বাগদি চরিত (চত্বারিংশতি পর্ব )
শ্রীজিৎ জানা
ভগী খুড়া সেদিন বিলের পাড়ে বসে লোখার কাছে গল্প শুনিয়েছিল। লোখা তো উদাস পাগাল। ঢোলেকে নিয়ে যত গল্প,সবেতেই তার বড় আগ্রহ। বড় আমোদ আহ্ললাদ। তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে সেইসব গল্প- কথা । কাজ ভুলে যায় অনেক সময়। শুনতে শুনতে কতরকম ভাব তার চোখে মুখে ফুটে উঠে। কতবার তো ভগী খুড়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– দেখ খুড়া,দেখ,তমার কথা শুনে ক্যামন গায়ের লোম টেংরি গ্যাছে! যাই বল তুমি, নিজের গেরামের পুরান দিনের কথা শুনলে মোর ভিতরটায় ক্যাম যেন হয়।
কখনো ভগী খুড়া হয়তো ঢোলের কালিপূজা নিয়ে কোন গল্প শুরু করেছে,অম্নি লোখা ক্ষণে ক্ষণে কপালে হাত জোড় করে প্রণাম করা শুরু করবে। আর বলবে,
— মোদের মা যে- সে নয় গো খুড়া, উ এগবারে জান্ত কালি। অর কথা শুনলেই ত মোর গা-হাত ফুলে উঠে। সবাইকে ভাল রাখু, মা গো!
কিন্তু যদি ভগী খুড়া তাদের ছোটবেলার কথা বলে তখন লোখাকে থামায় কে! কথায় কথায় লোখার বাপের কথা ওঠে। সেইসময় যে কত কষ্ট করছে,সেই কথা ওঠে। যত দুঃখকষ্টের কথা শুনে,লোখার চোখে জলের মাত্রা ততবাড়ে। ঘন ঘন চোখ মুছতে মুছতে লোখা বলে,
— বাপ-মা'টা মোর কম কষ্ট পেইচে! পেটে গামছা বেঁদে মোদের পিতিপালন করেচে। বেদা ভগমান! তাদের দিকে একটু সুক ভোগ কোত্তে দিলেনি! এখন তারা যেখিনে আছে,ভগমান তাদের সুখে রাখু।
কিন্তু ভগী খুড়ার ওই গল্পগুলো লোখার মনে যেন ঠাঁই পায় না সহজে। সত্যিই তাদের কালসাবা মাঠে এমনসব কান্ড হয়! নাকি ভগী খুড়ার মনগড়া গল্প। লোখা জানে তার ভগী খুড়াকে। মন মনে সে তাকে দেবতুল্য লোক ভাবে। বাগদির ঘরে পন্ডিত। ভগী খুড়ার সঙ্গে তার বেশি মেলামেশা নিয়ে গ্রামের অনেকেই ঠাট্টাতামাসা করে। হয়তো সে মাঠ থেকে একটু দেরি করে ফিরছে,অম্নি রাস্তায় কেউ না কেউ তাকে ঠেস্ মেরে বলবেই–
— কিরে লোখোদ্দো এগবারে এককেলা করে দিলি যে রে! নাকি পন্ডিতের সঙে গেজাল মাত্তে বোসে গেইলি!
—- শালা শীতের বেলা! বুজতেই পারিনি! কুন্তু তুই পন্ডিত কাকে বোল্লু!
— তুই আবার ল্যাকা সাজাঠু! মোদের ভগী খুড়াকে ত গেরামের সবাই পোন্ডিত বলে। বেগদা পোন্ডিত!
বলেই কাল মাড়ী ছ্যাতরে কইমাছের খলখলানি আওয়াজ করে হাসে। লোখা চুপ থাকার বান্দা নয়,
—- বেগদা হউ আর মাইস্য হউ,পন্ডিত ত! কত পুরান টুরান জানে, জানু! লিখাপড়া না শিকলেও,দু'চরটা শিখ্যিত লোককে গীতা,রাময়ণের কথায় হেগরা গুয়ে বোসি দিবেনি খন!
সামনের জাতভাই লোখার সঙ্গে আর তর্ক বাড়ায় না। রাস্তা ছেড়ে দেয়। সেই লোখা যার এত গুণগ্রাহী, সেই ভগী খুড়ার ওই কথাটায় সংশয় প্রকাশ করে। লোখার মন স্থির বাঁধে না। সাধে কি তাকে বলে আটকপালা! তার মনের যত সংশয় এঁঠাল মাটির মতো ধান্ধা পাকায, তার চটচটানি ভাব ছাড়াতে দৌড়ে যায খগেন মাস্টারের কাছে।
দুপুরে খাওয়াটা তার একটু জোরদার হয়ে গেছে। কালসাবায় চাষ বলতে ত এই সময়টুকুতে। বীজতলা ফেলার তোড়জোড় চলছে মাঠে। জমির আল ছাঁটতে ছাঁটতে কখন যে সূর্য মাথার উপরে উঠে গেছে খেয়াল করেনি লোখা। মুরলা মাছে পিঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা আর কাঁচা সরষার তেল দিয়ে চুকুটে ময়না তাকে সকালাই এক জামবাটি পান্তা দিয়েছিল। চৌকি-পিঁড়ায় উবু হয়ে বসে আট দশ খামলেই জামবাটি খালি করে দেয়। আমানিটুকুও এক চোঁচানে সাবাড়ে দিয়ে কদাল কাঁধে দৌড় লাগায় মাঠে। কিন্তু দেড় কাঠা জমির ভিতা ছেঁটে, আল দিয়ে মই টানা চাট্টিখানি পরিশ্রমের কাজ নয়। জল-আমানি সহ পান্তাভাত কোথায় তলি যাবে নিমিষে! পাকস্থলী তক্ষুনি খিদায় চঁ- চঁ করবে! জষ্টির কাঠফাটা মাঠে দু'ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়লে যেমন মুহুর্তে মাটি চুষে নেয়,খিদার মুখে লোখাও গোগ্রাসে খায়। দুপুরে খেয়ে পাত থেকে উঠে নিজেই ময়নাকে বলে,
— জানু, আজগে ললি ঠিলা করে ভাত খেয়ে লিইচি। পেট পুরা সমেদমে। খিবদাটাও পেইছিল দমে। তার উবরে গোড়ই মাছের বান্নাটা পড়েছে! ভাতের দমবাচ্চা বের কোদ্দিলম! একটু গড়ান না দিলে হবেনি।
— কতবার বোলি তমাকে,পেট বুজে খাবে! খিদার মুখে অত খাবা কি ভাল! এট্টু নুন জিরা চিবিয়ে জল খাও। রান্নাশালে ঝালবান্নার ডিবায় জিরা আছে,লিয়ে লাও খন।
— মেইয়ার কথা শুন! অত বুজেশুনে খাবা যায়! তাবাদে মোর কি খাবা দেখুঠু! মোদের বাপ- জেঠাদের ভাত খাবা দেকলে তোর চোখ ঠিলা হয়ে বেরি যেত! মোর বাপ- জেঠাদের ত মাইস্য ঘরে মজুর কত্তে ভয় পেতন। তখন ছিল চালধান মাপার কঁচা। অই চাল মাপা পুয়ার চািকে বড়। তারা নাকি আঁখ গুড় মাখিয়ে দু'তিন কঁচা মুড়ি খেই লিত। তার উবরে এক দেড়ি কেজি চালের ভাতকে সুদু লঙ্কা পিঁয়াজ কামড়িয়ে সাবাড় কত্তে পাত্ত।
—অ মাগো! কথায় রাখতন অত খাবার? কুন্তু বাপ - জেঠাদের দেকলে ত বুজা যেত নিব অত। নম্বা চেওড়া ছিল। কুন্তু নাদা পেট ত ছিল নি।
— পেট ধামা হলেই কি বেশি খাবে! গেরাম ঘরে কি বলে শুনুনু, কেঁকা পেটি খায় দায়,নেদা পেটির নাম যায়।
বলেই গুলামাথির চাঁচি বগলে নিয়ে লোখা ভিটার নীচে জমির দিকে চলে যায়। ভিটার নিচে সূর্য ডুবা অব্দি রোদ ঢলঢল করে। জমির ধারটায় চাঁচি পেতে বালিশটা মাথায় দিয়ে শোয়। কিন্তু ঘুম আসে না সহজে। মাথায় ঘুরতে থাকে ভগী খুড়ার কথা। একটু খন গড়িয়েই খগেন মাস্টারের খোঁজে বের হয়।
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল গতে যায়। লোখা জানে খগেন মাস্টার এতক্ষণ স্কুল থেকে ঠিকই ফিরেছে। বিকেলের দিকটাতে লোখা চট করে কোদাল ঘাড়ে করে না। একটু কালিতলা, চেতলাবাজার কখনো মাঠে- বিলের ধারে ঘুরে। কখনো বাঁশিটা নিয়ে শিলায়ের পাড়গে গাছতলায় বসে বাজায়। সন্ধ্যা নামলে ঘরে একটু খন ছোঁয়া দিয়ে হাজির হয় আখড়ায়। চাদরটা কাঁধে নিয়ে হন হন করে হাঁটা দেয় মাস্টারের ঘরে দিকে। কিন্তু সেখানে মাস্টারের দেখা মেলে না। তাতে লোখার কোন বিরক্তি অথবা মন খারাপের বালাই নেই। ঘরে মাস্টার নেই মানে আর কোথায় থাকতে পারে লোখার কাছে তা অজানা নয়। কোন কাজে বাইরে না গেলেই হল। লোখা মনে মনে রাস্তাটা ভেঁজে নেয়। কালিতলা দিয়ে সোজা কারফার পাড়ার উপর হয়ে যাবে গঙ্গাতলার ঘাট। সেখানে না পেলে জেলাঘাট হয়ে কালসাবার মাঠে নামবে। সেইমত লোখা পা চালায়। আর মাস্টারকে কিভাবে ভগী খুড়া কথা বলবে তা ভাবতে থাকে। হঠাৎ কারফার পাড়ায় লোখার সাথে দেখা হয় পেত্যোবার। বাঁকের শিকায় মাটির কলসি ঝুলিয়ে সে মাঠ থেকে ফিরছিল ঘরে। তাকে দেখেই লোখা মাস্টারের খোঁজ নেয়।
— কি রে পেত্যোবা! খগেন মেস্টারকে মাঠে দেকলু?
— অই ত শলা বিলের ধারে, সোরষা জমির কাছটায় দাঁড়ি আছে। কেনে রে দাদো?
— নচরে তেরমন কিছু লয়। অই অনেকদিন দেখা-সেখ্যাৎ হয়নি। তাই বলি…
কথা আর বাড়াতে চায় না লোখা। শীতটা কদিন ভালোই জাঁকিয়েছে। তার উপরে মাঠে কনকনা হাওয়া। বেলা থাকতে থাকতে মাঠ থেকে চলে আসাই ভাল। খর খর হাঁটতে থাকে লোখা।
গিয়ে দেখে ততক্ষণে মাস্টার শলাবিলের ধারে উঁচু হিঁড়টার উপরে বসে আছে। আর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের সরষা জমির দিকে। লোখা কিছুটা দূর থেকেই আউড়াতে শুরু করে দেয়,
— কি গ মেস্টার! তুমি এখিনে বোসে আছ! তমাকে চাদ্দিক আসি খুঁজিঠি।
— কেনে রে? কি হয়ে গেল আবার? তুই হন্তদন্ত কোরে এলেই মোর চিন্তার শেষ থাকেনি। ভাবি, আবার একটা কিছু ঘটনা ঠিক ঘটি ফেলিচে।
— অ! তার মানে তুমি আমাকে এগবারে উদুকঅুলা ভাবো! লোখা মাল সব সময় ঝুট ঝামেলা পাকানার অস্তাদ।
— এই ত,আনাড়ির মত কথা বোলুঠু। কথাটা ত বুজ আগে। হয়তো তুই নাজ্জ কথাই বোলু কিন্তু শেষতক ঝগড়া বাঁদে। তখন মোকে টান মারু।
—আচ্ছা লাও,ইবার থিকে তমাকে কুনু টান মারবোনি। কুন্তু এখনের সমাধানটা করে দাও দিখি।
— থাইলে ঠিকই ধরেচি বল। কিছু ত একটা ঘটিচু। এখন বোস,চোলায়। বল্,কি হইচে।
— কিছুই ঘটাই নি। তবে মোর ঘটে ভগী খুড়ার একটা কথা পোরষু থিকে পাক খায়ঠে। মোর কিছুতেই বিশ্বাস হয়ঠেনি।
—-কেনে রে! খুড়া সব কথাকেই ত তুই বেদবাক্য ভাবু। ইবারে তোর কি হয়ে গেল।
— তা ভাবি,মিথ্যা বোলবোনি। ইবারেও ভাবিঠি। আবার পরক খনে মানতে পারিঠিনি। তাই ভাবলম,দেখি তমাকে বোলি কথা গুলান,সত্যি নাকি।
— খুড়া কি বোলেচে? বল,শুনি।
—-খুড়া বল্লে,মোদের কালসাবা নাকি এককালে দেবোত্তর মাঠ ছিল। ডোবরি বিলের কথা ত সবাই জানি। সেটা না হয় মানলম। কুন্তু কালসাবার মাঠে নাকি দেবতারা নামত। তাদের কি সব গনধোরব বলে। বিশেষ কোরে এই শীতকালে নাকি তারা আসত। মাঠের ঘাস পাতায জমা শিশির তারা লিয়ে যেত ইন্দ্র রাজার পা ধুয়ানার জন্নে। সোরসা ফুলের মধু নিয়ে যেত। কলমী ফুলে রঙ নিয়ে যেত। টোকাপানার ফুল নিয়ে যেত দেবতাতের ফুলের পাপড়ির বাতাস দিবার জন্নে। আর সগ্গের অপসরারা নাকি সোরষা জমিতে নেমে ঘুরত। তাদের চুল নাকি ডোবরি বিলের জলে ধুয়ে সোরসা ফুলের গন্ধ মাখিয়ে আবার চলে যেত। আচ্ছ,মেস্টার,ইসব গাঁজাখোরি গল্প নয়! তুমি বল।
— কেনে গাঁজাখোরি গল্প হোতে যাবে? তোর দাদা বৌদিকে যেদি মনসা ঠাকুর ভর করে,থাইলে কালসাবার মাঠেও দেবতারা নামতে পারে।
— তার মানে খুড়া ঠিক বোলচে!
—ঠিক -বেঠিকের কথা যেদি বোলু ত অনেক কিছুই ঠিক নয। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হোল অনবয, বুইলু!
—- এই ত! তুমিও দেখিঠি মোর মাথাটাকে গুলি দিবে এগবারে।
— আসলে কি জানু,মানুষটা অনেকের মতো মোদের এই ঢোল গেরামটাকে,কালসাবা মাটটাকে,শিলাই নদীটাকে খুব ভালবাসে। কথাগুলান যেই শুনবে,সেই মুখ টিপে হাঁসবে। মনে হবে ইনিয়েবিনিয়ে গল্প দেয়ঠে। মোদ্দা কথা যাকে ভালবাসে তাকে লিয়ে ফুলিফাঁপি বোলতে সবারই ইচ্ছা করে। আর যাই হোক কুনু ক্ষতি করার মতো ত কিছু বলেনি। তাবাদে তুও ত ময়নাকে লিয়ে পথম পথম কত ত ভাল ভাল কথা বোলতু। সেগুলান কি সবই সত্তি কথা?
— উ বউদের মন রাখতে ওরকম এট্টু বোলতে হয়। বিয়া করলে তুমি ইসব বুজতে। তবে এগদিক দিয়ে ভালই আছ। তবে কি আর ভাল! তমাকে ত ঝাড়াহাতপা মানুষ বলা যাবে নি। সাত ঝামেলায় ডুবেই থাক ত দেখি!
— ঝামেলা মনে কল্লে ঝামেলা। নিজের গেরামের জন্নে,জাতের লোকের জন্নে কিছু করাটাকে ঝামেলা ভাবিসিনি।
— লোকে ত বলে বেগদা জাত, ছোট জাত। তবু তুমি কেনে জাতটাকে এত ভালবাস? কেনে এত জাতের হয়ে গলা ফাটাও। এখন ত অনেকেই নিজের জাতের পরিচয় দিতে চাইনি। লোজ্জা পায়।
0 Comments