জ্বলদর্চি

সুরের খেয়া /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

চিত্র- সম্পা সেনাপতি 

সুরের খেয়া

 আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

 শেষ আষাড়ের বর্ষণক্লান্ত বিষন্ন গোধূলিবেলায় লাল টিলার ধারের এই শালমহুয়ার ছায়াঘেরা একতলা বাড়িটির ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছেন এক সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়। অভিজাত চেহারায় শিক্ষা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ থাকলেও মুখখানি যেন তাঁর করুন ব্যথা-মলিন,দেখেই বোঝা যায়, কোন এক গভীর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন মানুষটির মন। 

তিনি সপ্তর্ষি; সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়,পেশায় শিক্ষক, এলাকার একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের। 
মনেও পড়েনা, সেই কবে শান্তিনিকেতনের পিতৃভূমি থেকে অরণ্যঘেঁসা এই ছোট্ট শহরটিতে এসেছিলেন, এসেছিলেন পেশা অনুসন্ধানে।চোখে কবিগুরুর আদর্শে মানুষ গড়ার স্বপ্ন,কন্ঠে ছিলো অথৈ সুর। শুধু উপার্জন নয়, এখানে এসে এখানকার মানুষজনের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন আত্মিক বন্ধনও, পড়াশোনা শেখানোর পাশাপাশি ছোট ছোটো বাচ্চাগুলিকে জীবন পাঠ দিতেও তাই ছিলেন ভীষণ আগ্রহী। আর এই সুত্রেই এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো ভূমিকন্যা তৃণার সঙ্গে, এখানকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও কনট্রাকটরের একমাত্র কন্যা। বাবা সারাদিন লোহা-বালি-সিমেন্টের চক্করে থাকলেও তৃণার মা ছিলেন আদ্যোপান্ত সংস্কৃতিমনা, তাঁর আগ্রহেই তৃণার নাচ শেখা,স্হানীয় অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা। সেদিন আলাপ হয়েছিলো তাঁর সঙ্গেও, সপ্তর্ষির গান পছন্দ হয়েছিলো রুচিশীল মহিলাটির। তাঁর আমন্ত্রণেই তৃণাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু; ক্রমে তা গভীরতর হয়ে প্রণয়,এবং শেষে পরিনয়ের দিকে গিয়েছে। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই,তারপরে চলেছে নিরন্তর সুখের আর সংস্কৃতি চর্চার সপ্তপদী গমন; সাফল্যের, স্বস্তির। এসেছে সম্মান, প্রতিষ্ঠা,সন্তান, আর যা যা কিছু।
🍂
আজ এই শহরের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত দম্পতি ওঁরা,বলা যেতে পারে, নিজেরাই একটি প্রতিষ্ঠান।

তবে,ঋতুচক্রের পালা পরিবর্তনের মতোই সুখ-দুঃখ পর্যায়ক্রমে ঘটে। মুখার্জী পরিবারেও এতদিনকার সুখ শরতের পরে যেন আষাঢ়মেঘ ছায়া ফেলেছে বাইরের পরিবেশের মতোই।  এমনিতে আপাত সজ্জন এই পরিবারে কখনও কেউ ঝগড়াঝাটির শব্দ শোনেনি। আশেপাশের ধুলিময় রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে একেবারে আলাদা এই বাড়ি, কারণ এ বাড়িতে সুর বাস করে, এ বাড়ির বাসিন্দাদের আশ্রয়ই হোল সুর। 

তবে ইদানিং এক গভীর পারিবারিক অশান্তির মূল ঘনিয়েছে পুত্র স্নেহাংশুকে নিয়ে। বড়ো স্বপ্ন দেখে দম্পতি তাঁদের একমাত্র সন্তানটিকে পাঠিয়েছিলেন প্রিয় শান্তিনিকেতনে,গান শিখেছে, পড়াশোনাও শিখেছে মেধাবী ছেলেটি, কিন্তু তার সাথে সাথে মন দিয়ে ফেলেছে এক বাংলাদেশী কন্যাকে,নাম শবনম। আর সমস্যা ঘনিয়েছে এখানেই। 

এতদিনের পরিশীলিত চেতনায় বারংবার সচেতন মনকে মানিয়ে নিতে বলছেন, কিন্তু পারিবারিক এবং আপনার অন্তর্গহনেও দ্বিধা। কুলীন ব্রাহ্মণ তাঁরা, বাড়িতে শালগ্রাম শিলার নিত্যসেবা হয়,বৎসরান্তে দুর্গাপূজা হয়,ধর্মনিষ্ঠ বিধবা মা আছেন... কিভাবে কোন বিধর্মী কন্যা এবাড়ির পুত্রবধূ হবে? বাড়িতে মেয়েটির কথা জানাজানি হওয়ার পরেই ছেলের মায়ের সিভিয়ার হার্ট-অ্যর্টাক হয়,বহু কষ্টে ফিরিয়ে এনেছেন, কিন্তু অপুর্ব নাচিয়ে মহিলাটি আজ হুইলচেয়ারে বন্দী, পক্ষাঘাত তাঁর পাদুটিতে নূপুর পরার অধিকার হরণ করেছে। এদিকে,ছেলেরও ধনুর্ভাঙা পণ,যদি বিবাহ হয় তো,ঐ মেয়েটির সঙ্গেই হবে।নতুবা নয়।

ছেলের অন্তর্বেদনার কথা বোঝেন তিনি,তিনিও তো পুরুষ! কিন্তু তিনি তো এ সংসারের কর্তাও, কখনও কখনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁকে।অগত্যা মা-স্ত্রীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আজ দেখা করতে চেয়েছেন মেয়েটির সাথে, কথামতো, আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে।
মানুষকে অসম্মান করতে শেখেননি কখনও, কিন্তু আজ হয়তো অসুস্থ স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মায়ের কথা ভেবে এ সম্পর্কে যতি টানতে হবে তাঁকেই,আর সেজন্যই বড়ো দ্বিধান্বিত মনটি আজকে তাঁর।

যাই হোক, সন্ধ্যায় এলো মেয়েটি। বাদল শেষের ভিজে পথ বেয়ে নরম গোধূলির আলো ধোওয়া পথে এসে দাঁড়ালো তাঁর দুয়ারে। দীঘল মৃগনয়নী দুটি চোখ,শ্যামলা রঙ,রোগা-পাতলা গড়ন; দোহারা চেহারায় এমন কিছুই বিশেষত্ব নেই,ঐ চোখদুটি ছাড়া, ভালো করে লক্ষ্য করলেন সপ্তর্ষি। 
পরনে চন্দনরঙের সাধারণ একখানি জামদানী শাড়ি, আধুনিক যুগের মেয়েরা এখনও শাড়ি পরে দেখে অবাক হলেন,বোঝা যাচ্ছিলো, মেয়েটি শাড়িতে বেশ স্বচ্ছন্দ্যও। একখানা বেণী ঘাড়ের পাশ দিয়ে নেমে এসেছে,যদিও কিছু অবাধ্য কুচোচুল বেণীর শাষন না মেনেই মেয়েটির মুখে এক অনিন্দ্য মহিমা দান করছে,কন্যাতূল্যা হলেও ওকে দেখে সংস্কৃতিমনা সপ্তর্ষির মনে পড়ছে জীবনানন্দের কথাগুলি,

'এ পৃথিবী একবারই পেয়েছে তাহারে'....

বাইরে তখন সঘন গহন বরিষন, বেশ কয়েকদিনের তপ্ত দাহের শেষে বৃষ্টি নেমেছে, বাড়ির পাশের বাগানের গন্ধরাজ তার গন্ধমাহাত্ম্য বিলোতে ব্যস্ত, জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে বাইরের স্নিগ্ধ জোলো হাওয়া। 
শান্তভঙ্গীতে এগিয়ে এসে মেয়েটি প্রণাম করলো তাঁকে।
কোন দেখনদারী নেই,কমবয়সী সুলভ চাপল্য নেই,পায়ের কাছে বসে স্নিগ্ধকন্ঠে শুধু বললো, 

-'আমি শবনম।'

অস্ফুটে তিনি বলেন উঠলেন,
-'গান জানো?'

-'হুম।গান শোনাতেই এসেছি,আর কোন প্রত্যাশা নেই আমার।'

-'বেশ।শোনাও।'

দুইহাত করজোড়ে কোলের কাছে রেখে মেয়েটি শুরু করলো গান....
-'সখি আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না…' 

বীণানন্দিত কন্ঠধ্বনি, অপুর্ব আবেদন;খাম্বাজের সুর উঠছে পড়ছে,যেন কার চিরবিরহের আর্তিটুকু গলায় নিয়ে কোন কিন্নরী নিবেদন করছে তার হৃদয়ার্ঘ্য 

......'যেন কার বাণী কভু কানে আনে,কভু আনেনা....,' তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে, অনেক, অনেক দিন আগেকার কোন কথা, এমনই কোন মাধবীসন্ধ্যায় স্টেজ রিহার্সালের ফাঁকে কোন কমলিকা এসে বলেছিল কোন অরুনেশ্বরকে,
-'রৌদ্রদাহ হলে সারা,নামবে কি ওর বর্ষাধারা'...,বহু বিভেদ জয় করে শুরু হয়েছিল এক নতুন যাত্রাপথ, আজও কি....; 
সুরস্নাত তিনি দেখছেন কখন যেন অন্ধকার বারান্দা উজিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে তাঁর পাশে এসে বসেছেন তৃণা!

একী!পা নড়ছে!অচল ছিলো যে পা, তাঁর অনেক দিনের প্রিয় নুপুরপরা রাতুলচরণ! নড়ছে! নড়ছে সুরের তালে! 

না।আর কোন দ্বিধা নেই তাঁর,সুরের গুরুদেব পথনির্দেশ দিলেন তাঁকে আবার,ভুল করার উপায় তো নেই তাঁর।গান থামতেই গুরুপ্রদত্ত তানপুরাটি নিয়ে এসে তুলে দিলেন মেয়েটির হাতে.... উত্তরাধিকারী তিনি পেয়ে গিয়েছেন,সুর যে ঈশ্বর,সুর না-নশ্বর!
বাইরে অন্ধকার নেমেছে, কিন্তু আর কোন আঁধার-দ্বন্দ্ব নেই তাঁর মনে,আজীবনের স্হির প্রত্যয়ে তিনি আস্হা রাখেন,সমাজ,জাত ,ধর্ম গড়ে মানুষ,দেবদত্ত হলো সুর।তাই হয়তো সুরের উত্তরাধিকার চিরন্তন;যেমন প্রতিটি অন্ধকার আলোর উৎস-অভিসারী...জয় হোক আলোকের, শাপমোচন হোক, শাপমোচন হোক...এক অনন্য ঋদ্ধতায় ভরে গেল তাঁর ঘর, তাঁর অন্তরও।

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

                          

Post a Comment

0 Comments