জ্বলদর্চি

দাঁসায় পরব/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ১০৫

দাঁসায় পরব

ভাস্করব্রত পতি

'হায়! হায়! হাট বাজাররে গুরু হো 
ডাঙ্গুয়া কুড়ি গুরু হো ডাঙ্গুয়া কুড়ি 
হায়! হায়! লিলাম বাজাররে গুরু হো 
ছাড়য়ী কুড়ি গুরু হো ছাড়য়ী কুড়ি 
হায়! হায়! ছাড়য়ী কুড়ি দ গুরু হো 
লুমাম লুগড়ি গুরু হো লুমাম লুগড়ি 
হায়! হায়! ডাঙ্গুয়া কুড়ি দ গুরু হো 
লুমাম শাড়ী হো গুরু হো লুমাম শাড়ী হো'।
এ গান দাঁসায় পরবের। এ গান পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনের। এ গান দুঃখের। এ গান কষ্টের। তবুও মুখে হাসি রেখে সহজ সরল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন মেতে ওঠেন দাঁসায়তে। 

কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমীতে যদুবংশীয় বীরপুরুষ হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করেন উচ্চবর্ণের নারী দুর্গা দেবী। প্রতারণা করেই হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। এই দেবী ছিলেন ‘দেবাংশী’ নারী। আসলে সে সময় লাল মাটির এলাকার সাঁওতালরা পরিচিত ছিলেন 'যদুবংশী' হিসেবে। এঁদের মহাবিক্রম নেতা ছিলেন বীর হুদুড়দুর্গা। আর উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা পরিচিত ছিল ‘দেবাংশী’ নামে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল আদিবাসী তথা যদুবংশীয়দের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা। এসব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছিল হুদুড়দুর্গা। সেই হুদুড়দুর্গার সঙ্গে এঁটে ওঠার সাধ্যি ছিলনা দেবাংশীদের। তখন ছলেবলে কৌশলে হুদুড়দুর্গাকে হারানোর ফন্দিফিকির করতে শুরু করে। দেবতারা যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতা একত্রিত করে এক নতুন নারী শক্তির সৃষ্টি করে। হুদুড়দুর্গার বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে দেবতাদের সম্মিলিত সৃষ্ট নারী দেবীই দুর্গাদেবী। তিনিই  মোহিনী রূপ ধারণ করে হুদুড়দুর্গার নিজস্ব পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেন তাঁকে। সেইসাথে ঐ দেবাংশীরা নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে যদুবংশীয়দের। অর্থাৎ আদিবাসীদের। এই ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রনাময় ঘটনার স্মরণে আদিবাসীরা পালন করেন 'দাঁসায় পরব'। দুর্গাপূজার চারদিন ধরে পালিত হয় দুঃখের উৎসব 'দাঁসায়'। 
দাঁসায় নাচের তালে তালে

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে 'আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বণ'তে লিখেছেন -- "দেবাসুর সংগ্রামের সময় আর্যদের দলনেতা ছিলেন ইন্দ্র এবং অসুর অর্থাৎ খেরওয়াল গোষ্ঠীর দলনেতা ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হুদুড়দুর্গা। খেরওয়ালদের সঙ্গে আর্যদের প্রায় যুদ্ধ হত, কিন্তু খেরওয়ালদের পরাজিত করা যাচ্ছিল না। আর্যদের সমস্ত চেষ্টা খেরওয়াল দলনেতা হুদুড়দুর্গা ব্যর্থ করে দিচ্ছিলেন। তখন আর্য দলনেতা ইন্দ্র এক কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি আর্য নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী এক যুবতিকে কৌশলে খেরওয়াল দলনেতা হুদুড়দুর্গার কাছে উপহার হিসাবে প্রেরণ করলেন। হুদুড়দুর্গা সুন্দরী যুবতির মোহিনী রূপে ভুলে গিয়ে নিজের এবং খেরওয়াল জাতির সর্বনাশ ডেকে আনলেন। আর্য সুন্দরীর হাতে হুদুড়দুর্গাকে মৃত্যুবরণ করতে হল। পরবর্তীকালে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা সেই মনোহারিণী নারীকে সম্মানের শীর্ষচূড়ায় দেবীরূপে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করা হল এবং অসুর দলনেতা হুদুড়দুর্গাকে বধ করায় তার নাম রাখা হয় দুর্গা"। 

সাঁওতালদের বিশ্বাস, কোনও ভাবেই হুদুড়কে যুদ্ধে হারাতে না পেরে, দেবাংশীরা দৈবশক্তি একত্রিত করে এক নারী যোদ্ধাকে সৃষ্টি করেন। তিনিই দেবী দুর্গা। সেই আর্যনারী মোহিনী রূপ ধরে হুদুড়ের রাজসভায় ঢুকে তাঁকে কৌশলে হত্যা করেন। হুদুড়ের মৃত্যুর পরে যদুবংশী পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেন দেবাংশীরা। যদুবংশীদের উৎখাত করে এলাকা দখল করে নেন তাঁরা। সেই থেকে দুর্গাপুজোর চারদিন রাজা হুদুড়ের মৃত্যুতে শোকপালন করেন সাঁওতালেরা। শোকাবহ সেই ‘দাঁসায়’ পরবের শেষে দশমীর দিন গ্রামে গ্রামে শোকসভার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় পরব। 

দুর্গাপূজার সময় যখন সারা বাংলা মেতে থাকে দেবীর আগমনকে কেন্দ্র করে, তখন পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার গ্রাম জুড়ে সাঁওতালদের মধ্যে দুঃখের উৎসব পালিত হয়। নানা সুরের গান আর কাঠি নাচের সাথে দাঁসায় নাচের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও নাচ গান আর খাওয়া দাওয়াতে দাঁসায় পরব অষ্ট্রিক জনগোষ্ঠীর কাছে আনন্দের হয়ে ওঠে। 

আসলে এই দাঁসায় পরব সাঁওতালদের কাছে যেন শারদোৎসব। কাশফুলে ঘেরা শরতের বুক চিরে যখন ঢাকের শব্দ উছলে ওঠে, তখন সাঁওতাল গ্রামে শোনা যায় ভুয়াংয়ের মোলায়েম সুর। দাঁসায় পরবের নাচের বিভঙ্গে এবং গানের সুরে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে জঙ্গলের আদি মানুষগুলোর মনপ্রাণ। শালপাতাগুলো শিহরিত হয়  সুরের মূর্ছনায়। লালমাটির বুক চিরে উড়তে থাকা ধুলো গুলো যেন হা হুতাশ করে ডাকতে থাকে তাঁদের বীর যোদ্ধাদের। 

ছেলেরা মাথায় পাগড়ি বেঁধে নেয়। তাতে গুঁজে দেয় ময়ূরের পালক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা দাঁসায় নাচ করে। হাতে থাকে 'ভুয়াং'। এটি এক বিশেষ ধরনের বাজনা। এক খণ্ড বাঁশের দু'দিকে ৬ - ৭ ইঞ্চি মাপের দুটি দন্ড লাগিয়ে দেওয়া থাকে। এবার ঐ দণ্ড দুটিতে ধনুকের ছিলার মতো দড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়। আর বাঁশটির মাঝখানে লম্বা লাউয়ের শুকনো খোলা বেঁধে দেওয়া হয়। তৈরি হয়ে যায় 'ভুয়াং'। গানের সময় ঐ ছিলাটিতে একটু টান দিয়ে ছাড়লেই অদ্ভুত 'ভুং ভুং' আওয়াজ চলকে ওঠে। শুধু ভুয়াং নয়, তাঁদের হাতে তখন কঁকিয়ে ওঠে বাঁশি, কাঁসর এবং ঘণ্টা। ইদানীং বড় পিচ রাস্তা, বাজার হাট কিংবা গঞ্জ এলাকায় সাঁওতালদের দেখা যায় দলবদ্ধ ভাবে দাঁসায় নাচ করতে। 

দাঁসায় নাচ ও গানে কেবলমাত্র ছেলেরাই অংশগ্রহণ করতে পারে। মেয়েদের স্থান নেই এই পরবে অংশ নেওয়ার। তবে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করা যায়। অনেক ছেলেদের দাঁসায় নাচের সময় মেয়েদের চিত্র বিচিত্র রঙিন শাড়ি পরতে দেখা যায়। কেউ কেউ মেয়েদের কিছু গয়নাও পরে। আসলে নাচের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন আটপৌরে জীবনের দুঃখ কষ্ট, আবেগ, ভালোবাসা অন্যদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে। একজন বয়স্ক ব্যক্তি তথা 'ভুয়াং গুরু' এই দলটিকে পরিচালনা করেন। শিক্ষক সুজিত সোরেন জানান, ইনিই প্রথমে পূজো করে ভুয়াং নাচের দলকে নাচ গান করতে যেতে অনুমতি দেন। তাঁদের বিশ্বাস যাতে পথিমধ্যে কোনও অসুবিধা বা বিপদের সম্মুখীন না হয় তাঁরা। তিনি সনুম, সিঁদুর এবং সাকম দিয়ে পূজা করেন। আর মাঝে মাঝে নাচ গানের ফাঁকে ফাঁকে তারস্বরে 'দেহেল দেহেল' বলে চিৎকার করে ওঠে দাঁসায় নাচিয়েরা। 

অনেকে এটিকে কৃষিভিত্তিক ও প্রকৃতি বন্দনার উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। এই উৎসবের পেছনে যে কাহিনীর কথা শোনা যায় তা অনেকের মতে কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। আসলে সাঁওতালরা প্রকৃতিকে ভালোবাসে। তাঁদের প্রতিটি উৎসবেই প্রকৃতির শক্তিকে আরাধনা করা হয়। এখানেও সেরকমই পরিলক্ষিত হয়। গবেষকদের মতে অনাবৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে জলের প্রার্থনায় প্রকৃতির পূজা ও সম্মান প্রদর্শন করার আহ্বানের মাধ্যমেই দাঁসায় পরব পালিত হয়। তবে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে উল্লেখ করেছেন -- "সাধারণ জ্যৈষ্ঠ মাসের রোহিণীর দিন থেকে সাঁওতাল ছেলেরা মন্ত্রতন্ত্র ও ভেষজবিদ্যা গুরুর আখড়ায় গিয়ে শেখে। যে ব্যক্তি ভালো মন্ত্রতন্ত্র জানে ও ভেষজবিদ্যায় পারদর্শী তাকেই গুরু বলা হয়। সাঁওতাল সমাজে এরকম বহু গুরু যেমন কামরু গুরু, লড়সিং গুরু, ধরম গুরু, সিদ গুরু, রহড়া গুরু, চেমেঞ গুরু, উড়ান গুরু প্রভৃতির নাম শোনা যায়। এঁরা প্রত্যেকেই খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন। বন জঙ্গলের গাছ গাছড়া ও লতাপাতার গুণাগুণ সম্পর্কে এঁদের অসাধারণ জ্ঞান ছিল। এঁদের চিকিৎসা পদ্ধতিই সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত সাঁওতাল ছেলেরা গুরুদের আখড়ায় ভেষজবিদ্যা শিক্ষালাভ করে। গুরুরা গাছ গাছড়া ও লতাপাতার নাম শিষ্যদের শিখিয়ে দেন এবং কী পরিমাণে ব্যবহার করতে হয় তা বলে দেন। দুর্গাপূজার সময় সপ্তমীর দিন থেকে শিষ্যরা গুরুপত্নীর আশীর্বাদ নিয়ে গুরুর নাম প্রচারে বের হয় এবং বিজয়া দশমী পর্যন্ত তারা দাঁসায় গানের মধ্য দিয়ে প্রাচীন গুরুদের নামকীর্তন করে"।

Post a Comment

0 Comments