(পঞ্চম পর্ব)
অরূপ পলমল
সপ্তমত :
তা. .. শ্রী অরূপ কাংগাল মহারাজ, বলি, নিজে কিছু করো? কাজে-কর্মে? নাকি শুধুই মুখে বুলি আউড়ে যাও. ..? "চোখে আংগুল দাদা"র মতো---
ও হ্যাঁ!
তাহলে দু-একটা উদাহরণ তো দিতেই হয়--- আছে অনেক। তবে তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে পাঁচ-ছয়টা দিলাম। মানে পরপর নিম্নে…
॥অজানা গল্প: সাতশোল॥
২০০৯-এর 24শে অগাষ্ট তোদের
"হাইস্কুল "- এ জয়েন করি। তোর ভাই "চব্ব্য "- তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভ। ঠিক তার আগে দু-বছর গড়বেতা কলেজে পড়াই। তার আগেও just M.A পরীক্ষা শেষ করেই-রেজাল্ট পাইনি। মানে বেরোয়নি তখন থেকে বাংলা M. A-University Student-দের পড়াতাম। ফলে বড়দের পড়াতে পড়াতে ও নিজের M.Phil(যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) ছেড়ে দিয়ে তোদের সাত্শোলে টপকালাম। পেটের দায়ে।
বাবা মা - সংসার সবার দাবী মেনে।
প্রথম দিন! প্রার্থনার লাইনে দাঁড়ালাম। তোদের সাথে। নজর গেলো- তোদের পায়ের দিকে। অর্ধেক ছেলে-মেয়ের পায়ে জুতো টুকুও নেই।
খালি পা। জংগলময় পাথুরে লাল মোরাম মাটির দেশ- আর তোদের নগ্ন পা। সারি সারি। বুকটা কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। স্বাধীনোত্তর এক টুকরো ভারতবর্ষ। ব্যাস! হিরো - জিরো! একেবারে! [(যদিও এই স্কূল- এর চাকরিটুকু পাওয়ার জন্য কম চেষ্টা করিনি। কম কাঠ- খড়- ঘি পোড়াতে হয়নি। তিন তিনবার "হাফ-সফল" হয়ে- 'ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে'! 'ফুল রেস'-এ উতরানো আর আমার কপালে জুটছিলো না। অথচ পড়তে পড়তে কতো কতো বন্ধুরা আমায় পেছনে ফেলে ড্যাং. .. ড্যাং. .. করে নাচতে- নাচতে এক হাতে চাকরি ও এক হাতে মেয়ে নিয়ে আমায় কাঁচকলা দেখিয়ে দেখিয়ে চলে গেলো একা ফেলে। বন্ধুত্বের পাঠ যেন চাকরি ও মেয়ের কাছে গিয়েই শেষ হয়ে যায়- কয়েকজন কাছের বন্ধুর কাছে তো সেদিন তাই শিখেছিলাম। বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় ওরা যা শিখিয়েছিলো তাতে বুড়া চাণক্য পর্যন্ত হার মেনে পরাজয় স্বীকার করে ভীষ্মের মতো মৃত্যুবরণ করেছিলো সেদিন। সেচ্ছা মৃত্যুবরণ! যত নির্বোধের দল. ..!
আরে শোন. ..(হারামজাদার দল) ভালোই করেছিস সেদিন আমাদের কলেজ- university-র বন্ধুত্বকে লাথি মেরে। আমায় ছেড়ে। এতদিনের জীবনে একটাই এখন পর্যন্ত ইন্টেলেকচুয়াল কাজ করেছিস। না হলে আমিই কিছুদিনের মধ্যে তোদের ছাড়তাম। নির্বোধদের সাথে কতোদিন… আর কতটা পথ হাঁটা যায় বলতো? আসলে সেই University- র শেষদিন গুলোতে আমায় বড্ড অস্বস্তি ও লজ্জায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিলি অন্য প্রায় একশো জন বন্ধুদের কাছে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসতো মুখ টিপে টিপে। তোদের পাপের প্রায়শ্চিত একা আমায় করতে হয়েছিলো। সমুদ্রমন্থন শেষে অমৃতটা একারাই নিয়ে চলে গেলি। আমার জন্য ফেলে গেলি একভাণ্ড গরল। তোদের বামহাতে আকাশের চাঁদ ('ও প্রিয়া .. .ও প্রিয়া. .) আর ডানহাতে চাকরি ('সোনার পাথরবাটি')! সেই গরলে- কী জ্বালা আর যন্ত্রণা! কী ভীষণ প্রদাহ! জ্বলন! আ: জ্বালা! জ্বলন আর জ্বলন! সারা শরীর আর মাথা জুড়ে! এখনও জ্বলি আর পুড়ি! সে কী বুঝে রে বাবু / আন জনে কভু? (কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে?/কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।)]
ওসব 'ছোটোলোক'-দের কথা বাদ দে! ফিরে আয় 'বড়োলোক'-দের কথাতে।
প্রথম দিন তোদের স্কুল-এ লুকিয়ে লুকিয়ে জানিস তো খুব কেঁদেছিলাম… তখনও দু-দুখানা প্রাপ্ত "গোল্ড মেডেল"- এর অহংকারী গন্ধটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। (বেকার ছিলাম তো- অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই- এ - ওই দুটো গলায় ঝুলিয়েই তো তোদের ডাকতাম Tuition পড়াতে। আজ আর আমার কাছে ওগুলো নেই। শহরের ওপ্রান্তে লকার বন্দী। মুক্তি! কয়লার আবার কী সোনা লোভ রে? বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা! বল মানায়?
আর ঈশ্বরকে বলেছিলাম--- হ্যাঁ ঈশ্বর! এ আমায় কোথায় নিয়ে এসে ফেল্লে? এ কী পরীক্ষা নিতে চলেছ আমার? ঈশ্বর? কোন পাপের প্রায়শ্চিত?এদের কী পড়াব? এদের কী দেবো? আমি তো এদের সাথে মিশতেই পারবো না হয়তো? আমার মন তো তৈরী নয়?(জানিস দুদিন এতো ঠান্ডা লেগেছে নাক দিয়ে জল গড়িয়েই পড়ছে! এখন দেখ আবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো!)
হয়তো ঈশ্বরের এই ইচ্ছা ছিলো! আকাশ থেকে নামিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলতে চেয়েছিল হয়তো আমাকে। আমিও মেনে নিতে থাকলাম তোদের--
"এই করেছ ভালো, নিঠুর,
এই করেছ ভালো।
এমনি করে হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো।
আমার এ ধূপ না পোড়ালে
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে
দেয় না কিছুই আলো।
যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব
সেই তো পুরস্কার।"
তোদের মানিয়ে নেওয়া সেদিন সহজ ছিলো রে...অনেক। কারণ- "আমি তোমাদেরই লোক"! আজ মানিস আর না মানিস! মান আর নাই মান! কিন্তু "স্টাফ রূম"- মানিয়ে নেওয়া ছিলো ভীষণ শক্ত! আমি প্রায় বেমানান! প্রায় একঘরে! ওই সেই গতানুগতিক "থোড় বড়ি খাড়া...খাড়া বড়ি থোড়"! সেই…শাড়ি…পুজোর বাজার... lic…ব্লাউজ…লাউ চিংড়ি...আমার ছেলে … আমার মেয়ে...পুঁই খাড়া…উত্তম সুচিত্রা.... মান্নাদার কফি হাউস…কচি পাঁঠার বিচি…শুনতে শুনতে কান ও প্রাণ ওষ্ঠাগত। অতিষ্ঠ!"Empty vessels sound much."! ওখানেই হয়!(স্কূল "স্টাফ রূম "-একবারও বললাম না কিন্তু) আর পৃথিবীর কোথাও কোন সরকারী অফিসে-এমনটা হয় না। আমার অন্তত জানা নেই! এ বলে আমায় দেখ…ও বলে আমায় দেখ! হা…হা...হো…হো…
তাই একরকম সবদিনই আমি স্টাফদের চোখে ছিলাম দু-চোখের বিষ! বেমানান! অসামাজিক! বদরাগী! অসভ্য! অশিক্ষিত! মুর্খ! আবার অনেকে অহংকারীও বলতো প্রকাশ্যে। স্টাফরূমে কোনোদিন আসর জমাতে না পারলেও পুরোমাত্রায় পুষিয়ে নিতাম তোদের কাছে-- খেলে-দৌড়ে- মিলে-মিশে-হেসে-গল্পে- আড্ডায়! তাতেও কম আপত্তি উঠেনি। আমি নাকি হেসে-খেলে তোদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছি। আমার কী আর জীবনে কোন লক্ষ্য ছিলো? কাজ ছিলো রে.. .? তাই হেডমাস্টারকে অভিযোগ জানিয়ে কেউ কেউ টিফিন-এর সময় ধুলা-উড়ার অজুহাতে মুচলেকা জারি করালো-স্কুল মাঠে- ভলি-ফুটবল-ক্রিকেট - বা যা কিছু! বন্ধ! আচ্ছা হোক! ছেলেদের সাথে অন্যরা কেউ খেলবেও না---খেলতেও দেবে না! "আজব দেশ কা গজব কাহানি "! "ভাই মুঝে মার. .. মুঝে মার"!
তোরা মেয়েরা সেদিন কিন্তু বেশ "নারী নারী"- দাবী দাওয়া বুঝে নিতিস। তোরা তো সেদিনই এক একটা আস্ত "ফেমিনিস্ট" হয়ে উঠেছিলি। আজও তার বাহক ও ধারক। ফলে তোদের অভিযোগের শেষ থাকতো না!
ছেলেদের প্রতি! কে ঢিল ছুড়েছে…কে কী বলেছে…কে চোখ মেরেছে....চালাক ছিলি সবাই। অন্তত আমার চেয়ে সেদিন। কাকে ও কার কাছে অভিযোগ করলে টিকবে অভিযোগ- ঠিক তোদের মাথায় ছিলো। আমার বা আমাদের কাছে আসতিস না। তাই আজও আমার জন্মদিন পালন করলি না একবারও? হ্যাঁ রে.. .ব্যাপারটা বেশ "ফেমিনিস্ট. ..ফেমিনিস্ট"... তাই না রে... ?
আমি তো নবম শ্রেণীতে (আমার একক হেফাজতে প্রথম পেতাম তোদের) প্রথম দিনই বলে দিতাম তোদের স্পষ্ট বাক্যে- যে অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসবি…আগে 'বাপের ঘরে' খবর দিয়ে আসবি...বাইক নিয়ে আসতে বলবি... কারণ তোর মাথাটা ইঁটের পাঁচ ইঞ্চি প্লাস্টারবিহীন দেওয়ালে ঠুকব…তারপর শুনবো তোর সমস্যা... রক্ত বেরোলে ডাক্তার ঘর নিয়ে যেতে হবে তো…তাই বাইক এর জোগাড় আগে থেকে। আমি পড়াতে এসেছি...তোদের "ফেমিনিস্ট" চেতনার মীমাংসা দাতা নই। ব্যাস! চুপ! সারা বছর! কোন অভিযোগ আর নেই!
##
[ধারাবাহিক॥ পরবর্তী অংশ বিরতির পর]
0 Comments