জ্বলদর্চি

রাখালি পেশা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ১০০ (শেষ পর্ব)
রাখালি পেশা

সূর্যকান্ত মাহাতো


একটা সময় জঙ্গলমহলে গোরু-বাছুর কিংবা কাড়া চরানো একটা পেশা ছিল। যারা এই পেশায় যুক্ত তাদেরকে বলা হয় রাখাল।কিন্তু জঙ্গলমহলে 'রাখাল' শব্দের পরিবর্তে 'বাগাল' শব্দটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। অনেকেই এই বাগালি-কে পেশা হিসেবে একসময় গ্রহন করেছিল। এখন জীবনযাত্রা, জীবিকা ও অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাই এই পেশাও হারিয়ে গেছে। রাখালেরা আজ 'গল্পকথা' বা ছোটদের গল্প বইয়ের শিরোনামেই স্থান লাভ করেছে। 

একটা সময় ছিল গ্রামের সমস্ত গোরু-বাছুর, ছাগল, ভেড়া ও কাড়াগুলোকে দুই একজন বাগাল মাঠে-ঘাটে, জলে, জঙ্গলে চরিয়ে বেড়ানোর কাজ করত। বছরের শেষে, নয় তো তিন মাস কি ছয় মাস ছাড়া তারা বিনিময়ে মজুরি নিত। শুধু মজুরি নয়, বাঁদনা, মকর প্রভৃতি পরবের সময় গ্রামের সকলে বাগালদের চাল, মুড়ি, পিঠা দিয়ে সাহায্যও করত। তখন সব পরিবারেই কম বেশি গোয়াল ভর্তি গোরু বাছুর ছিল। নায়ের কম চাষের জন্য দুটো বলদ ও একটি গায় গোরু অবশ্যই থাকত। কোন কোন বাড়িতে আবার কুড়ি থেকে পঁচিশটি পর্যন্ত গোরু বাছুর থাকত। এই সমস্ত গোরু বাছুর দিনভর চরাত বাগালেরা। প্রতি গোরু পিছু ছিল তাদের মজুরি। প্রথমে গ্রামের সমস্ত গোরুগুলোকে জোটবদ্ধ ভাবে চরাতো দু একজন বাগাল। পরে পরে সেই জোটবদ্ধতা ভেঙ্গে গেল। অবশ্য এর একটা কারণও ছিল। সম্ভ্রান্ত কিছু কিছু পরিবার কিংবা যাদের অনেক গোরু বাছুর, তারা নিজেরাই বাগাল রাখতে শুরু করেছিল। আসলে সমস্ত গোরু বাছুরকে ওই দু একজন বাগালের পক্ষে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত না। জঙ্গলের বন্য জন্তু এসে আক্রমন করলেও টের পেত না। যেমন 'হুঁড়ার' এসে কতবার বাছুর ও ছাগল ভেড়া তুলে নিয়ে গেছে। দু একটি গোরু তো কতবার মাঠের কুয়ো কিংবা ইন্দারায় পড়েছে বা মারাও গেছে। এমনই সব দুর্ঘটনার কারণে মালিকেরাও পরে পরে সাধ্যমত নিজস্ব বাগাল রাখতে শুরু করল। যদিও তারপরেও বেশ কিছু সময় বাগালেরা তাদের পেশাগত কাজ করে গেছে। কারণ সকলের পক্ষেই তো আর নিজস্ব বাগাল রাখা সম্ভব ছিল না। গ্রামের বাকি পরিবারগুলোর কাড়া ও গোরুর দেখাশোনা করত এই বাগালেরাই।

🍂

গ্রামের মাথায় থাকত 'বাথান'। সেখানে গ্রামের সমস্ত গোরুকে একত্রিত করা হত। তারপর গোনা হত মোট কতগুলো গোরু উপস্থিত হয়েছে। এরপর বাগালেরা মাঠে বা জঙ্গলে ঐ গোরু-বাছুরদের চরাতে নিয়ে যেত। সারাদিন চরানোর পর আবার সমস্ত পোষ্যদের বাথানে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। এখন 'বাথান' শব্দটির মানেই অনেকে জানে না। অনেক সময় কেউ কেউ তাদের গোরুগুলো বাথান পর্যন্ত পৌঁছে দিত, এবং বাথান থেকে আবার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। তবে বেশির ভাগ বাগাল বাড়ি থেকেই সব গোরু বাছুর নিয়ে যেত দল বেঁধে।

এইসব বাগালদের বেশ প্রতিভাও ছিল। কেউ কেউ খুব মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে দিয়ে দারুন সব গান গাইতে পারত। কেউ আড় বাঁশি বাজাতে পারত। সেই সুর সকলকে মুগ্ধ করে দিত। দূর থেকেই সেই সুর শুনে লোকে বুঝে যেত এটা বাগালের বাঁশি। বাঁশিটা তারা কোমরে গুঁজে রাখত। আর বাঁশির সুর গোরুদেরও চেনা হয়ে যেত। কেউ আবার খালি গলায় উচ্চস্বরে ঝুমুর, টুসু, বাউল নয় তো কোন বাংলা সিনেমার গান ধরত। যারা একটু পড়াশোনা জানত তারা কারো কাছ থেকে ধার করে রামায়ণ নয়তো মহাভারতও পড়ত। শাল পাতাকে দোক্তা দিয়ে মুড়ে মুড়ে বিড়ির মতো পাকিয়ে 'চঁটা' বানিয়ে পান করত। চঁটাগুলো লম্বায় বেশ বড় বড় করে পাকাত। এতটাই লম্বা যে সারাদিন পার হয়ে যেত। দু একবার টান দেওয়ার পর নিভিয়ে কানে গুঁজে রাখত। কেউ কেউ রাখত দোক্তার ডিবা নয় তো পুঁটুলি। বাগালি করাটা সারাদিনের কাজ বলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারাও অবসরে বিনোদন করত। বিনোদন বলতে বাগালেরা বসে যেত নানা রকমের ছক কাটা বুদ্ধিদীপ্ত খেলায়। বাঘ-ছাগল, পাঁত, কাটাকুটি কতসব খেলা। চরানোর শেষে বাড়ি ফেরার সময় সমস্ত গোরুকে একত্রিত করতে বিশেষ এক ধরনের ডাক দিয়ে বুলি দিত বাগালেরা। ওই ডাকে গোরুগুলোও সাড়া দিত। বাগালের কণ্ঠস্বর গোরুদের কাছে খুবই পরিচিত হয়ে উঠত। তাই ডাক দিলেই সব গোরু একত্রিত হয়ে পড়ত। কোনটা ভালোবেসে, আর কোনটা শাসনের ডাক গোরুগুলোর কাছে সেটাও পরিচিত ছিল। কোন গোরু ফসলের দিকে চলে গেলে বাগাল শাসন করার ভঙ্গিতে একটি চিৎকার করলেই গোরুটি মুখ ফিরিয়ে চলে আসত।

মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে বছর ভর বাগালেরা গোরু চরায়। তাই বাঁদনার সময় একটি বিশেষ দিন বাগালের জন্য রাখা হয়। ওই দিনটিকে বলে 'কাঁটাকাড়া'। বাগাল ঐ দিন তার পায়ের সমস্ত কাঁটাগুলো তুলে ফেলে। কারণ এরপর তো আবার তাকে মাঠে-ঘাটে বনে জঙ্গলে গরু চরানোর কাজে যেতে হবে।

বাগালের কাজকে বরাবর অনেকেই একটি নিকৃষ্ট কর্ম বলে মনে করে থাকে। এখনো যে করে না তা নয়। তবে তখন অভাব বড় বেশি ছিল বলেই, বাগালি করাকে অনেকেই পেশা হিসেবে অনেকে গ্রহণ করেছিল। তাদের কাছে কাজের ভালো খারাপ বলে কিছু মনে হয়নি। পরবর্তীকালে যদিও অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় এই পেশা হারিয়ে গেছে। শ্রমিক বা পরিযায়ী শ্রমিকের কাজকেই এখন অনেকে বেছে নিয়েছে। তাই এখন নিজেদের গোরু বাছুর নিজেরাই বাগালি করে। বাগালদেরকেও সচরাচর অশিক্ষিত ও মূর্খ বলেই ভাবা হতো। এ কাজে নাকি কোন বুদ্ধি লাগে না। কিন্তু সেটা হয়তো অর্ধসত্য। পুরো সত্য নয়। গোরুদের দেখভাল করাটাও সহজ কাজ নয়। গোরু বাছুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেও ঠিকঠাক জানতে হয় বাগালদের। কেবল ঘিরে রাখা তো নয়। তাদের চরিত্র বোঝা, কোন গোরুর ব্যতিক্রমী আচরণ এসব দেখলেই বাগালকে বুঝতে হয় আসলে গোরুটির ঠিক কী হয়েছে। কোন অসুখ বিসুখ নাকি অন্য কোন কিছু। সেরকম কিছু হলে বাগালের সেটা মালিককে অবগত করতে হয়। বারবার কোন গোরু দলছুট হয়ে পড়লে তাকে কীভাবে দলগত করা যায় তার উপায় বাগালকেই বের করতে হয়। জঙ্গলে যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য গোরুর গলায় ঘন্টা বেঁধে দেয়। আঞ্চলিক ভাষায় এই ঘন্টাকে 'ঠরকা' বলে। কাঠের একটি খোল বানিয়ে তার ভিতর দুটি শক্ত কাঠি দড়ির সাহায্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ঠরকার পেটে। এবার গোরু নাড়াচড়া করলেই সেই কাঠি ধাক্কা খেতে খেতে শব্দ তৈরি করে। দারুন এক শব্দ। কোন গোরুকে আবার জব্দ করতে বেশ ভারি এক কাঠকে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে 'জরকা'। জরকাটি সামনের দু পায়ের ফাঁকে অবস্থান করে। এতে গোরু বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না।

সারাদিন গোরু-বাছুর চরানো বা বাগালি করার সময় ফাঁকে ফাঁকেই তারা ঋতু অনুযায়ী মাঠঘাট ও জঙ্গলের কতসব মৌসুমী ফল খায়। যেমন শীতকালে 'শয়া'(শ্যামা) কুল খুবই প্রিয় একটি খাবার। জঙ্গলমহলের বিশিষ্ট ঝুমুর শিল্পী অঞ্জলি মাহাতো এই শয়াকুল নিয়ে একটি জনপ্রিয় ঝুমুর গানও গেয়েছেন। বেশ ছোট ছোট কুল। পাকলেই কালো রঙের হয়। এই গাছের কাঁটাগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। কেবলই জড়িয়ে ধরতে চায়। সহজে ছাড়ানো যায় না। শীতের শেষে আছে বড় কুল। আছে ঝোড়কুল। এছাড়াও গ্রীষ্মকালে আছে বৈঁচি পাকা, জাম পাকা, আম পাকা, খেজুর পাকা। কত সব খাবার। আছে আমচুর। বন খেজুর। এই সব খাবার খেয়েই তারা কত কত দিন পার করে দিত। নিজেরা যেমন এইসব খেত তেমনি বাড়ির জন্য নিয়েও আসত গামছায় পুঁটুলি বেঁধে। গোরু চরানোর ফাঁকেই কত বাগাল ছাতু কুড়িয়ে ঘরে ফিরে আসে। জঙ্গলে হাতি এলে ওরাই এসে খবর দিত।

বাগালের পেশা যদিও এখন আর নেই। তবে বাগালি করার সেই দিনকালগুলো এখনো কম বেশি রয়ে গেছে। পরিবর্তনও হয়েছে অনেক কিছুই। এখন বাগালেরা ফোনেই অনেকে টাইম পাশ করে। একসঙ্গে অনেক গোরু বাছুরও চরাতে হয় না। এখন ট্রাক্টরে বেশি চাষবাস হয় বলে অনেকে বলদও আর রাখতে চাই না। কেউ কেউ তাদের দুই একটি গায় গোরুকে আবার চরাতেও যায় না। কেবল লম্বা দড়ি দিয়ে ফাঁকা মাঠে বেঁধে দেয়। তাই "রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে" কথাগুলো এরপর কবিতা পড়েই জানতে হবে।

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি এখানেই শেষ পর্ব। যদিও জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি বর্ণনার কোন শেষ বলে কিছু হয় না। সে লেখার পর্ব অনন্ত। আমি কেবল এই একশোটা পর্ব ধরে তার কিছুটা ধরার চেষ্টা করছি মাত্র। উৎসাহী লেখক ও পাঠকেরা এই জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতিকে আরো বেশি করে তুলে ধরতে পারবে এই বিশ্বাস রাখি। 'জলদর্চি' সম্পাদক মহাশয় মাননীয় শ্রী ঋত্বিক ত্রিপাঠী স্যার উৎসাহ না দিলে এ লেখা হয় তো কখনোই লেখা হত না। তাই সম্পাদক মহাশয়কে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার কাছে নেই। তবুও শত কোটি প্রণাম জানাই। ধন্যবাদ জানাই পাঠকদেরকেও। যারা একটুখানি সময় বের করে লেখাগুলো পড়েছেন। এছাড়াও এই লেখায় যারা ক্রমাগত উৎসাহ জুগিয়েছেন ও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

Post a Comment

1 Comments

  1. শেষ পর্বের পরেও আরও চলুক লেখা। এখনও অনেক বাকী।

    ReplyDelete