লিটল ম্যাগাজিনের মর্যাদা বাড়িয়েছে জ্বলদর্চি
পবিত্র সরকার
পৃথিবীর সব দেশেই যদিও বড়, জনপ্রিয়, গেরস্থালির বৈঠকখানা ঘরে সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখার যোগ্য সাময়িকপত্র প্রচুর বেরোয়, তার পাশাপাশি সেই সঙ্গে বেরোয় কিছু 'লিট্ল ম্যাগাজিন', যেগুলি সেই দেশের সাহিত্যরুচি আর জ্ঞানভিত্তির একটা আলাদা সম্মানের চিহ্ন হয়ে ওঠে। আমার প্রায় ষাট বছর আগে মার্কিনদেশে 'স্যাটারডে রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটা কার্টুনের কথা মনে পড়ছে। তাতে স্বামীস্ত্রী বাড়ির সামনেকার ডাকবাক্সো থেকে সেদিন আসা পত্রপত্রিকা বার করছে। হঠাৎ স্বামী বলে উঠল, শোনো, ওই পাশের বাড়ির স্মিথরা আসছে, শিগগিরই Latest Fashions পত্রিকাটা তলায় রেখে Hudson Review-টাকে ওপরে রাখো, যেন ওরা দেখতে পায়।
আরও পড়ুন 👇
তাই লিট্ল ম্যাগাজিন যে বুদ্ধিজীবীদের কাগজ, আর পৃথক মর্যাদা বহন করে সেই চেতনা সব দেশেই আছে। অবশ্যই তার জন্য লিটল ম্যাগাজিন যাঁরা করেন তাঁদের উন্নাসিক হওয়া সংগত কি না সেটা একটা আলোচনার বিষয়। কারণ জনপ্রিয় পত্রিকারও একটা উপযোগিতা আছে, তা বহু মানুষের নানা ধরনের চাহিদা মেটায়, নিশ্চয় বুদ্ধিজীবিতার চাহিদাও এক ভাবে মেটায়। বিশেষ করে আমাদের মতো শিক্ষাদারিদ্র্যের দেশে সব পত্রিকাই একটা বৃহৎ পাঠ-সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। যে দেশে নিরক্ষরেরা (এ দেশে নিরক্ষরের সংখ্যা এখনও সম্ভবত পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি) পাঠ-সংস্কৃতিতে ঢুকতেই পারল না, সে দেশে যা কিছু সাক্ষরদের মুদ্রিত বিষয়ের পাঠে আমন্ত্রণ করছে তার প্রতিই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
কিন্তু এও ঠিক যে, লিট্ল ম্যাগাজিন যা করে তার সঙ্গে জনপ্রিয় পত্রের তুলনা হতে পারে না। নতুন লেখকদের সুযোগ দেওয়া, তাদের উন্নয়নে সাহায্য করা, যে বিষয়গুলি দুরূহতা, প্রান্তিকতা, দীর্ঘ পরিসর বা দুঃসাহসের জন্য জনপ্রিয় পত্রিকা ছাপতে সাহস করে না সেগুলির জন্য লিটল ম্যাগাজিন অঢেল জায়গা করে দেয়, অন্তত কেউ কেউ তো বটেই। নিজের টিকে-থাকার অর্থনীতির কথা ভাবে না, পত্রিকা থেকে সংসারপোষণের কথা ভাবে না, কিন্তু নিজের পকেটের অর্থ খরচ করে নিজের গেরস্থালিকে প্রণালীবদ্ধভাবে বঞ্চনা করে যায়। 'জ্বলদর্চি'ও সেই কাজটিই এতদিন ধরে করে এসেছে। বাংলাভাষার সমস্ত বিখ্যাত লেখক এই জন্য 'জ্বলদর্চি'কে তাঁদের বিপুল মমতা দিয়েছেন এবং লেখা দিতে কখনও কার্পণ্য করেননি। এই তালিকায় আমার মতো অখ্যাতদের নামও আছে। এই সংকলনের মধ্যে তার দুর্ধর্ষ প্রমাণ নিহিত।
সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী জ্বলদর্চি তিরিশ সংকলন প্রকাশ করে একটু অন্যভাবে পাঠকদের সম্ভাষণ করতে এগিয়ে এসেছেন। দক্ষ ও যোদ্ধা সম্পাদকের হাতে যেমন হয়, 'জ্বলদর্চি' সেই অর্থে আর ছোট পত্রিকা থাকেনি। এই সংকলনটির সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যাবে।
🍂
সাহিত্যের পাশাপাশি 'জ্বলদর্চি'র আর একটি স্থায়ী ব্যগ্রতা ছিল। তা হল আধুনিক বাঙালি ছোটবড় শিল্পীর চিত্রকলার প্রকাশ। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে 'জ্বলদর্চি' অজস্র স্কেচ ও ছবি ছেপেছে, রঙিন ছবিও। এ থেকেই তার রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য—হয়তো একে এক ধরনের 'আভিজাত্যই বলে—তা স্পষ্ট হয়। সে তার 'ছোটত্বে'র প্রচলিত পরিচয়কে ভেঙেছে নানা দিক থেকে, বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের মর্যাদা ও মহিমা বাড়িয়েছে।
আমি ঋত্বিককে বাঙালি সংস্কৃতি-বলয়ের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই তার এই অসামান্য কাজের জন্য। 'জ্বলদর্চি' তিরিশের পর আরও বহু তিরিশ সগৌরবে অতিক্রম করুক, ঋত্বিকের সুযোগ্য কর্ণধারত্বও অব্যাহত থাক।
আমার এই কয়েকটি ছত্র বাঙালি পাঠকের কাছে 'জ্বলদর্চি'র পরিচয় বা সুপারিশের জন্য নয়। তাঁরা 'জ্বলদর্চি'কে জানেন। এই তিরিশের 'জ্বলদর্চি' নিশ্চয় তাঁদের কাছে একটি ব্যাপক স্মৃতিপটভূমি নির্মাণ করবে, সেই সঙ্গে বাংলা ছোটপত্রিকার গৌরবকে আর একবার আত্মস্থ করার সুযোগ এনে দেবে।
0 Comments