জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( অষ্টাত্রিংশতি পর্ব )/ শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( অষ্টাত্রিংশতি পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

অঘ্রানের কালসাবা মাঠের রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মইষাখালি বিলে কাকচক্ষু জল। কাচপারা সেই জলে তিরতির করে ঢেউ এঁকে দিচ্ছে জলছবি। জলের দিকে তাকালে বিলের তলা অব্দি যেন  দেখা যায়। খলসাখালি বিলে প্রচুর মাছ হয়। অনেক বড় বিল। বেশি শোল, গোড়ই,বোয়াল,আর প্যাকাল মাছ হয়। ঢোল জানে খলসাখালির পাঁকের তলায় টাকা। পাঁক ঘাঁটতে পারলেই প্যাকাল ধরা সহজ। তবে সবাই প্যাকাল মাছকে কায়দা করতে পারে না। জগা আর জগার বউ প্যাকাল মাছ ধরতে অস্তাদ। তাবাদে প্রচুর ঝিনুিক হয় বিলের এঁটাল পাঁকে। জগার বউ জানে মাছের আগে চিছুন তাড়গাতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। বিল ডাকার মত ট্যাঁকের জোর জগার নেই। বেশিরভাগ বছর কালসাবার বিল ডাক দ্যায ভুটারু। দোলই পাড়ার ভূতনাথ। জগা আর জগার বউকে ভুটারু মাছ ধরতে মজুর করে। বিলের মাছ ধরা হয়ে গেলে জগার বউ পাঁক তেড়ে চিছুন তুলে। সেই চিছুন বিক্রি করে উপরি কিছু কামানি হয় তাদের। তবে চিছুন তুলার সময় কিছু মাছও তার পেত। ইদানীং তা আর কপালে জুটে না। ভুটারু কোথা থেকে মাছ ধরার নতুন কায়তা জেনেছে। বিলের জল মারা হয়ে গেলে ইউরিয়া সার ছড়ি দ্যায় পাঁকে। তাতে সব মাছ পাঁকের উপরে উঠে যায়। এমনকি ষিঙি-মাগুর পর্যন্ত। জগা শিঙি মাছ মুঠা মুঠা করে ধরতে পারে। শিঙি বিঁধালেও তার তেমন যন্ত্রনা করে না। যদিও এক আধবার শিঙি কাঁটা ফুটাল তো,অস্নি জগা পাঁক থেকে আড়ায় উঠে আসে। তারপর বিলকুঁড়ার আড়ালে যায়। আর হাতের যেখানে কাঁটা বিঁধে,সেখানে পেচ্ছাব করে দ্যায়। জগার কাছে এটা একটা অব্যর্থ টটকা। এতে নাকি যন্ত্রনা থেমে যায়। তার পর ফুকফুক করে দু'চার টান বিড়ি ফুঁকে আবার বিলের কোমর ডুবা পাঁকে নেমে পড়ে। খসলাখালির ডাক ওঠে সবার চেয়ে বেশি টাকায়। কালসাবা মাঠের শস্য বলতে মাছকেও বলা যায়। সারা মাঠ জুুড়েই তো খালবিল।বছর বছর গ্রামের মিটিংয়ে বিলের ডাক দ্যায। সেই ডাকের  টাকায় গ্রামের কালিপূজা হয়। তবে বিলগুলোর মধ্যে বালিবিল খুব ভয়ের। সারাটা বিল ভরা থাকে হগলা বনে। জলে নামতে গা ছমছম করবে সবার। সহজে কেউ বালি বিলে নামতে চায় না। গেঁড়িভাঙা কালসাপ থাকে হগলা বনে। তবে একটু জল কমে গেলে পাতাকাটি দিয়ে ঢোলের অনেকেই হগলা কেটে আনে। হগলা শুকিয়ে দুয়ার ঘেরার বেড়া বানায়। ফি-বছর হগলার বেড়া বদলে দেয় অনেকেই। বালি বিলে শুধু সাপ নয়,হাওয়া-বাতাসের ভয় আছে। সন্ধ্যা এক দু'পা গড়ালেই বালিবিলমুখো হতে কেউ আর সাহস পায় না। কত গল্প শোনা যায় ওই বিল নিয়ে। বহু আগে বানবন্যার সময় কোথা থেকে একটা এয়ো মেয়ের লাশ এসে বালিবিলের বনে আটকে যায়। বানের জল আস্তে আস্তে মরে গেলে হগলা বনে পচে গলে ওই লাশ জলের তলায় চলে যায়। সেই থেকে বহু বছর বালিবিলের ডাক বন্ধ থাকে। হালে ক'বছর হল আবার চালু হয়েছে। কিন্তু তার পর থেকেই নানা অবাস্তব কান্ডকারখানা ঘটেই থাকে। বন্ধের পরে সেই প্রথম বিলের ডাকে নেয় ঢোলের বাদলা সিং। মাঠের সব বিলের শেষে বালিবিলের জল মেরে মাছ ধরবে বলে মেশিন বসায়। তার আগে খড়ের ছাউনির বিলকুঁড়া করে। বিলবুড়ির পূজা দ্যায়।বাদলা খুব সাহসী হলেও মনের ভিতরে চাপা একটু ভয় তার ছিল। বালিবিল থেকে মাছ চুরির কোন ভাবনা তার ছিল না। তবে খুব ভরে মাছ ধরে আড়ত না নিয়ে গেলে পড়তা মোটেই হবে না। সেই কারণে রাতে বিলে থাকতেই হত। সেবার বাদলা একা নয়, ভূতা,গুয়া আর লবাকে নিয় তারা চারজন বিলে ছিল।বাদলা বাদে সবাই একটু আধটু নেশাও করেছিল। পৌষ মাসের শীতের রাত। বিলকুঁড়ার ভিতরে গরম খারপ ছিল না। নেশার ঘোরে সবাই ঘুমিয়ে যায়। তবে অনেক রাতে হঠাৎ জলের ছপ্ ছপ্ শব্দে বাদলার ঘুম ভেঙে যায়। বাদলা বিকালবেলা মেশিন বসানোর আগেই বুঝেছিল,বিলে মাছ ভালোই আছে। আসলে  বিলটাতে মাছ তো ধরেনি কেউ এতদিন। বন্যায় তো আর সব মাছ চলে যায় না বিল থেকে। মাছদেরও মায়া পড়ে যায় এক জায়গায় থেকে থেকে। জলে মাছের ঘাই দেখে বাদলা ভেবেছিল অনেক বড় মাছ সত্যিই আছে বিলে। জলের শব্দে ভাবে কারা হয়তো মাছ চুরি করতে এসেছে।  শীতের রাত সাঁইসাঁই করছে। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে বাদলার। মানুষকে তার ভয় নেই। বিলে রাত জাগতে হয় বলে সে আগেভাগেই সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।ঘরে থাক আর বিলে রাত নামলেই তার হাতে একটা তিন সেল ব্যাটারীর টর্চ থাকবেই। কুঁড়ার ভিতর মাথা সিতানে রাখে একটা ছ'ফলার কেঁচা। লিকলিকা ধারের একটা হেঁসাও রাখে তালাইয়ের পেটে বিছানো খড়ের নীচে। ঘুমটা ভাঙতেই উঠে বসে টর্চটা হাতে নেয়। কুঁড়ার মুখটায় চটের একটা থোলা ঝুলানো থাকে। তবে বাদলা যেদিকে শোয়, কুঁড়ার সেদিকটার খড় সরিয়ে একটা ছোট্ট ফোকরের মত করা থাকে। প্রতিবারেই বিলের দিকে মুখ করা থাকে ওই এক চাখর ফোকরের। বাদলা প্রথমে সেই ফোকর দিয়ে টর্চ মেরে বিলটা দেখতে চায়। কিন্তু ভাবে আলোর আভা দেখে যদি দৌড় লাগায়,তাহলে হাতেনাতে ধরা যাবে না। তাই আগে ফোকর দিয়ে আলো না মেরে উঁকি মারে বিলের দিকে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার হলেও বিলের এপার থেকে সেইপার ঠাহর করতে অসুবিধা হয় না। বাদলা দেখে বিলে জনমানস কেউ নেই। তবে বিলের মাঝে একটা সাদা থান পরা কে যেন খপ খপ করে মাছ ধরছে। তার চোখ দুটা আঙরার মতো দাউদাউ করছে। হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে বাদলার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। রাতভিতে খালেবিলে ঘুরতে হয় বলে বাদলা গা-বন্দ দেওয়ার মন্ত্র শিখে রেখেছিল। মনে মনে তিন বার মন্ত্র আউড়ে নিজের গা-বন্দ দিয়ে নেয়। আর কাউকে ঘুম থেকে ডাকার মতো গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না তার। বেশ কিছুক্ষণ ছপছাপ করে গোটা বিলটা ঘুরতে দেখে বাদলা সেই ছায়া মূর্তিটাকে। তারপর হঠাৎই মিলিয়ে যায়। বাদলার ততক্ষণে পেচ্ছাবের বেগ এলেও কুঁড়া থেকে বাইরে বেরোতে সাহস পায় না। সুড়সুড় করে কাঁথার ভিতরে ঢুকে পড়ে সে। হাতে শক্ত করে ধরে রাখে হেঁসাটা। তারপর কখন ঘুমে সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে জানে না। হঠাৎ গুয়া তাকে ঠ্যালা মারে,
— কি গো বাদলাদো! ভোর ঝুঝুকা হই গেল যে! উঠবেনি? কখন নামবো বিলে?
—শরীরটা বোধায় পারেনি। ঘুমি যা। সকালা ধোরব খন। আজগে আড়তকে যাবোনি।
— কুন্তু মাছ গুলান যে লষ্ট হই যাবে! চুনাচাপসা গুলানকেও ত রাখা যাবেনি। পেট পচে যাবে ত অদের।
—গ্যালে, যাউ। বোড়ো গুলানকে জিয়ি রেখে দুব খন। 
— খুম কি শরীলটা খারাব বুজঠ? ঘরকে যাবে?
– না রে,তুই ঘুমা না। সকাল হউ খন। যা বোলিঠি শুন দিখি। ঘুমি যা, আমি ঠিক সময়ে তোকে ডেকে দুব খন।
গুয়া আর কথা বাড়ায় না। এই কনকনা শীতে পাঁকে নামতে কার মন চায়! তবে মজুর খাটতে এসে ত আর আরাম খুঁজলে হয় না। কিন্তু মালিক যখন গা ঢিলা দিচ্ছে তখন আগ বাড়িয়ে বেশি হুড়পাড় করার দরকার নাই। গুয়া কাঁথার ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে নেয়। ভূতা আর লবার ঘুমের ঘোর তখনো কাটেনি। মড়ার মতো পড়ে আছে তারা। শোলমাছ পড়া দিয়ে ভালোই মদ তারা খেয়েছিল রাতে। বাদলা বহুবার খেঁকি উঠেছিল,
– আকাড়ে পেয়ে ধাকাড়ে দিউঠু যে রে তরা। কালকে ভোরে বিলে নামতে হবে মনে আছে ত? যেদি টাউমমত না উঠু ত পঁদে লাত মেরে তুলব খন।
লবার জিভ আর তখন সোজা ছিল না। মাঝে মাঝেই গান ধরছিল নেশার ঘোরে। লবা নামের দলে গান করে। তবে মদ পেটে পড়লেই নানা ধরনের গান করে। সেই মুহুর্তে লবার শ্রোতা দু'জন ভূতা আর গুয়া। ভূতাও তখন নেশায় ভরপুর। গুয়া সবদিন একটু কম খায়। কুঁড়ার পাশে লাড়া ছিঁড়ে আগুন জ্বালায়। তাতে কলাপাতা জড়িয়ে শোলমাছ পোড়া করতে দ্যায়। সেই শোল পোড়ায় কাঁচা সরসার তেল, নুন,লঙ্কা চটকে মদের চাঁট বানায়। গুয়া বলে,
– লবাদ্দো, সেই গানটা ধর দিখি। গানটা শুনলে মনে হয়, মোদের জন্নেই বোধায় গেইচে।
— কুন গানটা বল,গাইঠি।
— অই যে 'পয়সা নাই যার  মরণ ভাল এ সংসারে..'
ভূতা বাধা দেয়। মদের গেলাস রেখে বলে,
—ধূর! মরা টরার গান ছার দিখি। পয়সা সোদের না থাকে থাউ। মোদের জাতের কপালে পয়সা নাই। কুন্তু মোদের মন আছে। আর যার মন আছে, তার সব আছে, বুজলু! তারচে লবাদ্দো তুই ওইটা গা দিখি। গোষ্ঠ গপাল গেইছে যে গানটা রে,'টেংরা তবু  কাটান যায়,মাহুর মাছটা কেটকেটায়…'
গতিক থেকে বাদলা আবার ঝাপট দ্যায়,
— তরা সবাই মালে টোর হয়ে গেছু। তোদের আর আসর বসাতে হবেনি। এবার গুছি দিয়ে শুয়ে যা। আমি মেশিন বন্দ করে শুয়ে যাইঠি।
তার কিছুক্ষণ পর থেকে সেই যে তারা দু'জনে কুঁড়ায় কাঁথার ভিতরে সেঁধিয়ে যায,তখন থেকেই কাদামারা হয়ে পড়ে থাকে। বাদলার সঙ্গে গুয়ার এতক্ষণ ধরে চলা কথার একটি শব্দও তাদের কানে যায় না।
চাঁদ পীরের আস্তানা থেকে আজানের ডাক শোনা গেলে বাদলা উঠে পড়ে। যদিও সেই থেকে সে চোখে -পাতায় এক করতে পারেনি।তারপর একে একে সবার ঘুম ভাঙায়। বাইরে হাল্কা কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। ধড়ফড় করে উঠেই গুয়া আগে জিগ্যেস করে,
— কালকে তমার কী হইছিল বল দিখি আগে!
লবা আর ভূতা তার কথার মাথামুন্ডু না বুঝতে পেরে হাঁ করে গুয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বাদলা মাথা সিতানে রাখা প্লাস্টির মগটা নিয়ে ঘটঘট করে একপেট জল খায়। তারপর সব কথা তাদেরকে বলে। শুনে সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম। বাদলা বলে,
— দেখবি, বিলে কুুনু মাছ থাকবেনি। তাবাদে মোদের পেরানটা যে বেঁচেছে সেই রক্ষা। আসলে এঁসা জাল আর মোর লুহার যন্তগুলান বিসনায় ছিল বলে মোদের দিকে ছুঁতে সাহস পাইনি। বেঁোচে থাকলে ঢের রোজগার কোরব। সকালটা হলেই কুঁড়া ভেঙে লিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি। মোর মাছটাছের কুনু দরকার নাই।
সত্যিই সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুঁড়া ভাঙতে লেগে যায় গুয়া। বাদলা বারণ করলেও ভূতা আর লবা ছোট সারেঙ জালটা টানতে শুরু করে। আশ্চর্যের কথা, একটা ডেঁড়ামাছ অব্দি জালে পড়ে না। সেই থেকে বালিবিলের ধারে খুব একটা কেউ ঘেঁষতে চায় না।

অনেকদিন পরে জগার সঙ্গেও অমন একটা ঘটনা ঘটে। বালিবিলে কাদাখোঁচা আর বেঙড়ি পাখি বেশি দেখা যায। জগা বলে কাদাকুচকুিচি। সে তো জাত শিকারী! কাদাখোঁচার মাংস জগার খুব পছন্দের। তাবাদে ঢোলের অনেকেই বেঙড়ি আর কাদাকুচকুচির মাংস খায়। বিশেষ করে মদের সঙ্গে খেতে পছন্দ করে। জগার অনেক রকমের ফাঁদ আছে পাখি ধরার। সেবার বেঙড়ি ধরার জাল আড়তে বালিবিল যায় জগা। যদিও বাদলা সিংয়ের ঘটনাটা অনেকের মতো জগাও জানত। কিন্তু সে জানে বালিবিলের হগলা বনে ওইসব পাখি বেশি নামে। বেশি পাখি ধরা মানে নিজের মাংস খাওয়াটা যেমন হবে,সাথে দু'চারটা পাখি বেচে দু'পয়সা হাতে আসবে। পয়সার লোভ কার নাই! জগার মতো মানুষদের এই চাওয়াটাকে যদিও লোভ বলা যায় না। কদিন ধরেই বালি বিলকে ফাঁদ আড়তে যাওয়ার ইচ্ছেটা তার মাথায় ঘুরছিল। ঘরে বউকে সেকথা জানায়নি। জগা জানে বালিবিলের কথা উঠলেই তাকে গাল পেড়ে অস্থির করবে। তারচে সে না জানিয়েই যাবে। কিন্তু তারপর যা ঘটে জগা কখনো সেকথা ভুলতে পারবে না। তখন বটু গুনীন বেঁচেছিল। তার জলপড়া আর মাদুলির জোরে সেবার জগা রক্ষা পায়। তিন চার দিন ঘোরের মধ্যে পড়েছিল ঘরে। বটু গুনীন দুবেলা এসে মন্ত্র আউড়াত। কাল সরসায় মন্ত্র  পোড়ে ছড়িয়ে দিত জগার ঘরের চারপাশে। হুঁশ ফিরলে, কদিন বাদে বটু গুনীন জিগ্যেস করে,
— কি রে জগা তুই মাঝমাঠে পড়েছিলি ক্যানে? ক্যানে গেইলু তুই মাঠকে?
চোখমুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ তার স্পষ্ট। প্রথমটা তো বলতেই সাহস পাচ্ছিল না। তারপর বটু গুনীন তাকে ভরসা দ্যায়।
— তোর এখন কুনু ভয় নাই। সব কায়দাকরণ আমি কোদ্দিছি। কুনু হাওয়াবাতাস,কুনজর তোকে ছুঁতে পারবেনি। তুই বল দিখি মোকে,বল।
—তুমি ত জান মোর ফাঁদ আড়ার নেশা। ত শুনতম বালিবিলে নাকি পচুর বেঙড়ি আর কাদাকুচকুচি নামে। ত তমার বৌমাকে না বলে,সেদিন তিরসন্ধার সময় বালিবিলকে ফাঁদ আড়তে যাই। লাইলনের ব্যাগটার হাতলে গামছাটাকে বেঁধে পৈতার মত কাঁদ থিকে সাইটে ঝুলানা ছিল। তায় একটা হেঁসা আর বেঙড়ি ফাঁদ ছিল। আর হাতে ছিল টচ-লাইট আর একটা গেঁঠা বাঁশের লাঠি। উ লঠিটা মোর সবদিন থাকে। খুম খর খর গেছি। জানি ফাঁদ এড়ে দিয়েই পালি এসব। তারপর সকালা যাব খন।

বলেই আবার শুকনো মুখে বটু গুনীনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। রক্তশূন্য রুগীর মতো জগার মুখটা সাদাটে দেখায়। বটু গুনীন গলাটার স্বরকে ঝাঁঝিয়ে বলে,
—আবার থেমে গেলু ক্যানে! তারপরে কি কোল্লু? তোর কী মনে এত ভয় ঢুকে গেছে? বোটা গুনীন থাকতে তোর একটা চুলও ছিঁড়তে পারবেনি! বল,তারপর কী হোল?
— ত জানি পালি এসব। কিন্তু ফাঁদটা আড়তে আড়তে দেখি হগলা বনের ধারে ধারে বেঙড়ি চরেঠে। লোভও হয়ঠে। আবার ভয়ও পায়ঠে। মা কালীকে ডেকে ভাবলম একটু বসে যাই। যদি দু'একটা এটকি যায় ত এখুনি লি জিয়ে কষে লুব ঝালবান্না দিয়ে। বলে ত বেনাঝাড়ের ধারে গা মেরে বসে রইলম। তা ঘন্টা খানেক বসে রই গেছি বোধায়। কুন্তু শুদু পাখি গুলানকে চরতেই দেখিঠি, একটাকেও ফাঁদে জগাতে দেখিনি। তখন আর সাহস পাচ্ছিলম নি। কালসাবার মাঝ মাঠ। ওখিন থিকে এক দুটা ভিটার আলো দেখতে পাচ্ছিলম কিন কিন করে। বিপদ হলে ছুটে এসতেও দম ফুরি যাবে। সাতপাঁচ ভেবে ঘর এসব বলে হাঁটতে শুরু কোল্লম। হঠাৎ এক ঝটকা বাতাস এল,জান,বিলের দিক থিকে। তারপর আর ঘর এসার দিকটা যেন ঠিক কোত্তে পাল্লম নি। গটা মাঠ সুদু চাকাপাক ঘুরিঠি। যত হাঁটিঠি,রাস্তা যেন ফুরাতে চায়নি। লাইটা হাতে আছে। লাঠিটাও ধরে রেখেচি মুঠা কোরে। দেকতে পাইঠি কালী মন্দিরের আলর আভা কুন্তু রাস্তা কুনুমতে শেষ হয়ঠেনি। কে যেন মোকে পুয়াল কুঁটি মাড়ানা গরুর মতো ঠায় ঘুরায়ঠে। গলা দিয়ে রা কাড়তে পারিঠি নি। তারপর হাঁপ লিতে আর পাচ্ছিলম নি। একটা হিঁড়ের উবরে বসে পড়ি। চারদিক সাঁইসাঁই করেঠে তখন। চিচকার করে ডাকিঠি কুন্তু নিজেই নিজে শুনতে পাইনি। আর কিছু জানিনি।
জগার জানারও কথা নয়। রাত বাড়ছে কিন্তু জগা বাড়ি ফেরেনি। জগার বউ বাখুলের লোককে ডেকে বলে। প্রথমে সবাই ভাবে মাল দোকানে হয়ত জগা নেশার ঘোরে বসে আছে। কিন্তু রাত আরো গভীর হলে জগার বউ কান্নাকাটি শুরু করে। তখন দল ভাগ করে জগাকে খুঁজতে বের হয়। একদল বাজারের দিকে যায়। মেয়ে বউড়িরা ভিটার চারপাশটা খোঁজ করে। বাকি একদল কালসাবার মাঠকে যায়। কিছুটা যাওয়ার পর সবার কানে একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পায়। সবাই সেইদিকে গিয়ে দেখে জগা উবু হয়ে বসে দুহাঁটুর ভিতর মুখ ঢুকিয়ে কাঁদছে আর হোঙাচ্ছে। সেই অবস্থায় সবাই জগাকে সোজা ধরে এনে তুলে বটু গুনীনের দুয়ারে। পরের দিন জানাজানি হয় ঢোলে জগার বালিবিলে ফাঁদ আড়তে যাওয়া বিপতের কথা।

Post a Comment

0 Comments