গ্রন্থ পর্যালোচনা : বাতাস পিঠে চাবুক হানে
ড . সালেহা খাতুন
আধুনিক বাংলা কবিতার বৃহত্তর একটি ধারা আনমনে এখনো আঁকড়ে রেখেছে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য আঙ্গিক ও মনোভাবনা। জ্বলদর্চি প্রকাশিত বিনোদ মণ্ডলের কাব্যগ্রন্থ "বাতাস পিঠে চাবুক হানে" হাতে তুলে নিতেই এ বোধ আরো জোরালো হয়ে ওঠে। মলাট এবং মলাটের মধ্যবর্তী পৃষ্ঠায় বিনোদের সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যপ্রীতির নিদর্শন সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবেই।
"বাতাস পিঠে চাবুক হানে"-র কবি সাহিত্য রসিক এবং সাহিত্য স্রষ্টা। গদ্য-পদ্য-নিবন্ধের নানান সমাদৃত গ্রন্থরাজি প্রমাণ দেয় তাঁর জাগরুক সত্তার। যে মানুষ জেগে থাকেন যাঁর বিবেক জাগ্রত থাকে তিনি প্রান্তবাসীর যন্ত্রণাকে, সাধারণের অস্থিরতাকে চিরতরে দূর করার স্বপ্ন দেখেন আর রচনা করেন 'ছড়ায় ছড়ি কলজেখানা'। ঘোষণা করেন- 'আমার ছড়া প্রান্তবাসীর!... আমার ছড়া পান্থ বাসীর।'
খেটে খাওয়া শ্রমিক তথা রং মিস্ত্রীর জীবন কবির মনে জেগে ওঠে। ছড়ার ছন্দে কবির মেধা এঁকে যায় রং মিস্ত্রী 'কুট্টি'র জীবন। অনেক কঠিন কথা সহজভাবে বুনে যান তিনি - 'সারাদিন সং সেজে/ গায়ে মেখে পুট্টি/ দেওয়ালেতে বাঁশ বেঁধে/ রং করে কুট্টি!'
সহজ কথা সহজ করে বলতে বলতে কবি নিজেই ভারাক্রান্ত হয়ে যান আর খোঁজেন 'মন খারাপের ওষুধ'। মনোবিদের দ্বারস্থ অবশ্য তিনি হন না। প্রিয়জনের পরশই তাঁকে সুস্থ করে তোলে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন- 'বাতাস পিঠে চাবুক হানে /আকাশ আনে বজ্র/ শান্তি কবে ফুঁকছে শিঙে -/ বেজায় ঢিমে কান তো!'
আর বিনোদ লিখলেন 'বাতাস পিঠে চাবুক হানে/ কশাই /এখনো দ্বিধা সমুখ পানে/ মশাই!'
বিনোদ কি মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপে মত্ত হলেন? এ 'মশাই' কি সুভাষ মুখোপাধ্যায়? যাঁরা পদ্য-কবিতা পড়েন ও ভালবাসেন তাঁরা এর উত্তর নিজেরাই ভালো জানেন। এখনো সবাই সুখে শান্তিতে সমান অধিকারে নেই। মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। তাই কবি 'শপথ' নেন-
'যে হাটে লোক আসে না/ হয় না কোনো বেচা কেনা/ যে হাটে
লাভের মুখ/ কেউ দেখে না, সবই দেনা/ আমি যাবো না সেই হাটে।'
কাজ হারানো, লাজ হারানো, ভাত হারানো, জাত হারানো দীনের যন্ত্রণা-কান্নায় কবি দিশা খোঁজেন 'বাঘা যতীন'-এর কাছে।
শুধুমাত্র আর্থসামাজিক কারণই নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগও অসহায় মানুষকে আরো অসহায় করে তোলে। কেলেঘাইয়ের বন্যা, তীরবর্তী মানুষদের যে দুর্দশায় ফেলে আর সে দুর্দশা থেকে মুক্তির চিত্র কবি এঁকেছেন
'বান ব্যথা'য়।
'আদর্শ ছড়া'-র একটি নির্দেশিকা নির্মাণে ব্রতী কবি 'লিচুচোর'-এর কবি নজরুলকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
🍂
কবি সামাজিক। সংবেদনশীল। তাঁকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে রাক্ষুসী সময়। যে সময়ে মেয়েরা বাইরে আর নিরাপদ নয়। ভ্রাতার মতোই সস্নেহে সাবধানে তাদের বাড়ি ফিরতে বলেন। এ প্রসঙ্গে কবির কাছে একটি প্রশ্ন তুলতেই পারি মেয়েরা বাড়িতেও কি নিরাপদে থাকতে পারে?
'হাসি' কবিতায় শিশুর হাসি,
'নৈশ প্রহরী'তে গৃহিনীর গঞ্জনা, 'আসবি যদি আয়'- এ উর্বশী, 'ডি জে'-র তাণ্ডব, 'চাষি'র ঋণের দায় তবুও 'জীবন' বেঁচে যায় রোদ্দুরের কৃপায়।
'কথার পিঠে কথা' গেঁথে কবি প্রাণের মানুষকে খুঁজছেন। গোলা'গুলি'-র হাঙ্গামায় তিতুমিরকে স্মরণে কবির দেশপ্রীতি এবং ইতিহাস সম্পৃক্তির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'শীত' কবিতায় হাঁটু কেঁপে ওঠায় 'ঠনঠনিয়া' শব্দ ব্যবহারে মন ছুটে যায় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায়। 'মেসেজ', 'ছোট্ট পাখি', 'নিত্য ইতিহাস', 'দুই মেরু, পৃথ্বীর', 'গুজব', 'অর্ক'রা', 'খই', 'আঢ্যিদা', 'ছাতা', 'আচম্বিতে' থেকে শুরু করে 'সুখ' পর্যন্ত প্রায় সব কবিতাগুলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় পদ্যগুলি পাঠকের মনে ছন্দের একটা দোলা জাগিয়ে দেয়।
"বাতাস পিঠে চাবুক হানে" গ্রন্থে স্রষ্টার অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজ-রাজনীতি সচেতন হয়েও তিনি কিছুটা ব্যক্তিগত জীবনবোধেরও পরিচয় রেখেছেন এ গ্রন্থে। কবিচিত্তের অস্থিরতা প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসী বাবার ব্যথায়- 'দূরে কোথাও খোকা ঘুমায় ঘরে/ প্রবাসী বাবা ব্যথায় বোবা; কাঁদে অন্তরে।'
সাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি পৃথিবীর দুই মেরুর দ্বন্দ্ব ভুলতে দেন না - 'সুইমিং পুলে বাস / রোববার দুপুরে।/রোজ দিন আমরা তো/ চান সারি পুকুরে!'
এ গ্রন্থের পদ্যগুলির অন্ত্যমিল অর্থময় শব্দাশ্রিত। উদাহরণ স্বরূপ নেওয়া যেতে পারে- 'মেলার মাঠে খণ্ডহর/ ইতস্তত চরছে গরু /বেলা তখন তিনপ্রহর/ জনশূন্য ঊষর মরু!'
সুখের সন্ধানে কবির আবেগের প্রতিফলন ঘটেছে পুনরুক্তির মধ্য দিয়ে - কখন উঠো, কখন সারো, কখন পড়তে বসো, কখন পুজোয় বসো ইত্যাদি প্রশ্নে জেরবার করেছেন 'সুখ' কবিতাটিকে।
শেষপর্যন্ত মানবিক হওয়ার মধ্যেই আসল সুখের সন্ধান দিয়েছেন।
সবশেষে একথা আমরা বলতেই পারি বাতাস পিঠে চাবুক না হেনে সুখেরই সন্ধান দেবে। সে সুখ অবশ্য ওজন দরে মাপা যায় না।
----------
0 Comments