জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯৯
জঙ্গলমহলের পাহাড়
সূর্যকান্ত মাহাতো
"সবুজ পাহাড় ডাকে আয়রে ছুটে আয়
শ্যামলা পথের বাঁকে আয়রে ছুটে আয়
বাঁশি নিয়ে আয়রে, হাসি নিয়ে আয়..."
'নির্মলা মিশ্রের' কন্ঠে এই গান যেন আমাদেরই জঙ্গলমহলের পাহাড়গুলোর একরকম আহ্বান। জঙ্গলের আঁকা বাঁকা সবুজ পথ ধরে তাদের কাছে ছুটে যেতে ডাক দিচ্ছে। তাদের মাথার উপর চড়ে বসতে বলছে। সেখান থেকে ওই দূর দিগন্তে চেয়ে, সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কতসব গল্প ও কথাবার্তা হবে। সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছগাছালিতে ভরা সবুজ পাহাড়গুলো কার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলবে! তাই তো আমাদের ডাক দিয়ে চলেছে অনবরত। বয়ে চলা নদীর জল ও জলাধার, শালের গভীর জঙ্গলের মাঝেই মাথা তুলে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজ করছে পাহাড়গুলো। ছোট, বড়, লম্বা, বেঁটে, সরু, মোটা কিংবা ঝোপ ঝোপ গাছগুলো পাহাড়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা শরীর জুড়ে অবস্থান করে আছে। সবুজ পাতার ছাউনি দিয়ে পাহাড়কে ওরা সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছে। তাদের কত সব রং বেরঙের ফুল ও পাতা। সেই বাহারি ফুল ও পাতায় সেজে থাকে পাহাড়গুলো। যেন অলংকারে সুসজ্জিত। ছোট বড়, সাদা ও কালো কঠিন শিলা পাথরগুলো গায়ের উপর মুক্তোর মতো বসে আছে। কয়েকটা আবার ভয়ানক শরীর নিয়ে শূন্যে ঝুলে রয়েছে। পতনোন্মুখ ভাবে কেবল ঝুলে আছে। পড়ে গেলে হয়তো ধরণীতলকে চুম্বন করতে পারত, কিন্তু সে আশাও ক্ষীণ। শুধু বিপজ্জনকভাবে দিনের পর দিন এভাবেই ঝুলে রয়েছে।
'জঙ্গলমহল' মানে যে শুধুই জঙ্গল তা তো নয়! বড় বড় শাল, সেগুনের মাথার উপরে বিরাজ করছে ইয়াব্বড় বড় সব পাহাড়গুলো। মস্ত শরীর নিয়ে কেবল আকাশ পানে চেয়ে আছে। কেমন যেন ধীর, স্থির। মনে হয় বসে আছে। তবে কী দাঁড়িয়ে নেই! আছে হয় তো! তবে পাহাড়গুলোকে দেখলে মনে হয় না দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মনে হয়, ভারী শরীর নিয়ে কেবল মাথা উঁচু করে বসে আছে। আর আমাদের উপর মিটিমিটি করে দেখছে আর হাসছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতি যাই হয়ে উঠুক না কেন ওরা সর্বদাই নির্বাক আর নিশ্চল। কোন চঞ্চলতাই নেই। বরং ওদের নিয়ে আমাদের মধ্যেই বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
🍂
গোটা জঙ্গলমহলে যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পাহাড় রয়েছে গঠনগত ভাবে সবগুলোই প্রায় একইরকম। স্থান আর মাপে ছোট বড় ছাড়া সেরকমভাবে বিশেষ কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। তারপরেও সেগুলোকে জেলা অনুযায়ী বিভাজিত করলে দাঁড়ায় এইরকম---
বাঁকুড়া জেলার উল্লেখযোগ্য পাহাড়গুলি হল বিহারীনাথ, শুশুনিয়া, কড়ো পাহাড়, মশক পাহাড় প্রভৃতি। এছাড়াও বড়দি পাহাড়ের মতো অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় বা ডুংরি জেলার বিভিন্ন জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলো 'শুশুনিয়া পাহাড়'। প্রায় ২০০০ বছরের এক প্রাচীন ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা চন্দ্রবর্মার এক শিলালিপি এই পাহাড়ের গায়ে খোদিত আছে। বাঙালির বিষ্ণু উপাসনা যে কত প্রাচীন, তা এই শিলালিপিই সেই স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। লিপির সময়কালকে পন্ডিতেরা অনুমান করেছেন খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর কোন এক সময়কে। এই পাহাড়ে যে সব পাথর রয়েছে, সেগুলো টালি সহ একাধিক কাজে ব্যবহৃত হয়। পাহাড়ের পদতলে পাথর নির্মিত হস্তশিল্পই তার পাথুরে প্রমাণ। ট্রেকিং প্রশিক্ষণ শিবিরও বসে এই পাহাড়ে।পাহাড়ের পাদদেশে মেলাও বসে। সারা বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা তো লেগেই থাকে। এই পাহাড় নেড়া নয়। সবুজ গাছালিতে ভরা। পাহাড়ের বুক দিয়ে নেমে এসেছে পাহাড়ি ঝরনা। গড়িয়ে পড়া জলের একটা ঝিরঝির মিষ্টি শব্দ পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে একটু হলেও বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। শীতল সেই জল। পাহাড়ের দুটি চূড়া। একটি ছোট পাহাড়, অন্যটি বড় পাহাড় নামে পরিচিত। মাঝখানটা বেশ সমতল। এই পাহাড়ের সৌন্দর্য বলতে গেলে এক কথায় নয়নাভিরাম। চূড়া থেকে সমতলভূমিকে দেখলে মনে হবে, যেন নীল সমুদ্রতল।
বাঁকুড়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় হল, 'বিহারীনাথ' পাহাড়। এই পাহাড়ে এক সময় পেলিওলিথিক প্রত্ন সামগ্রী উদ্ধার হয়েছিল। তাই পুরাতাত্ত্বিকদের কাছে এই পাহাড় বেশ আগ্রহের একটি স্থান বলা যেতে পারে। এর পাদদেশে একটি বেশ বড় জলাধার গড়ে উঠেছে, যা পর্যটনের অন্যতম আকর্ষনীয় জায়গা হয়ে উঠেছে। তাই জল, জঙ্গল ও পাহাড়ের ত্রিবেণী সঙ্গম 'বিহারীনাথ' দর্শনে গেলেই দেখা যায়। পাহাড়ের অদূরে একটি জৈন মন্দিরও আছে। তার ঘন্টার শব্দ পাহাড়ের কোলে ধাক্কা খেতে খেতে মিলিয়ে যায়।
দক্ষিণ বাঁকুড়ার খাতড়ার মুকুটমনিপুর জলাধারের কাছেই রয়েছে কোড়া পাহাড়। বেশ লম্বা একটা গুহা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়টি। গুহাটা এতটাই বড় আর লম্বা যে সহজেই হেঁটে যাওয়া আসা করতে পারা যায়। গুহার ডাইনে-বামে অনেকগুলি কুঠুরি নিয়ে তৈরি এই গুহা। ছোট বড় একাধিক গাছের ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত পাহাড়টি।
খাতড়া এলাকার আরো একটি উল্লেখযোগ্য পাহাড় হলো 'মশক পাহাড়'। এই পাহাড়েও একটি প্রশস্ত গুহা আছে। পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। এই পাহাড়কে ঘিরে নানান কিংবদন্তি ও গল্প কথাও গড়ে উঠেছে। পাহাড়ে একসময় বসবাস করতেন এক সাধু। তাকে নিয়ে নানান কাহিনীও শোনা যায়। পাহাড়ের শিব মন্দিরটি তিনিই নাকি গড়ে তুলেছিলেন। এই পাহাড়ও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
রায়পুরের কাছে অবস্থান করছে 'বড়দি পাহাড়'। তবে এ পাহাড় বিরাট বড় নয়। কংসাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পাহাড়টি। শীতকালে এখানে পর্যটকদের বেশ ভাল রকম ভিড় হয়।
এদিকে পুরুলিয়ার পাহাড়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো---অযোধ্যা পাহাড়, পরশ পাহাড়, জয়চন্ডী পাহাড়, গুরুমা পাহাড়, পাঞ্চেত পাহাড়, ভান্ডারী, গজাবুরু প্রভৃতি। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ হল 'অযোধ্যা পাহাড়'। 'অযোধ্যা পাহাড়ের' সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল, 'গোর্গাবুরু'। উচ্চতা প্রায় ৬৭৭ মিটার। জেলার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ পাহাড় হল অযোধ্যা পাহাড়। একে দলমা পাহাড় ও পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি অংশ বলে মনে করা হয়। চামটুবুরু ও গোর্গাবুরু হল এই পাহাড়ের অন্যতম শৃঙ্গ। এই পাহাড়ে দুটি জলপ্রপাতও রয়েছে। একটি হলো 'ব্রাহ্মণী' জলপ্রপাত ও অন্যটি হল টুর্গা জলপ্রপাত। একাধিক গাছ-গাছালিতে ছাওয়া বেশ মনোরম পরিবেশ। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। চাষের ক্ষেত। সব কিছুই এমনভাবে সাজানো গোছানো মনে হবে যেন ছোটদের ছবি আঁকার খাতা। একটি সীতাকুণ্ড রয়েছে, যাকে একটি 'আর্টেজীয় কূপ' বলে মনে করা হয়। মকরের সময় 'টুরগা' বাঁধে বেশ বড় রকমের মেলা বসে। পাহাড়ে রয়েছে দীর্ঘ জলাধার। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। সেই পথ আর একটি ফরেস্ট বাংলো এই পাহাড়ের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়।
জঙ্গলমহল বললেই ঝাড়গ্রাম জেলার কথা সবার আগে মনে পড়ে। এই জেলার বেলপাহাড়ী অঞ্চলে ঢোকার মুখেই দূর থেকে দেখা যাবে ঢেউ খেলানো উঁচু নিচু পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে। একাধিক পাহাড় কেবল দূর থেকেই লক্ষ্য করা যায়। মনে হবে ঐ তো সামনেই। কিন্তু না। অদ্ভুত ভাবে আমরা এগোলে, পাহাড়গুলোও ক্রমশ পিছোতে থাকে। একাধিক পাহাড়ের মধ্যে বেলপাহাড়ীতে উল্লেখযোগ্য দুটি পাহাড় হল, 'কানাইসর' ও 'গাড়রাসিনী' পাহাড়। জেলার সর্বোচ্চ ও আয়তনে বড় পাহাড় হল এই কানাইসর পাহাড়টি। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের প্রথম শনিবার এই 'কানাইসর' পাহাড়ের পূজা হয়। বেশ বড় মেলা বসে। একে 'পাহাড় পূজার' মেলাও বলা হয়। প্রচুর ভক্ত ও মানুষের সমাগম ঘটে। সবুজ গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ থাকায় বেশ মনোরম লাগে দেখতে। বেলপাহাড়ীর অদূরেই আছে 'গাড়রাসিনী পাহাড়'। অঘ্রান মাসে এখানেও বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। প্রচুর সাধু সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে এখানে। একটি আশ্রম আছে পাহাড়ের পাদদেশে। একটা নিস্তব্ধতা সেখানে সর্বক্ষণ যেন বিরাজ করে। পাহাড়ের উপর একটি মন্দিরও আছে।
বেলপাহাড়ীর ওদলচুয়াতে আছে একটি রঙিন পাহাড়। পাহাড়ের পাথরগুলো দেখলে মনে হবে যেন রামধনু রঙে সাজানো। পড়ন্ত বিকেল কিংবা ঊষার আলোয় সে রঙ সব থেকে বেশি বিচ্ছুরিত হয়।
কোথাও জঙ্গল, কোথাও বিস্তৃত জলাধার নিয়ে ছোট বড় সাদা কালো পাথর আর সবুজ বনানী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলমহলের একাধিক পাহাড়গুলো। ন্যাড়া পাহাড় যে একেবারেই নেই তা নয়। বেশ কয়েকটা এরকম ন্যাড়া পাহাড় রয়েছে। মাথায় পড়া বৃষ্টির জল শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ার পর পাহাড়ের উজ্জ্বলতা যেন আরো বেড়ে যায়। এ সব কিছু নিয়েই পাহাড়গুলো জঙ্গলমহলে দিনের পর দিনের সাক্ষী বহন করে চলেছে।
0 Comments