জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—আফ্রিকা /নেকড়ে মানুষ /চিন্ময় দাশ


 চিত্র- শুভম দাস 
দূরদেশের লোকগল্প—আফ্রিকা
নেকড়ে মানুষ
চিন্ময় দাশ

একদিন এক অপরিচিত বিদেশী পথিকের উদয় হোল একটা গ্রামে। লোকটি দেখতে ভারি সুন্দর। কিন্তু অবাক ব্যাপার হোল, মুখে কোনও কথা নাই মানুষটার!
নাই বা রইল মুখে কথা। দেখতে কিন্তু সত্যিই সুন্দর সে। গ্রামের সব মেয়েরই তাকে ভালো লেগে গেছে। সবাই চাইছে, তাদেরই কোন একজনকে বিয়ে করুক লোকটি। কিন্তু একটি কথাও শোনা গেল না লোকটির মুখে। সেদিন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল যখন, গ্রাম থেকে বেরিয়ে বনের দিকে চলে গেল সে। চিহ্নটুকুও দেখা গেল না আর।
এবার যা হয় আর কী। ধীরে ধীরে সে আগন্তুকের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে লোকেরা। এভাবে যখন মাসখানিক কেটে গেছে, আবার একদিন দেখা গেল তাকে। উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের পথে পথে। বিশেষ করে, মেয়ের দল ভারি পছন্দ করে ফেলেছে লোকটিকে।
একটি মেয়ে তো পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। এতটা বেশি পছন্দ হয়েছে তার, আগন্তুকের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, ভাবতেই পারছে না সে।
লোকটি সেদিন আবার ফিরে যাচ্ছে। সেদিনও সে বনে ঢুকেছে। পিছনে কারও পায়ের শব্দ! পিছন ফিরে দেখল, গ্রামের একটি মেয়ে আসছে তার পিছন পিছন।
বুঝতে কিছু বাকি রইল না তার। সে বলল—নাগো, মেয়ে! আমার পিছন পিছন এসো না। বাড়ি ফিরে যাও তুমি।
মেয়েটি জবাব দিল—কোনও দিন তোমাকে ছাড়ব না আমি। তুমি যেখানেই যাবে, আমি যাবো তোমার সাথে।
--অনুরোধ করছি তোমাকে। এমনটা কোর না। লোকটি বলল—আমাকে তো তুমি চেনো না। পরে পস্তাতে হবে তোমাকে।
আরও পড়ুন 👇

লোকটার গলায় যেন বিষাদের সুর। কথা শেষ না করেই, দ্রুত পায়ে বনের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে মানুষটি।
কিছু দূর গিয়ে, আবার পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মেয়েটি তখনও আসছে পিছন পিছন। আবার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালো লোকটি—আবারও বলছি ফিরে যাও। নইলে পস্তাতে হবে। তখন আর কোন সুরাহা করতে পারবে না কোনদিনই।
কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। সে চলতেই লাগল পিছনে পিছনে।
এভাবে কত দূর চলে এলো দুজনে। একেবারে গভীর বনের ভিতরে এসে পৌঁছেছে এবার। সেখানে একটা বুড়ো  গাছ। তার তলায় পড়ে আছে একটা নেকড়ের চামড়া।
গাছের তলায় পৌঁছে, লোকটি হঠাৎই গান গাইতে লাগল। ভারি বিষাদ সেই গানে। বিষাদ লোকটির গলাতেও।
গানে সে বলছে—মাসে মাত্র একটি দিনই মানুষের জীবন পাই আমি। সেদিনটিই কেবল গাঁয়ে গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে পারি, নিজের মতো করে। আসলে কিন্তু আমি একটা জংলী নেকড়েই।  গাছের তলায় পড়ে আছে আমার চামড়াটা। নিজের চেহারায় ফিরে যাবো এবার। তখন কিন্তু এই আমিই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো তোমাকে।
🍂
ভয়াণক ঘাবড়ে গিয়েছ মেয়েটি। বিশ্বাস করবে কি না, বুঝে উঠতে পারছে না। এমনটা কি হতে পারে? ভাবনার রেশ কাটতে সময় পেল না।
হঠাৎই লাফিয়ে উঠল লোকটি। পড়ল গিয়ে গাছের তলায় পড়ে থাকা চামড়াটার ওপর। কী অবাক করা কাণ্ড! কোথায় সেই সুন্দর এক পুরুষ! হৃষ্ট-পুষ্ট এক নেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যেন আকাশ ফুঁড়ে নেমে এসেছে ভয়াণক জীবটা!
ভয়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটি। প্রাণপনে দৌড় শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু নেকড়েও তাড়া করে আসছে পিছনে।
আতঙ্কিত মেয়েটি এতো জরে দৌড়চ্ছে, নেকড়ে তার নাগাল পাচ্ছে না। মরিয়া হয়ে দৌড়চ্ছে নেকড়েও। দৌড়চ্ছে আর গান গাইছে—ধরি একবার, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো তোকে।
মেয়েটিও গানেই উত্তর দিচ্ছে—আমাকে ধরার হিম্মত নাই তোর। গোটা দুনিয়া দৌড়তে পারব আমি। নাগালই পাবি না তুই আমার।
মেয়েটি দৌড়চ্ছে। নেকড়ে ও দৌড়চ্ছে পিছন পিছন। দৌড়চ্ছে, তবে মেয়েটার নাগাল পাচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎই আর এক বিপদ। রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল একটা নদীর কাছে এসে। তেমন চওড়া নয় নদী। কিন্তু যেমন গভীর, তেমনি তাতে খর স্রোত। পার হবার কোন উপায় নাই।
কান্না পেয়ে গেল মেয়েটির। এদিকে নেকড়েটা এসে পড়ল বলে। এবার ঘাড়ে এসে পড়বে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
তখনই, ঠিক তখনই, এক অবাক করা কাণ্ড! সেখানে নদীর পাড়ে ছিল লম্বা চওড়া একটা গাছ। গাছটা আচমকা আছড়ে পড়ল নদীর এপার ওপার বরাবর। তাতে একটা সাঁকো গড়ে উঠল নদীর ওপার পর্যন্ত। গাছটা বলে উঠল—কী দেখছো দাঁড়িয়ে? পালাও, এখনই। নেকড়েটা এসে পড়ল বলে।
সম্বিৎ ফিরে এলো মেয়েটির। চটপট গাছে চড়ে, ওপারে হাজির হয়ে গেল। তারপর আবার দৌড়। এবার দৌড়চ্ছে তার নিজের গ্রামের দিকে। অচেনা অজানা কারও জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে না আর।
নেকড়েটা এসে পড়েছে। গাছও দেখতে পাচ্ছে তাকে। নেকড়ে টাও নদী পার হয়ে যাবে এবার। আবার তাড়া করবে মেয়েটিকে। ধরেও ফেলবে হয়তো। তবুও খাড়া হয়ে গেল না গাছটা।
প্রায় তখনই এসে গেল শয়তান নেকড়েটা। এখন এই গাছের সাঁকো পার হওয়া তার কাছে কোন কঠিন কাজ নয়। মূহুর্ত দেরী না করে, ঝটপট গাছে চড়ে, নদী পার হতে লাগল নেকড়ে। গাছ তখনও পড়েই আছে। চিতা নদী পার হচ্ছে। গাছ পড়ে আছে যেমনটি ছিল।
ওপারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে নেকড়ে। এবার মাত্র একটা লাফ দেবে নেকড়ে। গিয়ে নামবে নদীর ওপারে। তখনই, ঠিক তখনই ছিটকে উঠে, খাড়া হয়ে গেল এতক্ষণ পড়ে থাকা গাছটা। আর সেই ঝটকায় ছিটকে শূণ্যে উঠে গেল চিতাটা। পড়ল একেবারে নদীর উপর। জলের খরস্রোত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে, কেউ জানল না।
সেদিন থেকে গ্রামের রাস্তায় সুন্দর দেখতে সেই ঘুরে বেড়ানো মানুষটাকে আর দেখা যায় না কোন দিন! কোনও দিনই না।

Post a Comment

0 Comments