জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩২ / সালেহা খাতুন

সেই আমি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩২ / সালেহা খাতুন 

তিরানব্বইয়ে শুধু যে বন্ধুবান্ধব আর পরিবারে সীমাবদ্ধ ছিলাম তা নয়। সমাজ রাজনীতিতেও নজর ছিল। সমাজকে রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। উননব্বইয়ে মাধ্যমিক দেওয়ার পর আর আমার বেলডুবি হাইস্কুলে যাওয়া হয়নি। তিরানব্বইয়ের জুনে ফার্স্ট এড ট্রেনিং নিতে আবার গেলাম স্কুলে। কতদিন পর স্যারদের দেখলাম। দিদিমণি বললেন পাঁচ বছরে আমি অনেক পাল্টে গেছি। হেড মাস্টারমশাই বললেন সিক্সটি পার্সেন্ট পাচ্ছিস তো? হেড মাস্টারমশাইয়ের বই নিয়েই তো আমার অনার্স পরিক্রমা। চণ্ডীমঙ্গল,শাক্তপদাবলী ও অন্যান্য আরো কিছু টেক্সট বই তিনি আমায় দেন যে বইগুলো তিনি ছাত্র জীবনে নিজে পড়েছিলেন।

আমার হেডমাস্টারমশাই বিশ্বনাথবাবু তিরানব্বইয়ের প্রথমদিন শুক্রবার আমাদের বাড়িতে বাবার কাছে এলেন। বাউড়িয়া যাতায়াতের পথে বাবার সঙ্গে খানিক গল্পগাছা করতেন। সেদিন শিশুমেলায় বাবা-মা ও ভাই যোগ দেয়। ফলে বাড়িতে আমি আর বোন। বিশ্বনাথবাবুর মুখে শুনলাম আমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। দুইবোন হেসে লুটিয়ে পড়লাম। তখনো জানিনা আমাকে নিয়ে মিথ্যে আলোচনা চলছে নানান দিকে। সেটি হলো “পালিয়েছি আমি”। 

অবাক হয়েছিলাম সে কথায়। আজো খুঁজে পাই না এর সঠিক কারণ। তখন বড্ড কষ্ট হয়েছিল। আমাকে নিয়ে আমাদের সমাজের যত শরৎবাবু, বঙ্কিমবাবুদের অলীক মিথ্যে কল্পনা যাচাই করতে আত্মীয় স্বজনদের আগমন ঘটল বাড়িতে। বড়ো পিসিমা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে খানিক কাঁদলেন।

🍂

সামান্য দুঃখও হলো। সাধারণ মানুষ মিথ্যে গুজব নিয়ে বেশি হইচই করে। আমি কার কাছে প্রশ্ন করবো? কে এমন সব কথা তুললো? সত্যি আমি বিস্মিত হই – সারাদিন রাত আমি বাড়িতে বাবা মা-র সঙ্গে রয়েছি আর লোকে বলে কিনা “ সালেহা পালিয়েছে”। এ মিথ্যে এ অপমান সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করেছি রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়ে।

তখন আমার মনে কতকগুলি প্রশ্ন জেগেছিল -

১. নিশ্চয়ই কোনো মানুষের জীবন এ ঘটনায় পূর্ণ নয় ?

২. কেন মানুষ এমন কথা বলে?

৩. আমি তো সত্যিকারের কোনো অপরাধ করিনি, তবুও কেন এ নিয়ে তারা মেতে উঠে?

৪. মানুষ মিথ্যে বানাবার শক্তি কোথা থেকে পায়?

৫. নিষ্কলুষ, পবিত্র চরিত্র গঠন করার স্বপ্ন আমার সেই ছোটোবেলাকার। আমি জানি আমি তো পবিত্র। তাই কি লোকে এভাবে বলে?

৬. আমি জ্ঞানত কাউকে অপমান করিনি বা আঘাত দিই নি কিন্তু তারা কেন আমার নামে এমন করে বললো?

৭. আমরা রক্ষণশীল পরিবারে মানুষ, তখনো পর্যন্ত কোনোদিন সিনেমা হলে ঢুকিনি, সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে ভাইবোন সম্পর্কে সম্পর্কিত। শিশুকাল থেকে কো-এডুকেশনে পড়াশোনা করেছি। মন আমার দৃঢ়ভাবে গঠিত হয়ে গেছে। যখন পথভ্রষ্ট হওয়ার সময় তখনও তাকে বড়ো আঙুল দেখিয়ে পেরিয়ে এসেছি। আমার দোষ কেউ দিতে পারেন নি।
তিরানব্বইয়ের মহারাষ্ট্র ভূমিকম্প

   আর আজ আমি পরিপূর্ণ মানুষ। স্বাধীন চিন্তা করার শক্তি, চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার শক্তি, কানে শুনে বিচার করার শক্তি সবই আমার আছে, কেউ ইচ্ছে করলেই আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না।

তবুও একদল অবিবেচক মানুষ আমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। কোনো কিছু না পেরে উঠে মিথ্যে অপমান করার চেষ্টা করছে। ওসব আমাকে বিচলিত করে না। কিন্তু আমি হৃদয়বতী, সেই জন্য একটু আঘাত লাগেও বটে। বড়ো হতে গেলে শুনি অনেক বাধা আসে। সেই বাধার একটি মনে করে আমি তাকে দৃঢ়তার  সঙ্গে অতিক্রম করেছি।

তিরানব্বই-এ ব্যক্তিজীবন যেমন ঘটনাবহুল ছিল আশপাশের পরিবেশও তেমনি ছিল ঘটনার ঘনঘটায় আচ্ছন্ন। স্যারের প্রিয় ছাত্র শান্তনুদা মারা গেলেন। (তিনি আমাদের বন্ধু চন্দ্রাণীর দাদা)বাবার দুই মামা,মামাতো ভাই পাড়ার অনেক প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, খ্যাতনামা অনেক মানুষজনকে হারালাম। জুলাই মাসে চলে গেলেন রাজ্যপাল নুরুল হাসান। একুশে জুলাই মমতার মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে চলে গেল তেরোটি প্রাণ। মহারাষ্ট্র ভূমিকম্পে হারালাম আত্মার আত্মীয়দের। দুর্ঘটনার জেরে স্কুলবাসে তরতাজা শিশুদের প্রাণ গেল। বোম্বাই-এ হলো বোমাবিস্ফোরণ। বৌবাজার- এও এই একই দুর্ঘটনা ঘটে।
(ক্রমশ)

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments