জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ২২/গৌতম বাড়ই

চিত্র- সম্পা সেনাপতি 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২২
গৌতম বাড়ই


নীরদ সি চৌধুরী আজ থেকে অনেক বছর আগে, গত শতাব্দীতে নিজে বাঙালি হয়ে বাঙালিদের সম্বন্ধে একদম খাঁটি একটা মূল্যায়ন করে অতি দামী একটি কথা বলে গিয়েছিলেন, যা আজও দু-খোলা চোখ মেলে নিতে পারলে তার সত্যিটুকু বোঝা যাবে । কথাটি ছিল এবং যে কথাটি  সবারই জানা - " বাঙালি এক আত্মবিস্মৃত জাতি।" এই বাক্যবন্ধে বাঙালিদের আঁতে ঘা লাগে ঠিকই , অনেকে নীরদ বাবুকে অজস্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেও , আমি বলছি, আমি ওনার সাথে একমত। সুশোভনবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন। 

বসন্তসেনা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালেন আর বললে -- " কেন বাবা? হঠাৎ তুমি বাঙালি নিয়ে ঠোকাঠুকি শুরু করলে কেন?" 

সুশোভনবাবু আর বসন্তসেনা সদ্য রাণাঘাট থেকে এক নিকট আত্মীয়ের মেয়ের বিয়েতে কাটিয়ে এলেন। সুশোভনবাবু উপলক্ষ পেলেই হাসনুমাকে নিয়ে এদিক- ওদিক বেরিয়ে পড়েন। অফিস থেকে তাকে আগাম ছুটি নিয়ে নিতে বলেছিলেন আর নিজেও স্কুলে জানিয়ে ছুটি নিয়েছিলেন, ঐ বিয়ের নেমন্তন্ন পাওয়ার পর থেকে। সুশোভনবাবুর মাসতুতো দাদার মেয়ের বিয়ে। না গেলেও খুব একটা দোষের কিছু হত না । তবে হাসনুর ভেতর একটা একাকীত্ব ভীষণভাবে কাজ করছে অঙ্কুশ চলে যাবার পর। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই তিনি বুঝতে পারছেন বা তার বর্তমান আচার আচরণে তা ফুটেও উঠছে। মেয়েটার অল্প বয়সেই একটা গভীর বিষাদ তার অন্তরে তো গেড়েই বসে আছে, মায়ের মৃত্যুর পর। যাও বা তার থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসছিল তা থেকে , আবার অঙ্কুশের চলে যাওয়া ভিন রাজ্যে তাকে কিছুটা আবার একাকীত্বর মধ্যে এনে ফেলে দিয়েছে। 

সত্যি তার বেদম আনন্দে কেটে গিয়েছে রাণাঘাটের জেঠুর বাড়িতে, দিদির বিয়েতে। বাবাও নিজেকে সেই বিয়েবাড়িতে গিয়ে অন্যান্যদের মধ্যে নিজেকে আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত রেখেছিলেন। আসলে আমাদের সবায়েরই এক চূড়ান্তভাবে কমিউনিকেশন গ্যাপে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে, নিজেরাই প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে এই দূরত্ব রচনা করে চলেছি। এই দূরত্ব আর এই একা হয়ে যাওয়া থেকে শাসকের ভীষণ সুবিধা, তাই সারা পৃথিবীতেই গণতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বৈরাচার এইভাবেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মানুষ সামান্য টাকার জন্য বিকিয়ে যাচ্ছে। শুভবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষের সূক্ষ্ম কোষগুলো হয়ত ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। বসন্তসেনা ভাবছিল একমনে তাই। তবে তার বাবা বাড়িতে আজ দু- দিন হল শুধু বিয়েবাড়ির আনন্দ স্ফূর্তি নিয়েই কথা বলেছে। জেঠুর কত কথাই বলেছে বসন্তসেনাকে। আর তার মান্তাদিদির ছোটবেলার কথা। এই মান্তাদি আর জেঠু এবং জেঠিমা তার ছোটবেলায় রাণাঘাট থেকে কলকাতা এলেই এক- দুদিন তাদের বাড়িতেই এসে উঠতেন। কলকাতায় বিভিন্ন কাজ করে ঘুরে- ফিরে যেতেন। দু- তিনবার ওদের সাথে ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা আর ডায়মন্ডহারবার সারাদিনের নামে বেড়াতে গিয়েছেন। বড় হতে হতে কেমন করে যেন এই আসা- যাওয়াতে ভাঁটা পড়ে যায়। আসলে পৃথিবী দ্রুত বদলে যায়। ইলেকট্রনিক্স দুনিয়ার অভাবনীয় সাফল্য , মানুষকে যেমন অনেক কিছু দিয়েছে , তেমন অমূল্য কিছু জিনিস আর মূল্যবোধগুলো কেড়ে নিয়েছে। 
সুশোভনবাবু বললেন, - " কেন বললাম বল তো নীরদ সি চৌধুরীর কথাটি। এখন হাল আমলের বিয়ে বাড়িগুলি দেখে আমার এত আনন্দের মাঝেও মনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ঢেউ তোলে। বাঙালির বিয়েও কেমন দ্রুত পাল্টে গেল দেখ! সংগীত, মেহেন্দি, হলদি আর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের চিরন্তন রুচি, আচার, অনুষ্ঠান ছেড়ে অন্যান্য জাতিকে অন্ধের মতন অনুকরণ করছি বল? ওরা অর্থাৎ অন্যান্য ভারতীয় জাতি কী আমাদের আচার আচরণ অনুষ্ঠান অনুকরণ করে? না, একদমই না। আমরা সত্যি এক আত্মবিস্মৃত জাতি। হিন্দী বা ইংরেজি ভালোমতন না বলতে পারলে আমরা লজ্জিত হই। একদিন হয়ত আমরা গোটাজাতি অন্যান্য ভারতীয় জাতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাব। খুঁজেই পাওয়া যাবে না। এই অন্ধ অনুকরণ টিভি সিরিয়াল আর বাংলা চলচ্চিত্র দেখে। 
আমার কিন্তু  বিয়ের এই অংশগুলো বাঙালির বিয়েতে একদম ভাল লাগছে না। কেন নিজেদের কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে দেব?"

হাসনুমা তাই বাবার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments