জ্বলদর্চি

রামকৃষ্ণ রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৩
রামকৃষ্ণ রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল) 

ভাস্করব্রত পতি 

From
Superintendent, 
Midnapur Central Jail, 
No -- 4847 And/ 3
To, 
Babu Naresh Krishna Roy, Chirimarshai
Midnapur Town
Dear sir, 
I write to inform you that your brother Ramkrishna Roy who has been condemned to death desires to have an interview with you. Will you please come to the jail gate at 3.30 P. M. on 10 th instant if you desire to see him. The district Magistrate has no objection to permit you to see your brother. 
Yours faithfully, 
S/D Illegible
Major I. M. S. Superintendent. 

এই চিঠি মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপার ১৯৩৪ এর ৮ ই অক্টোবর লেখেন রামকৃষ্ণ রায়ের বড়দা নরেশকৃষ্ণকে। চিঠি পেয়ে যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ে নরেশকৃষ্ণ জেল গেটে দেখা করলেন ভাইয়ের সঙ্গে। দাদাকে পেয়ে রামকৃষ্ণ বললেন, 'দাদা চললাম, মাকে দেখো। আমি আবার ফিরে আসবো'। আর দাদার হাতে মায়ের নামে লেখা চিঠি তুলে দিলেন। তাতে লেখা 'মাগো এই পৃথিবীতে এসে কেবল আপনাকে দুঃখ এবং অশান্তিই দিয়ে গেলাম। আপনার প্রতি আমি কোনও কর্তব্যই করতে পারিলাম না। তাহার জন্য আমাকে ক্ষমা করিবেন। তোমার কোল হতে চির বিদায় নিয়ে চললাম। গীতাটি দিয়ে গেলাম। প্রণতঃ আপনার রামকৃষ্ণ'। 

মেদিনীপুর শহরের চিড়িমারসাইতে ১৯১২ সালের ৯ ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন জেলাশাসক বার্জ হত্যার অন্যতম আসামী রামকৃষ্ণ রায়। বাবা কেনারাম রায় এবং মা ভবতারিণী রায়। আদপে তিনি জকপুরের বিখ্যাত রায় বংশের সন্তান ছিলেন। এটি খড়গপুর থানার অন্তর্গত। নবাব সরকার থেকে পাওয়া 'রায় ও মহাশয়' উপাধিতেই এঁরা পরিচিত। এই বংশ উদারতা, কার্যদক্ষতা পাণ্ডিত্যে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। লোকের মুখে মুখে নানা ছড়ায় সেসময় যেসব নামগুলি উচ্চারিত হত, তা হল --
      'দানে চনু, অন্নে মানু, রঙ্গে রাজনারায়ণ
      বিত্তে ছকু, কীর্তে নরু, রাজা যাদবরাম'। 

এই ছয়জনই মেদিনীপুরের লোক। 'চনু' হলেন রাজবল্লভ গ্রামের চন্দ্রশেখর ঘোষ, পুঁয়াপাটের 'মানু' হলেন মানগোবিন্দ ভঞ্জ, 'ছকু' হলেন মলিঘাটির ছকুরাম, 'নরু' অর্থাৎ এগরার নরনারায়ণ চৌধুরী, কিশোরনগর রাজবংশের রাজা যাদবরাম এবং এই রায় রাজবংশের সন্তান রাজনারায়ণ রায়। তিনিই এই মহাশয় বংশের শেষ কানুনগো। যাঁদের বাসভবনটিই বর্তমানের মেদিনীপুর টাউন স্কুল। এহেন বংশের সন্তান রামকৃষ্ণ রায়। এই স্কুলেই ১৯২২ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তাঁর সঙ্গেই পড়তেন তাঁর পরবর্তী কালের সহকর্মী অমর চট্টোপাধ্যায়, ফণী দাস, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী প্রমুখ। ১৯২৪ এ গান্ধীজী মেদিনীপুর এলে তিনি সারাদিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যস্ত ছিলেন সেখানে। ১৯২৬ এ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের হয়ে পৌরসভার ভোট সংগ্রহ করেছেন। ১৯২৮ এ মেদিনীপুরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এলে ফের তিনি কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেন। 

মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হলেন দীনেশ গুপ্ত। আসলে বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার্সকে শক্তিশালী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। কিশোর রামকৃষ্ণ যুক্ত হলেন বিপ্লবীদের আখড়ায়। ১৯৩০ সালে তাঁর ওপর ভার দেওয়া হল খড়গপুর রেলস্টেশনে পেডীকে হত্যা করার। সায়ানাইড মাখানো ছুরি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার জন্য। কিছুদিন পরেই অবশ্য পেডীকে মারলেন যতীজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত। এরপর ডগলাস হত্যার ছকও প্রস্তুত। কিন্তু রামকৃষ্ণকে কিছুই বলা হয়নি। আর উল্টোদিকে রামকৃষ্ণও উদগ্রীব ছিলেন দেশের জন্য প্রাণ দিতে। ১৯৩১ এর এর ৭ ই এপ্রিল পেডী হত্যার পর ১৯৩২ এর ২০ শে এপ্রিল আরেক জেলাশাসক ডগলাসকে হত্যা করলো প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশু শেখর পাল। সেখানেও রামকৃষ্ণ আত্মবলিদানের কোনও সুযোগ পেলেননা। এবার দলের দায়িত্বে এলেন রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোর চক্রবর্তী। পরিকল্পনা করা হল মেদিনীপুরের নতুন জেলাশাসক বি ই জে বার্জকে হত্যা করার। 

১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের একটি খেলার মাঠে ব্র্যাডলি বার্ট ফুটবল টুর্নামেন্ট চলাকালীন বিরতির সময়ে অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্তের গুলিতে মৃত্যু হয় বার্জের। এই হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ধরা পড়লেন -- কামাখ্যা ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ, সুকুমার সেনগুপ্ত, শৈলেনচন্দ্র ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, ফনীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সরোজরঞ্জন দাস কানুনগো এবং শান্তিগোপাল সেন। ১৯৩৪ এর ১০ ই ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ট্রাইব্যুনালের রায় বোরোলো। তাতে রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় সুকুমার সেনগুপ্ত, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ এবং কামাখ্যা ঘোষের। বাকিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। 

 ১৯৩৪ এর ৩০ শে আগস্ট হাইকোর্টের রায় বের হল। তাতে ট্রাইব্যুনালের রায়ই সম্পূর্ণ রূপে বজায় রাখা হল। আসলে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীদের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল রুজু করা হয়। খ্যাতনামা ব্যারিস্টার এইচ ডি বসু, ব্যারিস্টার বরেণ বসু এবং তাঁর সহযোগী অ্যাডভোকেট শরৎচন্দ্র জানা, ব্যারিস্টার নিশীথচন্দ্র সেন, এন কে বসু, সন্তোষকুমার বসু প্রমুখ আইনজীবীগন বিভিন্ন আসামীর পক্ষে সমর্থন করেন। তাঁরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘ ১১ দিন ধরে মামলা লড়েছিলেন। এই মামলার যাবতীয় অর্থব্যয় করেছিলেন নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। 

১৯৩৪ এর ২৫ শে অক্টোবর মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি হয়ে যায় মেদিনীপুরের এই অকুতোভয় মানুষ রতনটির। সেইসাথে ফাঁসি হয় ব্রজকিশোর চক্রবর্তীরও। আরেক আসামী নির্মলজীবন ঘোষের ফাঁসি হয় পরের দিন তথা ২৬ শে অক্টোবর। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের নথিতে লেখা আছে -- 'রামকৃষ্ণ রায়, কয়েদি নম্বর এ ৭৬৫৮, বয়স ১৯, উচ্চতা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি, ধারা ১২০ বি ও ৩০২, তারিখ ১২.০২.১৯৩৪, বাড়ি চিড়িমারসাই, মেদিনীপুর, মৃত্যুদণ্ড'। ১০.১০.১৯৩৪ এ নরেশকৃষ্ণ রায় সাক্ষর করে তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান। 

ফাঁসি হয়ে গিয়েছে রামকৃষ্ণ রায়ের। এই খবর পৌঁছে গেল রামকৃষ্ণের মায়ের কাছে। সন্তানহারার যন্ত্রনা তখন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে গিয়েছে মনে এবং প্রাণে। ফাঁসির খবর পেয়ে রামকৃষ্ণের মা তখন একটি কথাই বলেছিলেন ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে, 'এই তিনটিকে মেরেও ইংরেজ তোমাদের রাজত্ব থাকবে না'। এরপর আর কোনো দিন তিনি কথা বলতে পারেন নি।


সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments