জ্বলদর্চি

মাতৃস্নেহ' -একটি পরিণত মনের কাব্যগ্রন্থ। আলোচনায় স্বপন কুমার দে।

'মাতৃস্নেহ' -একটি পরিণত মনের কাব্য
গ্রন্থ আলোচনায় স্বপন কুমার দে

কিছুদিন আগে 'জ্বলদর্চির'সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে  কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ রচিত 'মাতৃস্নেহ ' কাব্য। এই কাব্যটি কবিমানসের সারাজীবনের অভিজ্ঞতার ফসল, আবেগের স্বর্ণ রেণু। গ্রন্থ আলোচনার প্রাক্কালে শ্রদ্ধা জানাই কবির অদম্য স্পৃহা ও জীবনীশক্তিকে। গ্রন্থ সূচনায় মুখবন্ধে আমরা জানতে পারি যে,জীবন সায়াহ্নে বসে কবি এই কাব্য প্রকাশ করেছেন। এই বয়সে কী পরিমাণ জীবনীশক্তি থাকলে এই সাধনায় ব্রতী হওয়া যায়, তা ভেবেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়,শ্রদ্ধা বর্ধিত হয়।

এই জীবনে কবি বহুদর্শী। বহু দেখেছেন, বহু শুনেছেন।জীবনের ওঠা-পড়া, ঘাত-প্রতিঘাতভরা সমস্যা সংকুল পথ পেরিয়ে এসেছেন। স্মৃতি- বিস্মৃতিময় শৈশব থেকে পথ চলতে চলতে তিনি পরিপূর্ণতার পর্যায়ে বর্তমানের দুয়ারে।এইরকম একজন মানুষের অনুভূতিগুলিকে বিচার করতে গেলে অনেক সাবধানী হতে হয়।এঁদের আর আলাদা করে ভাবতে হয় না,তাঁদের মানস অভিব্যক্তিগুলোই জীবনের এক একটি দিক্ দর্শন করায়। এজন্য তাঁদের কষ্ট কল্পনার দরকার নেই, আলাদা করে মাল মশলা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সংঘর্ষময় জীবনের ব্যক্তিক অনুভূতিগুলিই সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ হয়ে চিরকালীন আবেদন নিয়ে পাঠকের কাছে হাজির হয়।এক একটি অভিজ্ঞতাই জীবনের এক একটি ছোটগল্প হয়ে জীবনোপন্যাসের প্লট নির্মাণ করে।

আরও পড়ুন 👇

আর একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, পরিণত বয়সের ( বলা ভালো, পরিণত মনের) কাব্য সাহিত্য একাধারে আবেগ ও মননের যুগ্ম ফসল। আবেগ আছে,কিন্তু তাকে সংযত করার বাসনাও আছে। শুধুমাত্র আবেগের আতিশয্যে কাব্যে রসাভাষ ঘটতে পারে তাই কবিকে ব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে হয়।এই কাব্যে তার প্রতিফলন যথাসময়ে করা হবে।

'মাতৃস্নেহ ' নামটার মধ্যেই প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন আবেগ ও অনুভূতি থাকে। ছোট্ট বেলার আদর শাসন থেকে শুরু করে বড়ো বেলা পর্যন্ত মায়ের প্রতিটি আচরণ সন্তানেরা দেখে,শেখে,অনুকরণ করে।কাজেই প্রতিটি মানুষের কাছে মায়ের স্থান এবং তার অভাব অন্য কিছুর দ্বারা পরিপূরণ সম্ভব নয়।সুতরাং আমরা যখন 'মা' সম্পর্কে লিখতে বসি তখন চোখের সামনে নিজের মায়ের মূর্তিটাই ভেসে ওঠে। শ্রদ্ধেয়া লেখিকা এখানে অনেকটাই সজাগ। তাঁর চেতনায় 'মা' শুধু গর্ভধারিনী বা স্তন্যদায়িনী মানবী নয়, এই 'মা' হল--মাটি,জল,আকাশ, নদী-- অর্থাৎ সমগ্র প্রকৃতি। প্রকৃতির মধ্যে এই মাতৃসত্তার সম্যক উপলব্ধি  তাঁর চেতনাকে আলোড়িত করে।ভিন্ন ভিন্ন কবিতায় তারই পরিচয় মেলে।
🍂
'মাতৃস্নেহ' কাব্যগ্রন্থে আশিটিরও বেশি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এক একটি কবিতা যেন এক একটি স্ফটিক খণ্ড। সেই স্ফটিকের স্বচ্ছতায় দেখতে পাওয়া যায় ভেতরের 'আমি'টাকে, যে 'আমি' ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্র মাঝে ক্ষুদ্র ডিঙিটাকে অবলীলায় বেয়ে নিয়ে চলেছেন।

প্রথমেই আসি এই কাব্যের নাম কবিতা 'মাতৃস্নেহ' প্রসঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে,'মা' শব্দের অর্থ বহুমাত্রিক। কোনো একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে 'মা' কে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এমন সর্বংসহা, অসীম ধৈর্য্যশীলা মূর্তি জগতে দুর্লভ। একই মায়ের মধ্যে সময় বিশেষে বিভিন্ন গুণের, বিভিন্ন রূপের প্রকাশ ঘটে। কবি লিখছেন,
  "অনাদি অনন্ত কাল ধরে
              মা রেখেছে বুক পেতে
              শত কোটি সন্তানের তরে।"
এই মা তো সর্বজনীন। এ তো চিরন্তন মাতৃমূর্তি। এই মা জন্মদাত্রী, ধাত্রী, পালয়িত্রী, আশ্রয়দাত্রী। এই মা সন্তানের সুখে সম্পদে আনন্দময়ী,আবার দুঃখে বিগলিত করুণাধারা। সন্তানের কর্তব্য মায়ের যথোচিত মর্যাদা দান।

'আহ্বান' কবিতায় কবি তাঁর অন্তরাত্মার আহ্বান শুনেছেন। তাঁর আশা, তাঁর অন্তর দেবতা, তাঁর জীবনের রুদ্ধ দ্বার করাঘাতে ভেঙে ফেলে তাঁকে মুক্ত  করবেন। তাঁর মনের অবরুদ্ধ ভাবরাজি ভাষা খুঁজে পাবে সেটাই তো তাঁর পূর্ণতার সন্ধান। অহরহ এই আত্মানুসন্ধান চলতেই থাকে।

'মায়া' কবিতায় এই পৃথিবীর প্রতি,মাটির প্রতি টান কবির মানস লোককে বাস্তব জীবনের অভিমুখী করেছে।প্রাণে,প্রাচুর্যে, আশ্রয়ে যিনি সর্বদা আমাদের রসদ জুগিয়ে চলেছেন, তিনি হলেন আমাদের প্রকৃতি মা।
'মহাশূন্যে' কবিতায় দৃশ্যমান জগতের বাইরে অদৃশ্য মহাজগতের প্রতি টান ধরা পড়েছে। কল্পনায় অথবা বাস্তবে মানুষের এই পরিক্রমা চিরকালীন।

'মালা' কবিতায় কবি বলেছেন, তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতার এক একটি ফুল দিয়ে তিনি বিনি সুতোর মালা গাঁথতে চান।রঙ বাহারি ফুলের মেলায় জ্বলজ্বল করবে সেই মালা।

'নির্জনে' কবিতায় কবি মানসের স্বপ্ন ভ্রমণ পাঠকের চিত্তকে এক অনাস্বাদিত স্বপ্ন লোকে নিয়ে যায়।বস্তু জগতের যন্ত্রণা ও অবসাদ থেকে মনে আসে মুক্তির আকুলতা। মন তখন স্বপ্ন দেখে। এই রোমান্টিকতা আকাশ ছুঁতে চায়।

'জোয়ার ' কবিতায় কবি সেই জোয়ারের অপেক্ষায় , যা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে গণ্ডী ভেঙে। সেই চির আকাঙ্খিত জোয়ার কবির অন্তরলোকে আলোড়ন তুলবে--এই আশায় কবি পথ চেয়ে থাকেন। 'কর্ণধার' কবিতায় কবি বিশ্বাস করেন, সমস্ত ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা 'তাঁর ' স্পর্শে মহত্তর হয়ে উঠবে।

'কষ্ট' কবিতা মানুষের জীবনের দুঃখ শোকের কষ্টকে মনে করায়। স্বজন হারানোর কষ্ট, আত্মীয় বিয়োগের কষ্ট। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এই কষ্ট রয়েছে।শৈশবে চোখ মেলে দেখা পৃথিবীর সঙ্গে বার্ধক্যের পৃথিবী একেবারেই মেলে না।একান্ত প্রিয়জনেরা একে একে চলে যান। আর আমরা স্বজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকি। জীবনের শেষ বেলায় হিসাব মেলাই। এই কষ্ট এই কবিতায় রয়েছে।

এরকম আরও বহু কবিতায় জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শন ও প্রজ্ঞা অনুভূতির ভিন্ন ভিন্ন তীব্রতায় প্রকাশিত। রসজ্ঞ পাঠক কাব্যের রসাস্বাদনে  তৃপ্ত হবেন বলেই আশা রাখি। কবিতার বলা কথার চেয়ে না বলা কথাগুলোই বেশি ভাবায়। এই কৃতিত্ব কবির। 

Post a Comment

1 Comments