জ্বলদর্চি

বিষ বাষ্প /নিশান চ্যাটার্জি

রহস্য গল্প
বিষ বাষ্প

নিশান চ্যাটার্জি 

শীতের বেলায় খুব দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসে। "পশ্চিমবঙ্গের ভেষজ উদ্ভিদ" বইটির পাতায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন সব্যসাচী। সব্যসাচী চ্যাটার্জী,বাড়ী মেদিনীপুর শহরে। উনি বোটানির অধ্যাপক, উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণার কাজেও ব্যস্ত থাকেন। সদ্য হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে এসেছেন, কিছু একটা গবেষণার কাজে সেখানে গিয়েছিলেন। আজ সকালেই বাড়িতে ফিরেছেন, তাই শরীরে একটা আলস্য ভাব রয়েছে। ছাত্র সৌগত কে ফোন করে নিজের বাড়িতে আসার কথা বললেন। একটা আর্টিকেল লেখার ব্যাপারে আলোচনা করবেন মনস্থির করেছেন।  কিছু সময় পরে, বাইরে কলিং বেল এর আওয়াজ, সব্যসাচী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সন্ধ্যা ৬.৩৫ বাজে। শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন, উঠে দরজা খুলে দেখলেন সৌগত। সৌগত বসু বয়স তেইশ বছর, সুঠামদেহী, রং ফর্সা, লম্বায় প্রায় ছয় ফুট হবে। সৌগত সময়ের ব্যাপারে ভীষণ পানচুয়্যাল। সব্যসাচী বাড়িতে একাই থাকেন সঙ্গী বলতে একজন সর্বক্ষণের কাজের লোক, নাম গনেশ, বয়স যা, তাতে প্রৌঢ়ই বলা যায়। তবে কাজের বিষয়ে দারুন যত্নশীল আর গনেশের বিশেষ গুন হল ওর রান্নাটা ভারী সুন্দর। সব্যসাচী বললেন "গনেশদা দুই কাপ কফি আর একটু গরম গরম পাঁপড় ভেজে আনো আমার আর সৌগতর জন্য"। সব্যসাচীর  অর্ধসমাপ্ত বইটি হাতে নিয়ে সৌগত উল্টেপাল্টে দেখছে। আর হ্যাঁ, সব্যসাচী সম্পর্কে একটি তথ্য আপনাদের জানানোই হয়নি, সেটা হলো উনি একজন স্বনামধন্য শখের গোয়েন্দা। কাঁসাই নদী সংলগ্ন বালি কারবারিদের মধ্যে ঝামেলায় গত বছর যে খুনটি হয়েছিল তার কিনারা করে প্রকৃত দোষীকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দুজনে পাঁপড় ভাজা সহযোগে কফি খেতে খেতে রিসার্চ আর্টিকেল নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। সব্যসাচী বললেন"সৌগত আমি কালমেঘের যে পাতা গুলি সংগ্রহ করে এনেছি ওটার extract দ্রুত বানিয়ে তোমাকে একবার GC-MS টা করিয়ে আনতে হবে। তাহলে আমরা এর উপাদানগত প্রমাণ সহ একটা রিসার্চ আর্টিকেল প্রস্তত করে জার্নাল এ পাঠাবো। ওরা বেশ কিছুদিন ধরেই একটা পেপার চেয়ে পাঠাচ্ছে। সৌগত বাধ্য ছাত্রের মতো মন দিয়ে কাজ গুলো বুঝে নিচ্ছিল। ঠিক এই কথার মাঝেই সব্যসাচীর মোবাইল টি বেজে উঠল। ফোনে অপরিচিত নাম্বার ভেসে উঠেছে। True caller এ location দেখাচ্ছে West Bengal । খানিক ইতস্তত বোধ করে উনি ফোন টি রিসিভ করলেন- "হ্যালো"-ওই প্রান্ত থেকে এক পুরুষ কন্ঠস্বর- "ডঃ সব্যসাচী চ্যাটার্জী বলেছেন? এ প্রান্ত থেকে - হ্যাঁ বলছি। ঐ প্রান্ত থেকে একটু আশ্বস্ত হয়ে আপনার মোবাইল নং টি আমি ডাঃ শুভ্র জ্যোতি ভৌমিকের কাছ থেকে পেয়েছি। একটি বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করলাম। সব্যসাচী বললেন আমি যদিও একটু ব্যস্ত রয়েছি, আপনি সংক্ষেপে বলুন।ও প্রান্ত থেকে আমি দুর্গেশ রাজ চৌধুরী, ঝাড়গ্রাম থেকে বলছি, আমি আপনার তদন্তের বিষয়ে শুভ্র জ্যোতি বাবুর মুখে শুনে, আপনার সাথে যোগাযোগ করছি। আমি কি আপনার সাথে একবার দেখা করতে পারি? সব্যসাচী বললেন বিষয়টি কি বলুন তো? ও প্রান্ত থেকে- দেখা করে বলতে চাই। ফোনে বলা যাবেনা ,দেওয়ালের ও কান আছে। সব্যসাচী বললেন বেশ তো কাল আমার সকাল এগারোটায় ল্যাবরেটরি যাওয়ার আছে, তার আগে অথবা বিকেলের দিকে যেকোনো সময়ে আসুন।ও প্রান্ত থেকে ঠিক আছে আমি সকাল সকাল ই যাবো, বিকেলের হলে ফেরার সমস্যা হতে পারে।বলে ভদ্রলোক খুবই দ্রুত ফোনটা রেখে দিল।
ভদ্রলোকের গলায় যে সন্ত্রস্ত ভাব অনুভব করলেন সব্যসাচী, তা তাকে বিচলিত করল আর কানের কাছে একটা কথাই বারবার বাজতে লাগলো"দেওয়ালের ও কান আছে"। খানিক চিন্তা করে সব্যসাচী ও সৌগত আবার রিসার্চের ব্যাপারে মনোনিবেশ করল।
           বরাবর ঘুম থেকে ভোরে ওঠাই সব্যসাচীর  অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছেন সাথে এককাপ গরম গরম চা গনেশ দিয়ে গেছে। হঠাৎ মেদিনীপুর- ঝাড়গ্রাম সংক্রান্ত একটি খবরে চোখ আটকে গেল। ঠিক সেই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। সব্যসাচী দরজা খুললেন। আগত লোকটি নমষ্কার জানিয়ে বলল আমি দুর্গেশ রাজ চৌধুরী, গতকাল ফোন করেছিলাম আপনাকে। লোকটিকে দেখতে একেবারে জমিদারের মতো, হাবেভাবেও খানিক টা তাই। সব্যসাচী বললেন হ্যাঁ মনে আছে আপনার কথাই ভাবছিলাম, আসুন ভেতরে।চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে দিলেন এবং নিজে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। গনেশ কে ডেকে বললেন"দুকাপ চা আর একটা ওমলেট দিয়ে যান"। ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বললেন "শুধু চা হলেই হবে, ওমলেট খাবো না, কোলেস্টেরল হাই"। সব্যসাচী মজার ছলে হাসতে হাসতে বললেন "বঙ্গসন্তান দের বর্তমানে নেতা হওয়ার ইচ্ছা ও কোলেস্টেরল দুটোই হাই"। এরপরে হাসির রেস ধরে ই বললেন "বলুন আপনার কথা শুনি"। ভদ্রলোক একটু চারিদিকে ভয়ের চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন আমার বাড়ি ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া বলে একটা এলাকায়।বহু পুরুষের বাস, জমিদার বংশ হিসেবে আমাদের যথেষ্ট নামডাক রয়েছে এলাকায়। কিন্তু গত কয়েক মাসে আমাদের ঘরে দুটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও আমার কাছে তা একটু অন্যরকম ঠেকছে। আমার বড়দা জ্ঞানলাভ চৌধুরী মাস তিনেক আগে রহস্য জনক ভাবে মারা যান তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমার পুত্র সৌরিন্দ্র রাজ চৌধুরী ও মারা যায়। কিন্তু দুজনের মৃত্যুই হয়েছে প্রায় একই কারণে এবং রহস্য জনক ভাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী দুজনেরই মৃত্যুর কারণ sudden respiratory syndrome and cardiac arrest । যদিও পুলিশ তাদের মতো তদন্ত করছে তবুও এই মৃত্যুর তদন্তভার আমি আপনাকে নিতে একান্ত অনুরোধ করছি। সব্যসাচী বললেন ওনাদের মৃত্যু ঠিক কোন সময়ে হয়েছিল বলে আপনার অনুমান? দূর্গেশ বাবুর উত্তর- দুই জনেই ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। সকালে বাড়ির কাজের লোক বাড়ির অন্যান্যদের খবর দেয়। সব্যসাচী চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন আপনার বাড়ির ঠিকানাটা আমার নোটবুকে লিখে দিন, আগামীকাল বিকেল নাগাদ আপনার বাড়ি আমি যাচ্ছি সাথে আমার এক ছাত্র যাবে, আপনাদের কোনো অসুবিধা নেই তো?  ভদ্রলোক দৃঢ় ভাবে সম্মতি জানালেন এবং নমষ্কার জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সৌগত কে একটি কল করে সব্যসাচী বললেন কাল বিকেলে চারটের সময়, আমার বাড়িতে চলে আসিস, ঝাড়গ্রাম যেতে হবে। সঙ্গে দুই তিন দিন থাকার মতো জামা প্যান্ট রাখিস। এরপর সব্যসাচী জঙ্গলমহলের ডায়েরি বলে একটা বইতে মনোনিবেশ করলেন এবং গনেশ কে আরো  এককাপ চা ও সামনের মোড়ের দোকান থেকে গরম গরম বেগুনী আনার কথা বললেন। দুপুর বেলা খাওয়ার পরে সব্যসাচী কাগজে চোখ বুলিয়ে সকালের বাকি থাকা খবর টা চোখ বোলাতে শুরু করলেন। ঝাড়গ্রামে  বর্তমানে একটি ভেষজ উদ্যান তৈরি হয়েছে এবং সেখানে একটি ন্যাশনল সেমিনার মাস তিনেক আগে হয়েছিল, বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যান্টনি গোমস সেখানে ক্যাথারানথাস রোসিয়াস নিয়ে তাঁর কাজের কথা বলেছিলেন, তার খবরটি এতো দিন পর বেরিয়েছে। ক্যারানথাস হল নয়নতারা নামের একটা গাছ। আমাদের দেশে খুব সহজেই চোখে পড়ে এই ফুলের গাছ। এর বিশেষ উপাদান ভিনক্রিস্টিন এবং ভিনব্লাস্টিন বিশেষ ভেষজ গুণ সম্পন্ন। যাইহোক বিকেলে চারটের সময় সৌগত ও সব্যসাচী, গাড়ি তে ঝাড়গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। অরন্য সুন্দরী হিসেবে ঝাড়গ্রামের সুখ্যাতি রয়েছে। পথে যেতে যেতে শাল জঙ্গল অতিক্রম, বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে এক অনন্য অনুভুতি। ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ওরা দুর্গেশ রাজের বাড়িতে পৌঁছলেন। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ। পুরোনো আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। তবে পুরোনো বাড়িটার চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা। বড় বড় গাছের সাথে বহু রকমের ফুলের গাছ ও চোখে পড়ার মতো। কথাবার্তায় জানা গেল এ বিষয়ে বাড়ির বড়ো ছেলের যথেষ্ট সৌখিনতা রয়েছে, পাখির ডাক সবমিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। কে বলবে এই পরিবেশে থেকে তদন্তের মতো জটিল বিষয়ে মাথা ঘামানো যায়। যাইহোক দুর্গেশ বাবু জানালেন গেষ্টরুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সন্ধ্যা বেলায় আমরা সকলেই একত্রিত হবো তাও জানালেন।গেষ্ট রুমে ব্যাগপত্র রেখে সৌগত বলল আচ্ছা এতো বড় বাড়িতে লোকজন তো তেমন দেখছি না? সব্যসাচী বললেন সন্ধ্যায় বোঝা যাবে নিশ্চই। তবে একেবারে লোক নেই সে কথা বলা যাবেনা। সৌগত বলল কিভাবে জানলে?বাড়ীতে ঢুকে বারান্দা সংলগ্ন রান্না ঘরের দিকে চোখ যেতেই হাঁড়ি ও কড়ার আয়তন দেখে। তাছাড়া বাড়িতে ঢোকার মুখে প্রায় অনেকগুলো জুতো জোড়া দেখতে পেলাম। সন্ধ্যায় সব্যসাচী কে বাড়ীর সকলের সাথে আলাপ করাতে লাগলেন দুর্গেশ বাবু। দোতলার কোনের ঘরটা ওনার বড় ছেলে রামজীবনের। ঘরটা বেশ গোছানো, দেখেশুনে মানুষটি কে সৌখিন বলেই মনে হয়। বাড়ীর পৈত্রিক ব্যবসা দেখাশোনা করাই এখন তার প্রধান কাজ। ব্যবসা পৈত্রিক হলেও তা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে জ্ঞানদা রঞ্জনের হাত ধরে তাই সম্পত্তির বেশীরভাগ অংশ ই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্যবহার বেশ মিষ্টি।পরের রুমটা বেশ অগোছালো বইপত্রে ঠাসা।এটি মেজ ছেলে অরুনের রুম। ঐ বইপত্র লেখালেখি করে,বিশেষত প্রবন্ধ। তবে বিশেষ মিশুকে স্বভাবের। সব্যসাচী কে দেখে নমষ্কার জানিয়ে বসতে বলল এবং তার ভাই ও জ্যেঠুর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ ঐ করলো। তার ঠিক পাশের রুমটা বন্ধ,এটি ই সৌরিন্দ্র বাবুর রুম।খুলে দেখা গেল রুমটা বেশ আভিজাত্যের ছাপ বহন করছে। উইন্ডো এসি মেশিন, তার লাগোয়া পালঙ্ক। পালঙ্কের চাদর বেশ দামী। তার ব্যবহৃত হাতঘড়ি ও অন্যান্য সামগ্রী ও বেশ দামী। দুর্গেশ বাবু বললেন সারাদিন অফিসে কাজ করে এসে ও একদম গরম সহ্য করতে পারতো না তাই গতবছর এই এসি টি লাগানো হয়েছিল। আমার এবং আমার বাকি দুই পুত্রের ঠান্ডার ধাত তাই এসি আমরা ব্যবহার করিনা। এছাড়াও বাড়িতে রয়েছে দুই সর্বক্ষণের কাজের লোক দীনদয়াল ও ভানু। এবং এক মালি নেপাল সিং। নীচের তলায় জ্ঞানলাভ রঞ্জনের রুম। অনেক আধ্যাত্মিক বইপত্র রয়েছে। একটি পড়ার টেবিল ও চেয়ার ঘরের জানালার কাছে রাখা। তেমন বিশেষ কিছু চোখে পড়ার মতো নেই। সব্যসাচী জানালার কাছে গিয়ে বাইরেটা চোখ বুলিয়ে দেখলেন গাছপালায় ঘেরা চারিদিক। দুর্গেশ বাবুর স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে পরলোকগত হয়েছেন। রাত্রি বেলা সকলে একসাথে খেতে বসে বেশ কথাবার্তা হলো। খাওয়ার মেনুতে ছিল পরোটা ও বনমোরগের গরম গরম কষা সাথে মিষ্টি। সৌগত গোগ্রাসে গোটা আটেক পরটা, মাংস দিয়ে ভালোই উদরতৃপ্তি করলো। পরের দিন সকালে সব্যসাচী ঘরের চারপাশে ঘুরে দেখলেন। বিকেলের দিকে দুর্গেশ বাবু কে জিজ্ঞেস করলেন- এখানে শুনেছি একটা ভেষজ উদ্যান আছে,আমলাচটিতে একটু যেতে চাই। আপনাদের মালি তো লোকাল ওকে সঙ্গে রাখতে চাই। কোনো অসুবিধধায় পড়লে ওনার সাহায্য পাওয়া যাবে। বলা মাত্রই ব্যবস্থা হয়ে গেল। সব্যসাচী ও সৌগত। আমলাচটির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভেষজ উদ্যানে পৌঁছে সব্যসাচী নানান উদ্ভিদ গুলিকে পর্যবেক্ষণ করছেন সাথে নোটবুকে লিখে রাখছেন। সৌগত প্রশ্ন করল- আপনার কি মনে হয় এটা খুন? সব্যসাচী সংক্ষেপে উওর দিলেন- সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ  নেই। তবে প্রশ্ন হলো খুনী কে? আর খুনের মোটিভটা কি? সৌগত আবার প্রশ্ন করলো- খুন বলে। এতো জোর দিয়ে কিভাবে বলছো? সব্যসাচীর সংক্ষিপ্ত উত্তর - ক্রমশ প্রকাশ্য। রাত্রে দুর্গেশ বাবুকে সব্যসাচী প্রশ্ন করলেন আপনাদের এই ব্যবসা ও সম্পত্তির উইল টা একবার দেখতে পারি? সেই সঙ্গে আপনার পুত্র ও কাজের লোকেদের অনুপস্থিতিতে ওদের ঘরগুলো আরেকবার দেখার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দুর্গেশ বাবু বললেন- বেশ তো কাল সকালে ওরা সকলে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়লে,আপনি ঘুরে দেখুন। পরের দিন বিকালে হঠাৎ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে সব্যসাচী গেষ্ট হাউসের বাইরে বেরিয়ে এসে দুর্গেশ বাবু কে জানালেন- আমরা ফিরতে চাই। আগামী কাল থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসি রণদেব বাবুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি। ততক্ষন বাড়ির কেউ যেন কোথাও না যায়। গতকাল আমলাচটি যাওয়ার সময়ে আমি রণদেব বাবুর সাথে কথা বলে রেখেছি, ওদের সেপাই কাল পর্যন্ত আপনাদের বাড়িতে পাহারায় থাকবে। দুর্গেশ বাবুকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই , সব্যসাচী ও সৌগত দুজনেই বেরিয়ে গেল। ভোরের আলো ঝাড়গ্রামের জমিদার বাড়িকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে। শিশির ভেজা ঘাস যেন সব রহস্যের সমাধান করে প্রকাশ্যে হেসে চলেছে। পুলিশের জিপ বাড়ির সামনে এসে থামল। মূহুর্তের মধ্যে যে নৈস্বর্গিক দৃশ্য তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। গাড়ি থেকে ওসি সমরেশ রায়  নামলেন সাথে সব্যসাচী, সৌগত আর একজন যাকে দেখে দুর্গেশ বাবু চমকে উঠলেন। চেঁচিয়ে বললেন- নেপাল সিং! সব্যসাচী বললেন চলুন ড্রয়িং রুমে বসে সব বলছি। তার আগে বাড়ির সকলকে ড্রয়িং রুমে আসতে বলুন। একে একে সকলে এসে উপস্থিত হলো। সব্যসাচী কোনো ভনিতা ছাড়াই শুরু করলেন- "খুনি যতোই চালাক হোক না কেন, তার সবথেকে বড় ভুল নিজের বোকামি সম্পর্কে সে সচেতন থাকেনা"।দূর্গেশ বাবু বললেন "তাহলে কি নেপাল সিং"? সব্যসাচী থামিয়ে দিয়ে বললেন "দাঁড়ান বিষয়টা অতটা সোজা সাপটা নয়। কাল রাতে নেপাল সিং বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করেছিল, পাহারায় থাকা সেপাইরা ধরে ফেলে আর হ্যাঁ, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন সমরেশ বাবু। আমি গতকাল সামনের গেস্ট হাউস টি ভাড়া নিয়ে ওখানেই ছিলাম। এরকম একটা কিছু ঘটতে চলেছে তা আগে থেকেই আঁচ করে এই ব্যবস্থা করেছিলাম। আর ইচ্ছে করেই আমার ফিরে যাওয়ার কথাটা বলেছিলাম যাতে আসল অপরাধী ফাঁদে পা দেয়"। যেদিন নেপাল সিং কে সঙ্গে করে আমলাচটি বেড়াতে গেলাম তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে ছিল। সেদিন যখন উদ্যানে ভেষজ উদ্ভিদের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করছি, তখন ইচ্ছে করেই আমি অলেন্ডার ফুলের কথা বললাম, ঐ আন্দাজে ঢিল মারা বলতে পারেন। নেপাল সিং এর মতো একজন অশিক্ষিত মানুষ, আমার কথা শুনে যখন অতি উৎসাহী হয়ে বলল এই ফুল টি নাকি সে দেখেছে তখন আমার সন্দেহ হলো! এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি উদ্ভিদ। এর ফুল মারাত্মক বিষাক্ত। ফুলদানিতে এই ফুল যদি জল দিয়ে রাখা হয় তাহলে সেই জল ও বিষাক্ত হয়ে পড়ে। দুর্গেশ বাবু আপনার দাদা আর ছোট পুত্রের ওপর এই অস্ত্রই প্রয়োগ করা হয়েছিল। আমি যেদিন জ্ঞানদা রঞ্জন বাবুর রুমের বাইরেটা জানালা দিয়ে দেখছিলাম, সেদিন এই ফুলের কিছু পোড়া অংশ আমার চোখে পড়েছিল। তাই নেপাল সিং এর মুখে এই ফুলের কথা শোনার পর দুয়ে দুয়ে  চার করতে অসুবিধা হলো না। মৃত্যুর দিন রাতে জ্ঞানদা রঞ্জন বাবু যখন জানালার ধারের টেবিলে বসে প্রতিদিনের মতোই পড়ছেন তখন তার জানালার পাশ থেকে বিষাক্ত এই ফুলকে পুড়িয়ে তার ধোঁয়া জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর পাঠানো হয়েছিল। আততায়ী সম্ভবত scientific মাক্স পরেছিল।জ্ঞানদা রঞ্জন বাবু সেই গন্ধেই প্রথমে শ্বাসকষ্ট ও পরে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যান।  সৌরেন্দ্র যদিও ঘরে এসি চালিয়ে শুতেন কিন্তু হালকা শীতে জানালা খোলা রেখে ঘুমচ্ছিলেন তাই তার ক্ষেত্রেও আততায়ী একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোনো ভুল ছিলনা। সেদিন সবার অনুপস্থিতিতে যখন জ্ঞানদা রঞ্জন বাবুর রুমের ভেতরে গেলাম ওনার পড়ার টেবিলে ড্রয়ারে একটি উইল পাই। এটি যে তিনি তার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সৌরিন্দ্র বাবুর নামে করে রেখেছিলেন। দুর্গেশ বাবুর কাছে যে উইলটি দেখেছিলাম, এই উইলটি তার পরে সম্ভবত উনি তৈরি করেছিলেন কারন উইলের তারিখ থেকে তা স্পষ্ট। তাই আততায়ী ভেবেছিল জ্ঞানদা রঞ্জন বাবু কে হত্যা করলেই পুরোনো উইল অনুযায়ী সম্পত্তি হাতানো সহজ হবে। কিন্তু কোনো ভাবে আততায়ী যখন নতুন উইলের কথা জানতে পারে তখন সৌরিন্দ্র বাবুকে ও হত্যা করে। বলতে বলতে সব্যসাচী সজোরে রামজীবন চৌধুরীর কলার ধরে টেনে তুললেন। বললেন রামজীবন বাবু শেষ রক্ষা হলো না। রামজীবন প্রতিবাদ করে জানাল- আমি যে এসব করেছি তার প্রমাণ কি? সব্যসাচী স্মিত হেসে বললেন প্রমাণ হল নেপাল সিং যাকে আপনি কাল রাত্রে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, মুখ বন্ধ রেখে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।আর আপনার কথা মতো পালাতে গিয়েই কাল রাতে সে ধরা পড়ে। নেপাল সিং আমাদের কাছে স্বীকার করেছে আপনার বন্ধু বিজ্ঞানী অ্যান্টনি গোমসের থেকে আপনি এই বিষাক্ত ফুলের তথ্য পান এবং যখন উনি ঝাড়গ্রামে সেমিনারে আসেন তখন নেপাল সিং কে দিয়েই ঐ ফুল আপনি নিজের কাছে আনান। গোমস কিন্তু এই ফুলের খারাপ গুন সম্পর্কে নেপাল সিং কে জানান এবং সাবধান করে দেন। এই সেমিনারের নিউজ, কাগজে কয়েকদিন আগেই পড়েছিলাম। গোমস পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, যে আপনাকে ঐ ফুলের স্যাম্পল দিয়েছিলেন। সব্যসাচী আরো বললেন - রামজীবন বাবু জানতেন মেজ ভাই শিল্পী মানুষ বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই এবং সে এইসব সামলাতেও পারবে না, তাই জ্ঞানদা রঞ্জন বাবুর উইলে তার নাম নেই আর সৌরেন্দ্র এর অনুপস্থিতিতে রামজীবন বাবুই হবেন এই বিশাল সম্পত্তির মালিক। দুর্গেশ বাবু কে সব্যসাচী বললেন আপনার পিতা, জ্ঞানদা রঞ্জন বাবুর নামে সব সম্পত্তি উইল করে রেখেছিলেন যেটা আপনার কাছে এখনো রয়েছে কিন্তু জ্ঞানদা রঞ্জন বাবু সম্ভবত রামজীবন বাবুর অভিসন্ধি আঁচ করতে পেরেছিলেন তাই তিনি নতুন উইল বানান।
            সকলে নিশ্চুপ হয়ে রইলো, দিনের আলোয় যেন রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। পুলিশ রামজীবন বাবু ও নেপাল সিং কে অ্যারেস্ট করল। সব্যসাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুর্গেশ বাবু কে বললেন " রহস্য অন্ধকারে থাকলে তা মনের ওপর যতটা না প্রভাব ফেলে তার থেকে অনেক বেশি কঠিন হয় রহস্যের আড়ালে থাকা আলো কে গ্রহণ করা। আপনি ভেঙে পড়বেন না। অরুণ তো রইলো,ও আপনাদের যোগ্য উত্তরসূরী"।।

Post a Comment

0 Comments