জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে ১৪/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী     

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
         
চতুর্দশ পর্ব

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত পরিক্রমার সময় স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসেছিলেন। তিনি নয় দিন বৃন্দাবনে ছিলেন। সেই সময় চারিদিকে ঘন জঙ্গল। স্বামীজীর ইচ্ছে হয়েছিল গিরি গোবর্ধন দর্শন করবেন। সাতদিন শ্রীকৃষ্ণ এই গিরিরাজ গোবর্ধনকে ধারণ করেছিলেন স্বহস্তে। তাই গিরি গোবর্ধন শুধু ব্রজবাসীর কাছে নয় সমস্ত বৈষ্ণবের কাছে পরম তীর্থস্থান। বৃন্দাবন থেকে গোবর্ধন অনেক দূরের পথ। চলতে চলতে ক্ষুধা তৃষ্ণায় বিবেকানন্দ একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আর চলতে পারছেন না। একটা পাথরের উপর বসে পড়লেন। হঠাৎ দেখলেন একজন লোক এক ঘটি দুধ আর কয়েকটা ফল নিয়ে এসে তার হাতে দিয়ে বলল 'এটা খেয়ে নাও'। তারপর এই মানুষটা বনের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চেতনা ফিরে পেয়ে স্বামিজী তার সন্ধান করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও তাকে পেলেন না। ঈশ্বরের অপার করুণার কথা ভাবতে ভাবতে স্বামীজীর দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ব্রজভূমি তাঁর মনকে আপ্লুত করে দিয়েছিল। যমুনা দর্শন করে মনের মধ্যে বিচিত্র এক ভাবে স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে রচনা করেন তার সেই বিখ্যাত সঙ্গীত -                 "মুঝে বারি বনোয়ারী সেঁইয়া, যানেকো দে।                                       যানেকো দে রে সেঁইয়া, যানেকো দে।                                             মেরা বনোয়ারী, বাঁদী তুহারি,                                                 ছোড়ে চতুরাই সেঁইয়া যানেকো দে।                                             যমুনাকি নীরে ভঁরো গাঁগরিয়া                                                  জোরে কহত সেঁইয়া, যানেকো দে"।                                               অর্থাৎ নায়ক কৃষ্ণের প্রতি নায়িকা সখীর আকুল মিনতি আর আত্মনিবেদন। তোমার কাছে আমায় যেতে দাও।          
আবার শ্রীশ্রী মা সারদা দেবী বাঁকেবিহারী দর্শনে এসে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন 'তোমার রূপটি বাঁকা, মনটি সোজা। আমার মনের বাঁকটি তুমি সোজা করে দাও'। 
🍂
এই বাঁকেবিহারী মন্দিরের সঙ্গে দইবড়া নিয়ে একটি আশ্চর্য কিংবদন্তি আছে। বহুকাল আগে একদিন সকালে মন্দিরের সেবাইতরা গর্ভগৃহের দরজা খুলে বিগ্রহকে সাজাতে গিয়ে দেখেন বাঁকেবিহারীর হাতের একটি সোনার বালা নেই। মন্দিরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বালার সন্ধান পাওয়া গেল না। চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময় মন্দিরের কাছে একটি খাবারের দোকানের মালিক মন্দিরের সেবাইতদের একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা বললেন। তিনি বললেন যে গতকাল রাত্রে যখন তিনি দোকান বন্ধ করছিলেন তখন একটি শ্যামল বরন ছোট ছেলে এসে তার কাছে দইবড়া খেতে চায়। ছেলেটি দইবড়া খাবার পর দোকানদার তার কাছ থেকে দাম চাইলেন। ছেলেটি নিজের হাতের সোনার বালা খুলে দোকানদারের কাছে বন্ধক রেখে দিয়ে চলে যায়। দোকানদার প্রমাণস্বরূপ ছেলেটির রেখে যাওয়া বালাটি বের করে সেবাইতদের দেখালেন। সেবাইতেরা বালাটি দেখেই অবাক। এতো বিগ্রহের খোয়া যাওয়া সোনার বালা। ভক্তদের বিশ্বাস সেদিন বাঁকেবিহারীজী মন্দির থেকে বেরিয়ে হাতের বালা বন্ধক দিয়ে দইবড়া খেয়েছিলেন। সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর এই খাবারটি ভগবানকে যে কি পরিমাণ তৃপ্তি দিয়েছিল সেকথা স্মরণ করে এখনো পর্যন্ত প্রতিদিন বাঁকেবিহারীজীর নিত্যভোগে দইবড়া নিবেদন করা হয়। বৃন্দাবনের দইবড়া খেয়ে ভক্তদের মুখেও সেই তৃপ্তির রেশ দেখা যায়।
এই বাঁকেবিহারীজীর মন্দির ব্রজমন্ডলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্দির। প্রতিদিন হাজার হাজার পুন্যার্থী বাঁকেবিহারীজীকে দর্শন করে ধন্য হন। মন্দিরের কাছে গেলেই চোখে পড়ে মন্দিরের সামনে উঁচু চত্বরে, পথে ও পথের পাশের ফুল ও মিষ্টি দোকানে সবসময়ই ভক্তের ভীড়। মূল্য দিলে ভক্তের নামে বিহারীজীর কুসুম শৃঙ্গার রচনা করা হয়। অক্ষয়তৃতীয়ার দিন হাজার হাজার টাকার ফুল দিয়ে বিহারীজীর কুসুম শৃঙ্গার হয়। বৎসরে ওই একদিনেই পুণ্যার্থীরা বাঁকেবিহারীজীর শ্রীচরণ দর্শন করতে পারেন। বৃন্দাবনে দোলের প্রধান উৎসব হয় বাঁকেবিহারী মন্দিরে। জনস্রোত একটু একটু করে মন্দিরে প্রবেশ করছে। ভেতরে তিল ধরনের জায়গা নেই। ভগবান বাঁকেবিহারীকে দোল মঞ্চে নামিয়া আনা হয়েছে। পুরোহিতরা সকলের আগে তাঁকে রঙ দিয়ে উৎসবের সূচনা করেন। মন্দিরের সামনে পথের বাঁ দিকে বাঁধানো প্রাঙ্গণ - রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। সামনের মূল দরজা দিয়ে ঢুকে নাটমন্দির। পুন্যার্থীরা সেখানেই জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে আছেন। গর্ভমন্দিরে দরজায় পর্দা ঝোলানো আছে। পর্দা সরলে বিহারীজীকে দর্শন করা যায়। কৃষ্ণবর্ণের অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী মূর্তির। উজ্জ্বল দীপ্তিশীল নেত্রের আভায় বিহারীজী তাঁর হাজার হাজার ভক্তদের মুগ্ধ করে রাখেন। এই মন্দিরে সেবা অর্চনার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন আরতির সময় এখানে ঘন্টা বাজানো হয় না অন্য সকল মন্দিরের মতো, এখানে মঙ্গল আরতি হয় না। বাঁকেবিহারীজীর মন্দিরের ভোগ নিবেদনের পদ্ধতিও অন্যান্য মন্দিরের থেকে আলাদা। এখানে মঙ্গল আরতি শুরু হয় সকাল সাড়ে নটায়, কারণ সেবাইতদের বিশ্বাস বাঁকেবিহারীজী রাত্রে মন্দিরে থাকেন না। তিনি চলে যান নিধুবনে। সেখানে রাধারানীর সাথে রাসলীলা সমাপন করে ফিরে আসেন ভোররাত্রে। সেই সময় বিগ্রহকে মঙ্গলারতি করা হয় না। সেজন্য একটু বেলা করে মঙ্গলারতি করা হয়। মঙ্গল আরতির পরে শৃঙ্গার বেশ। চব্বিশ গজ কাপড় রাধাকৃষ্ণের দুটি দেহ একসঙ্গে লীন ভেবে পরানো হয়। অর্ধাংশে মালকোচা ধুতি বাকি অর্ধাংশে শাড়ি। মস্তকের একদিকে চুড়া অপরদিকে মুকুট। শৃঙ্গারের পরে শুরু হয় ভোগ নিবেদন। সেটি প্রাতঃকালীন ভোগ বলে পরিচিত। এরপরে দুপুর বারোটায় রাজভোগ নিবেদন করা হয়। বিকেলে বৈকালিক ভোগ এবং রাত্রিতে শৃঙ্গারভোগ। ভোগের মধ্যে তরমুজ এবং টমাটো দেওয়া যাবে না। কুল হলে তার ভেতর থেকে বীচটি বের করে সেখানে খোয়া দিতে হয়। রাত্রিকালীন ভোগে তিন চার ধরনের পুরি, মিষ্টি দেওয়া হয়। ভোগ নিবেদন করার পরে দরজা বন্ধ করে শয়ন দেওয়া হয়। বাঁকেবিহারীজীর মন্দিরে ছোট ছোট গোস্বামী বালকেরা ক্ষনে ক্ষনে পর্দা ফেলে দেয় ও পর্দা সরিয়ে দেয়। ঐ পর্দা ফেলে দেওয়া আর সরিয়ে দেওয়ার ভেতর দিয়েই বাঁকেবিহারীজীকে দর্শন করতে হয়। এই দর্শনকে বলা হয় ঝাঁকিদর্শন। ভক্তিভরে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে প্রাণ মন দিয়ে ডাকলে তিনি নাকি ভক্তের সঙ্গে চলে যান। প্রবাদ কয়েকবার নাকি তিনি চলেও গিয়েছিলেন। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষ এইরকম ঝাঁকিদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন যাতে কোন ভক্ত বেশিক্ষণ বাঁকেবিহারীজীর দিকে তাকিয়ে থাকতে না পারেন। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন দোলযাত্রা উৎসব। মন্দির থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরবর্তী প্রত্যেকটি রাস্তায় অসংখ্য মানুষের ভিড় এবং সকলেই রং পিচকারী ও গুলাল নিয়ে একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছেন। বাড়ির ছাদগুলি থেকে বালতি বালতি রং ঢালা হচ্ছে দর্শনার্থীদের মাথার উপরে। বৃন্দাবনে দোলযাত্রায় মানুষের মধ্যে কি প্রকার উন্মাদনা হয় তা লক্ষ করে আমরাও সেই আনন্দের সাগরে ভেসে যেতে লাগলাম। এত ভিড়ে আমার স্ত্রী যেতে পারবেন না বলাতে তাঁকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে আমি মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কোনক্রমে মন্দির পর্যন্ত পৌঁছে নাটমন্দিরে প্রবেশ করে দেখলাম সেখানেও রং পিচকারী দিয়ে ছোট ছোট গোস্বামীরা গর্ভগৃহের উপর থেকে দর্শনার্থীদের গায়ে রংয়ের ফোয়ারা ছড়িয়ে দিচ্ছে। হোলির গানে মুখর হয়ে উঠেছে মন্দির প্রাঙ্গণ। বৃত্তের মতো ঘেরা নাটমন্দিরের বারান্দা থেকে মুঠো মুঠো রঙিন আবির উড়ে আসছে। বারান্দার চারকোণে বসানো 'ব্লোয়ারে'র সাহায্যে কামানের গোলার মতো নীল, লাল, গোলাপি, হলুদ আবির ছড়িয়ে পড়ছে নাটমন্দিরের অভ্যন্তরে। কখনো গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে নাচছে। সেকালের ব্রজভূমির গোপীদের মত একালের মেয়েদেরও দেহ মন রঙের খেলায় মাতোয়ারা। সব সঙ্কোচ মুছে গেছে আজ, সকলের একটাই পরিচয় কৃষ্ণপ্রেমী। অনেকের গলায় ফুলের মালা। এত নারী-পুরুষ একসঙ্গে হোলি খেলায় মাতোয়ারা তবু শালীনতার কোথাও অভাব নেই। ভগবান কৃষ্ণের কাছে এসে শুধু দেহ নয় মন ও পবিত্র হয়ে উঠেছে সকলের।
                                                   পরবর্তী অংশ পঞ্চদশ পর্বে

Post a Comment

0 Comments