতি বছর আসেন তাঁর গোরুকুলের খবর নিতে। তাই অমাবস্যার তিথিতে গোরু কেন্দ্রিক যাবতীয় লোকাচার তথা গোবন্দনা, গোসেবা এবং গোরুপূজা পালিত হয়ে আসছে।
বাঁধনা পরব মোট পাঁচ দিনের পরব। সব মিলিয়ে ১১ টি পর্ব এবং ১৬ টি নেগাচার দ্বারা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। নেগাচারগুলি হল -- ঘাওয়া, আমাবইসা, গরইয়া, গরু খুটান এবং বুড়ি বাঁদনা। এই পরবটি মাহাত, লায়া, দেহরি, মাঝির তত্বাবধানে হয়। বাঁধনা পরবের গানকে বলে 'অহিরা'। কুড়মালি ভাষায় এই গান গাওয়া হয়। যাঁরা এই গান করেন, তাঁদের বলা হয় 'ধেগুআঞন'।
ঘাওয়া - অমাবস্যার আগের দিন ঘাওয়া। এদিন গোরু মহিষকে মাঠে চরানোর পর পুকুরে বা নদীতে পরিষ্কার করে স্নান করানো হয়। এরপর রাত্রে সন প্যাকাটি জ্বালিয়ে গোরুর শিংয়ে কচড়া তেল মাখানো হয়। প্রথমে গৃহকর্তা ঠাকুর পিঁড়হা বা তুলসী তলায় তেল উৎসর্গ করেন। তারপর প্রথমে গাই গোরু ও বলদ গোরুর শিংয়ে তেল মাখানো হয়। তারপর মহিষের শিংয়ে তেল লাগানো হয়। বাঁকুড়ার গবেষক মৃনাল বঁসরিয়ার জানান, তেল দেওয়া হয় ৩, ৫, ৭, ৯ দিন ধরে। যেন বিজোড় সংখ্যা হয়। যেদিন তেল দেওয়া হয়, সেদিন এঁদের দিয়ে কোনও কাজ করানো হয়না। এই দিনগুলিতে বনজঙ্গলে চরানো হলেও রাতের বেলায় গোয়ালঘরে প্রদীপের আলোয় ঘাস খাওয়ানো হয়। আর এদিন থেকেই গোয়ালঘরে শুরু হয়ে যায় প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা।
অমাবস্যা -- ঘাওয়ার পরের দিন হয় 'অমাবস্যা' বা 'আমাবইসা'। এদিন গ্রামের লায়া বা পূজারীরা সকালে প্রত্যেক বাড়ি থেকে পূজার সামগ্রী জোগাড় করেন। আর বাগাল বা রাখালরা বাগালপিঠার সামগ্রী জোগাড় করেন। দুপুরবেলায় আয়োজন হয় গঠপূজার। এর আগে অবশ্য গ্রামের মাহাত বা মোড়লের সহযোগিতায় লায়ারা গরাম দেবতার পূজা করেন। মাঠে লায়ারা প্রথমে একটি বৃত্ত করে তার মধ্যে খড় এঁকে ধূপ ধুনো জ্বেলে মাটিতে সিঁদুর লেপে পূজা শুরু করেন। সেখানে দেওয়া হয় আতপ চাল, ঘি, গুড় বাতাসা। সেইসাথে দুধ ও জল দেওয়া হয়। এই গঠপুজোর আরেকটি অন্যতম উপকরণ হল হাঁস বা মুরগির ডিম। গঠমাঠে এই ডিমটি রেখে তার উপর দিয়ে গোরুর পাল নিয়ে যাওয়া রীতি পালিত হয়। একে বলে 'গঠ ডেঁহগা'। এইসময় যে গোরুর পায়ে লেগে ডিমটি ভাঙে, তাঁকেই সেরা গোরু হিসেবে বাছাই করা হয়। তখন ঐ গোরুটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর মাথায় কাঁচা ধানের 'মোড়' পরানো হয়। আর গোরুর মালিককে ভাবা হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। বনে চরতে যাওয়া গোরুবাছুরকে বন্যপশুর হাত থেকে রক্ষার জন্য বাঘুতের পূজা করা হয়। আর লতাপাতায় পা আটকে যাতে গোরু বাছুর না মারা যায়, এজন্য 'ছাঁদন দড়ি' বা 'বাঁধন দড়ি'রও পূজা করা হয়।
কাঁচি জিওরী - এটির মূল উপকরণ হলো কাঁচা শালপাতা বা কাঁঠালপাতা, মড়দা ঘাস বা খোইড় ঘাস, চালের গুঁড়ি, দুধ, ঘি, কার্পাস তুলার বাতি ইত্যাদি। অমাবস্যার সন্ধ্যায় বাড়ির বিভিন্ন স্থানে কাঁচা শালপাতায় বা কাঁঠাল পাতায় চালের গুঁড়ির তালের ওপর নতুন কার্পাস তুলোর সলতে জ্বালানো হয়। পাশে রাখা হয় মর্দা ঘাস বা খোইড় ঘাসের আঁটি। এটিকেই 'কাঁচি জিওরী' বলে। প্রথমে চালের গুঁড়োকে দুধ দিয়ে মেখে ছোট ছোট তাল বানানো হয়। এই কাঁচি জিওরীর গুঁড়ি দিয়ে বানানো পিঠা নাকি পুড়িয়ে খেলে চর্ম রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সবশেষে প্রত্যেকের বাড়িতে ছাঁকা পিঠা হয়। সেটিই সবাই খায়। অন্য কিছু খায়না সেদিন।
ইঁজয় পিজঁয় -- ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাটকাঠি জ্বালিয়ে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ছোটে। কিছু কিছু ছেলে মেয়েরা সেই আগুন নিয়ে চিৎকার করে বলে, 'ইঁজয় পিঁজয় রে / ব্যানা বুড়ির বাণ কাটই রে'। এরপর এক জায়গায় আগুন জ্বেলে ছেলে মেয়েরা সমবেত ভাবে সেই আগুনের ওপর তিনবার করে লাফ দিতে দিতে বলে, 'দাওদা বুঢ়ি দাদ লে, খৌসা বুঢ়ি খোস লে'।
এরপর তাঁরা বাড়ি ফিরে যায়। মানুষের বিশ্বাস যে, ঐ আগুনের ওপর দিয়ে লাফ দিলে নানা ধরনের খোস পাঁচড়ার হাত থেকে 'বুড়ি' রক্ষা করবেন। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্র জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থেকে দক্ষিণ বাঁকুড়া পর্যন্ত এলাকায় এই লোকাচারকে বলে 'ইঁজল পিঁজল' বা 'ইঁজয় পিঁজয়'। যা 'ধা রে মশা ধা'র আরেকটি রূপ। এইদিন ভোররাতে ছেলে মেয়েরা অন্যের বাড়ির ফল চুরি করে। একে বলা হয় 'চোখ চাঁদা'। আর মশা তাড়ানোর সময় বলে "ইঁজোরে পিঁজোরে / ধোরে মশারে / আমদের পাড়ার মশাগুলান / উঁয়াদে পাড়াক যা রে"। 'ইঁজল পিঁজল' বা 'ইঁঞ্জ পিঁঞ্জ'তে ছেলে মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গায় -- "সনকাপাটি রট রট, বাঘা ভয়ে ছট পট / ইঁঞ্জরে পিঁঞ্জরে ইঁঞ্জরে পিঁঞ্জরে / হামদের কুলহির মশা মচ্ছড় / ছাউ কুলহি কে যা / দাউদা বুঢ়হির দাদ লো / খঁইস্যা বুঢ়হির খোঁস লো / রওগ জ্বালা অসুখ বিসুখ / গুটায় লিয়ে যা"।
গাইজাগা - অমাবস্যার রাতে সবাই ঢোল, মাদল, নাকাড়া, বাদ্যবাজনা সহ গোরু জাগানোর জন্য বেরিয়ে পড়েন। এঁদের বলে 'ঝাঁগড়' বা 'ধেঙ্গুয়ান'। প্রথমে গ্রামের মাহাত বা মোড়লের বাড়ির গাই জাগানো হয়। তিনি ঝাঁগড়দের সসম্মান করেন পিঠা, চাল, টাকা পয়সা, তামাক দিয়ে। এরপর সারা রাত ধরে ঝাঁগড়ের দল অহিরা গীত গেয়ে বাড়ি বাড়ি প্রদক্ষিণ করেন গাই জাগানোর জন্য।
গরইয়া — শুক্লা প্রতিপদের দিন হল পরবের তৃতীয় দিন।এদিন হয় 'গরয়া' বা 'গরইয়া' পূজা। এদিন কৃষির সাথে যুক্ত সমস্ত যন্ত্রপাতি ধুয়ে পরিষ্কার করে তুলসী থানে রাখা হয়। মহিলারা এদিন ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। পুরোনো উনুন, পুরোনো হাঁড়ি ভেঙে ফেলা হয়। পুকুর থেকে এঁটেল মাটি এনে উনুন বানানো হয়। সেখানে শাল কাঠের আগুনে গোরু গোয়ালের দেবতা গরইয়ার নৈবেদ্য পিঠা বানানো হয়। বাড়ির কোনও পুরুষ এদিন উপবাসে থেকে ধানক্ষেত থেকে মোড় বানানোর ধানগাছ কেটে আনেন। মোড় বানানো হয়ে গেলে গোয়াল পূজা শুরু হয়। গরইয়া খুঁটার কাছে মাটির তৈরি নরম তাল রাখা হয়। সেখানে একটি শালুক ফুল দেওয়া হয়। যা কিনা সুপ্রজননের প্রতীক। গরইয়া খুঁটার সামনে আতপ চালের গুড়ি দিয়ে বর্গাকারে ৯ টি ঘর বানানো হয়। এই ঘরগুলিতে ৯ জন দেবতা অধিষ্ঠান করেন। তাঁরা হলেন -- গরাম, ধরাম, বসুমাতা, গোঁসাই রাই, নাজি, গাই, মহিষ, ডিনি মাই এবং বড় পাহাড়।
এই পূজায় প্রয়োজন তুলসী পাতা, সিঁদুর, ধূপ ধুনা এবং চালের গুঁড়ো, গুড়, দুধ আর ঘি দিয়ে তৈরি ছাঁকা পিঠা। গোয়াল পূজায় লাল মোরগ (গরাম) আর সাদা মোরগ (ধরাম) উৎসর্গ করা হয়। এই মাংস মহিলাদের খাওয়া নিষিদ্ধ। বিকালবেলায় গরু চুমানো হয় এবং গোরু মহিষের সুরক্ষিতকরণ করতে ধুনা, চুল, দমঢ়ি, কালো সরিষা নিয়ে 'নিমছানো' হয়। বাড়ির মহিলারা ডান হাতের পাঁচটি আঙুল দিয়ে কুলহি থেকে উঠানের সর্বত্র চৌক পুরে আলপনা দেয়। আলপনার প্রতিটি খাঁজে সিঁদুরের টিকা দেওয়া হয়।
গরু খুঁটান -- গরইয়ার পরের দিন হল 'গরু খুঁটান' বা 'বাঁধনা'। এই দিন হল গরু চুমানোর বিশেষ দিন। এই সময় গোরুর কাঁধে লাগানো হয় তেল, শিংয়ে দেওয়া হয় সিঁদুর এবং মাথায় মাথায় পরানো হয় মুকুট। গোরু খুটান গোরুকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, ভয় তাড়ানোর জন্য করা হয়। খুটানে মূলত বরদা (বলদ) থাকে। পরব শেষ হলে সবাই কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। তখন আর বলদের লাঙ্গল টানার কাজ থাকে না, থাকে গাড়ি টানার কাজ। নানান শব্দ বাজনার ভয়ে অনেক সময় বলদেরা বিচলিত হয়ে ওঠে, ফলে নানা অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
শ্রীকান্ত মাহাতো বর্ণনা করেছেন, 'গোরু চুমানোর সময় মহিলারা ধুনো জ্বেলে বাম হাতে গোরুর মাথা উপর ঘুরিয়ে নিজের পায়ের ফাঁকে গলিয়ে তিনবার এর পুনরাবৃত্তি করেন। এরপর গরু বাছুর সবার কাছে ঘুরে গোয়াল থেকে বেরিয়ে কুলহির মাঝে সরা বা দমড়িটি উপুড় করে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়। এই নেগ নিমছানো নামে পরিচিত। নিমছানো শেষ হলে কুলো থেকে আতপ চাল, ধান, দূর্বা ঘাস নিয়ে তিনবার ছিটিয়ে আম্রপল্লব সহ ঘটি থেকে দু'পাশে একটু করে জল ঢেলে গৃহিণী গোরুকে ভক্তিভাবে প্রণাম করেন'। আসলে অশুভ শক্তির হাত থেকে গোরুদের বাঁচাতে এহেন উপচার পালিত হয়। বিকেলে গাঁয়ের বড় মাঠে সবাই ভিড় করে। সেখানে একটি খুঁটিতে বাঁধা হয় তাগড়াই বলদ আর কাঁড়া। বাজনা আর অহিরা গীতের তাড়নায় ভয়ে এবং রেগে রোষে ফুলে ওঠে তাঁরা। তখন কোনও মৃত পশুর চামড়া সামনে নিয়ে এলে আরও উন্মত্ত হয়ে ফুঁসে শিং দিয়ে গুঁতোতে চেষ্টা করে। খুঁটিকে ঘিরে চরকির মতো পাক খায় আর শিংয়ের গুঁতো মারে। উল্লেখ্য, এইসময় অনেক জায়গায় গত বছরের বিবাহিত মেয়ে জামাই আসে। মানভূম এলাকায় এই উৎসবকে বলে 'জামাই বাঁধনা'। ঐ সময় গ্রামের সকলের মাঝে তাঁকে সম্মান করা হয়।
বুড়ি বাঁদনা / কাঁটা কাড়হা -- শেষ দিন পালিত হয় 'বুড়ি বাঁদনা'। এদিন মহিষ, বাঁজা বকনাকে খুঁটানো হয়। পূর্বপূরুষদের বিশ্বাস অনুযায়ী এতে তাঁরা পূনরায় গর্ভধারন ক্ষমতা ফিরে পায়। এদিন আসলে গৃহপালিত বলদের মর্দানী দেখানোর তিথি। এঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনেরও দিন। গাভীদের অভিমান ভাঙ্গানোর কৃতজ্ঞতা প্রতিফলিত হয় অহিরা গীতিতে।
একেবারে শেষের দিন হল 'কাঁটা কাড়হা'। এদিন নির্দিষ্ট স্থানে কাড়া গরু খুঁটা হয়। কোথাও কোথাও এর সাথে বুলবুলি নাচ, যাত্রা গান, নাচনি নাচের আয়োজন করা হয়। কাঁটা কাড়হা শেষে মানভূমে শুরু হয় টুসুর প্রস্তুতি। শেষ হয়ে যায় বাঁধনা পরবের উৎসাহ, আনন্দ আর লোকোপচার। মানভূমে নেমে আসে স্তিমিত সুর। অমরেশ মাহাতো লিখেছেন, 'ঘাওয়ার দিন পাঁচেক পর পশ্চিম বাঁকুড়া, উত্তর পশ্চিম মেদিনীপুর, ধলভূম, মানভূম, বৃহৎ ছোটনাগপুরের রূক্ষভূমি, স্বল্পতৃণ প্রান্তর, সবুজদ্বীপের মতো শাল পিয়ালের বনে আর ঢোল, ঢমসা, মাদৈলের দ্রিমিদ্রিমি প্রতিধ্বনি শোনা যায়না। পরবে আগত নতুন বিটিজামাই ফিরে যায় নিজ গাঁয়ে। মাংস, পিঠা, ঘিয়ের পোড়া পোড়া গন্ধ হারিয়ে যায় ঈষৎ শীতল বাতাসে। শুধু অনার্য সভ্যতার প্রতিনিধিদের একান্ত নিজস্ব বাঁধনা পরবের স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে মনের গভীরে। আবারো দিন গোণা শুরু হয় -- নাচ গান বাজনা মকর করম বাঁধনা'!
ঋণ --
মৃন্ময় বঁসরিয়ার, বাঁকুড়া
কৌশিক বঁসরিয়ার, গিধনী, ঝাড়গ্রাম
অমরেশ মাহাতো, পুরুলিয়া
শ্রীকান্ত মাহাতো, পুরুলিয়া
মানভূম সংবাদ (বিশেষ কার্তিক সংখ্যা, ১৪২৮), সম্পাদক -- বিবেকানন্দ ত্রিপাঠী
🍂
1 Comments
এই পরবে র উৎস মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। পৌরাণিক নয়। ভালো প্রয়াস।
ReplyDelete