জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৯/সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৯
সুমিত্রা ঘোষ

ইংরাজী ১৮৫৫ সাল পড়ল। ইতিমধ্যে কামারপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রানির ভালমত পরিচয় ঘটেছে যিনি কলকাতায় ঝামাপুকুর এলাকায় ভাড়া ঘরে বসবাস করেন এবং নিজস্ব টোলে ছাত্রদের বিদ্যাদান করে থাকেন। রামকুমার ভাল শ্যামাসঙ্গীতও গাইতে পারেন, যে গান শুনে রানি রাসমণি ইতিপূর্বে মোহিত হয়েছেন। রামকুমারের সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠ ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায়ও জানবাজারের বাড়িতে এসেছেন এবং রানি রাসমণি ও মথুরের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন।
পাঁজি- পুঁথি ঘেটে পণ্ডিতেরা দিন ঠিক করলেন ১৮৫৫ সালের ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন মন্দিরের গর্ভগৃহে মা ভবতারিণীকে প্রতিষ্ঠা করা হবে। মা ইতিমধ্যে রানিকে স্বপ্নে বলেছেন, আমাকে আর কতদিন ওইভাবে আবদ্ধ করে রাখবি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। রানি স্বপ্ন পাওয়ার পর কাঠের বাক্সের ডালা খুলে দেখেছেন মা ঘেমে যাচ্ছেন। তখন থেকে রানি অস্থির হয়েছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইতিমধ্যে মা-ভবতারিণী দুজন প্রিয় ভক্তকে জানবাজারের এনে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। একজন ঝামাপুকুরের চতুপাষ্ঠীর অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ছোট ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায়। রানি মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন হওয়ায় অন্যান্য আয়োজনে মন দিলেন যেমন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পন্ডিতদের দক্ষিণেশ্বরে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। এ যে সে কাজ নয়। জগৎ জননীকে গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার প্রভাবে সারাবিশ্বের লোক দক্ষিণেশ্বরে এসে মা ভবতারিণীর কৃপালাভে ধন্য হবে। কাশী, কনৌজ, অযোধ্যা, দক্ষিণভারত, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্য থেকে বড়-বড় বিদগ্ধ পণ্ডিতবর্গ রানির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে, যথাসময়ে দক্ষিণেশ্বরে হাজির হবেন বলে খবর পাঠালেন। পণ্ডিতবর্গ ছাড়াও চারিদিকে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছিল যাতে আসমুদ্র হিমাচল থেকে সকলে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হয়ে ওই মহতী অনুষ্ঠানে যোগদান করে।মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন ঠিক হওয়ার পর অন্য সমস্যা দেখা দিলো। যেমন কে মায়ের পূজা করবেন এবং মাকে ভোগ নিচ্ছেন করবেন। মা ইতিপূর্বে রানিকে স্বপ্নে বলেছেন, আমি মন্দিরে নিত্যপূজা গ্রহণ করব ও ভোগ নেব। সমস্যা এই কারণে দেখা দিল রানি নিচু জাতের মেয়ে। সামাজিক প্রথা অনুসারে রানি মাকে ভোগ নিবেদন করতে পারেন না। আবার আর এক সামাজিক প্রথা মাথা চাড়া দিল শূদ্রাণীর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে কোনও উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ পূজারি হতে চাইলেন না। তখনকার দিনে সমাজের মাথা স্বরূপ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও পুরোহিতরা অশান্তি সৃষ্টি করতে লাগলেন, কারণ নীচবর্ণের মহিলা দ্বারা অন্নভোগের ব্যবস্থা হলে কেউ-ই অন্নভোগ গ্রহণ করবেন না এবং কারুকে ভোগ গ্রহণ করতে দেবেন না।
রানি রাসমণি মহা সমস্যায় পড়লেন। চিন্তান্বিত  হয়ে, গৃহে রঘুবীরের কাছে আর্তি জানাতে লাগলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই রানি কঠোর সাত্ত্বিক জীবন যাপন শুরু করেছেন। পূজা-পাঠ-সন্ধ্যা আহ্নিক করা ছাড়া শুদ্ধ ও পবিত্র জীবন যাপন করেছেন। মাটিতে শয়ন করেছেন, দানধ্যান করেছেন, স্বল্প আহার করেছেন। তাঁর সাত্ত্বিক জীবন যাপনের তুলনা মেলা ভার ছিল। তা সত্বেও মন্দিরে মাকে প্রতিষ্ঠা ও ভোগ নিবেদন নিয়ে গুরুতর সমস্যা দেখা দিল।
এমন সময় মা-ই-নিজে রানিকে পথ দেখালেন। ঝামাপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে বললেন, রানিমা একটা উপায় আছে, আমি আপনাকে এই ব্যাপারে বিধান দিতে পারি। যেমন আপনি যদি এই মন্দিরের সমস্ত সম্পত্তি কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন এবং সেই ব্রাহ্মণ মা ভবতারিণী মন্দিরে দেবী প্রতিষ্ঠা করে অন্নভোগের ব্যবস্থা করেন তাহলে শাস্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘিত হবে না এবং ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণ এই মন্দিরে প্রসাদ গ্রহণ করলেও দোষ ভাগী হবেন না। রামকুমারের পরামর্শে রানি যারপরনাই খুশি হলেন এবং রামকুমারের পরামর্শে রানি তাঁর গুরুকে দেবালয় অর্পণ করলেন। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে পূজারির পদে বরণ করলেন। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মা কালীর ভক্ত ছিলেন এবং শুদ্ধাচার জীবন যাপন করতেন। নিত্য গঙ্গা স্নান, পূজা-পাঠ, উপোস- বার-ব্রত ইত্যাদি সংযমের মধ্যে দিন কাটাতেন।
ক্রমশ  

Post a Comment

0 Comments