সন্ধেবেলাটুকু
মিলি ঘোষ
সন্ধের দিকে মনটা ঠিক বশে থাকে না স্নিতার। নির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই। একটু যেন উদাসী ভাব।
ঠাকুর প্রণাম করে এসে চা নিয়ে বসে স্নিতা। নিজের হাতে বানানো চা'ই ওর সবথেকে প্রিয়। সে চা যত সুস্বাদুই হোক, সন্ধ্যাকালীন ভারটা লাঘব হতে চায় না। এটাও ঠিক, সন্ধের পরে স্নিতার কাজের চাপ অনেক কম। সে'জন্যই কি এমন হয় ? ওই সময়টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে দেখেছে স্নিতা। যে কাজই করুক, একটা তাড়াহুড়ো থাকে। অস্থিরতা থাকে। এই অকারণ ভারাক্রান্ত ভাবটা আরও গভীর হয়,শীতকালের আশেপাশের সময়টায়। তবে কলকাতার শীত তো গ্রীষ্মের লিচু। যেতে আসতে যেটুকু সময়। রোজের হিসেবে কাজ করা রাজমিস্ত্রিদের মতো শীতের রোদও চারটে বাজতে না বাজতে হাত পা ধুয়ে পোশাক বদলে নেয়। আর বিকেল ? সে তো শীতকালীন ছুটিতে বাড়িতেই থাকে। কিন্তু গোটা শীতকালটা একটা বিরাট রাত নিয়ে পসার সাজিয়ে বসে থাকে মাছি তাড়ানোর জন্য। কোনও মানুষের সাড়া নেই। এক পয়সার বিক্রিবাটা নেই। তবু সে পসার সাজাবেই। স্নিতার মনে হয়, এই পৃথিবীতে মানুষ বোধহয় ও একাই।
ছোটবেলায় শীতকাল ছিল স্নিতার প্রিয় ঋতু। তখন শীত মানেই খেলা। উন্মাদের মতো মাঠে ঘাটে খেলে বেড়ানো। বাড়ির মেয়ে খেলতে গেছে বলে এত হায় হায় ছিল না। দুশ্চিন্তাও ছিল না। দিনকাল মানুষকে ভীত করেছে। সন্ত্রস্ত করেছে। সারা বছরের অপেক্ষা ছিল শীতকাল। এখন শীতে সকালটা মন্দ নয়। তবে দুপুরের পর থেকেই নির্জন কারাবাস। স্নিতা ওই সময় নিজেকে বিচারাধীন আসামী ভাবতে শুরু করে।
শরৎ কালের সঙ্গে দুর্গা পুজোর একটা সম্পর্ক থাকায়
শহরের ইট কাঠের জীবনে শরৎ প্রাধান্য পায়। নাহলে কাশের গুচ্ছ কাব্যেই বিরাজ করত। যেমন বসন্তের কোকিল। তবে হেমন্তের আসা যাওয়ার প্রভাব শহুরে জীবনে একেবারেই নেই। শহরে সোনালী ধানের ইশারা কই ?
এমনই এক হেমন্তের যাই যাই বিকেলে অভিজিৎকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছিল স্নিতা, "অভি।"
"মিটিংএ আছি। এক ঘণ্টা পরে কোরো।"
অভিজিৎ লন্ডনে আছে। এ সময় যে ওর অফিস থাকবে, তা স্নিতা জানে। তবু ভাবল, যদি একটু কথা বলা যায়। এক ঘণ্টা পরে তো আর সেই আকুতি থাকবে না। স্নিতা আর মেসেজ দেয়নি দেখে অভিজিৎই ফোন করেছিল।
"কী হয়েছে ? শরীর খারাপ নাকি ?"
"না, না। শরীর ঠিক আছে। হঠাৎ তোর কথা খুব মনে হলো। জানি তুই বিজি থাকিস। তবু মেসেজ দিয়ে ফেললাম।"
"বাবা ফেরেনি ?"
"কোনদিন ফেরে এ'সময় ? এগারোটা বাজুক।"
মাস ছয়েক পরে অভিজিৎ এল হাতে একটু সময় নিয়েই। মায়ের পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা করল। ঠিকে কাজের মাসিকে বলে আকাশের জন্য রান্নার লোকের ব্যবস্থা করল। সে স্নিতার সাধের বাগানে জলও দেবে। ঘর-টর গুছিয়ে রাখবে।
আকাশ আপত্তি করেনি। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি। কিন্তু স্নিতা জোরালো আপত্তি করেছিল। ছেলে শোনেনি।
"নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ। আমার মানিয়ে নিতেই সময় লাগবে।" স্নিতা বোঝাতে চাইল।
অভিজিৎ বলেছে, "আমিও তো একদিন একাই এসেছি, মা। কেউ পাশে ছিল না।"
স্নিতা চুপ করে যায়।
এতদিন অভিজিৎ ফোন করে মায়ের সঙ্গেই কথা বলেছে। বাবার শরীরের খোঁজ মা'র থেকেই নিয়েছে। সকালে অভিজিৎ সময় পায় না আর রাতে বাবার সঙ্গে কথা বলা না বলা সমান। কিন্তু মা'কে নিজের কাছে নিয়ে আসার পর সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবাকে ফোন করে অভিজিৎ। আকাশও তখন স্বাভাবিক। ছেলের ফোন পেয়ে বাবার খুশি খুশি ভাব বহুদূর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না অভিজিতের।
লন্ডনে এসে থেকে স্নিতার সন্ধেবেলার মন খারাপ উধাও হয়ে গেল। অভিজিৎ কোনওদিন সন্ধের দিকেই ফিরে আসে। কোনওদিন সন্ধে পার করে। স্নিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলের জন্য খাবার তৈরি করতে। তবে রোজ করতে হয় না। অনেক দিনই অভিজিৎ বাড়ি ফিরে শুধু চা খায়।
হোয়াটসঅ্যাপে বলে দেয়, "এখন কিছু কোরো না। রাতে একবারে ডিনার করব।"
সেদিন তো স্নিতার সন্ধেতে কাজ নেই। তবু দেশে থাকতে সেই সন্ধ্যাকালীন বুক চাপা অজানা কষ্ট তো এখানে এসে হয় না। স্নিতা নিজেও ভেবেছে। এটা কি পরিবেশের পার্থক্য ? নাকি ছেলের কাছে এসে থাকার সুফল ?
কিছুদিন পরে স্নিতা হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে আকাশের মেসেজ পেল। মাঝেমাঝে ফোনে কথা হলেও মেসেজ বিদেশে আসার পর এই প্রথম।
স্নিতার ঘড়িতে তখন দুপুর পৌনে দু'টো। স্নিতা একটু থমকাল। এখন মেসেজ! সেদিন অভিজিৎ অফিসে যায়নি। দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়িতে বসে নিজের ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল।
স্নিতা সে ঘরে ঢুকে জানতে চাইল, "এখন ইন্ডিয়ান টাইম কত হবে রে অভি ?"
"এখন ? ওই ধরো সন্ধে সাতটা। কেন বলো তো ?"
"না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।"
স্নিতা নিজের ঘরে এসে আকাশের মেসেজ দেখল।
"কেমন আছো স্নিতা ?"
"ভালো। তোমার শরীর ঠিক আছে ?"
"শরীর ঠিক থাকাটাই কি শেষ কথা ?"
স্নিতা একটু চুপ করে গেল।
আকাশ আবার লিখল, "জানো স্নিতা। আমি আজকাল ছটা থেকে সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাই।"
স্নিতা বলল, "এত তাড়াতাড়ি ফেরো কেন ? বাড়িতে ফিরে সেই তো একা। আগে তো কত রাত করতে।"
"আসলে সন্ধে হলেই মনে হয় কতক্ষনে বাড়ি ঢুকব। কিন্তু এই সন্ধেটুকু পার করাই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কোনও কিছুতেই মন দিতে পারি না। কেন এমন হয় বলো তো ?"
স্নিতা এর কী উত্তর দেবে ?
স্নিতার চাপা দীর্ঘশ্বাস না পৌঁছল পাশের ঘরে থাকা অভিজিৎ এর কানে। না পৌঁছল সুদূর ভারতবর্ষে একাকী দিন কাটানো আকাশের কানে।
স্নিতা লিখল, "ভাবছি, আর কিছুদিন এখানে কাটিয়ে দেশে ফিরে যাব।"
আকাশ আঁতকে ওঠে, "না, স্নিতা না। তুমি ফিরে এলেই আমি আবার আগের মতো হয়ে যাব। এই যে অভাববোধ, সন্ধ্যাকালীন অবসাদ, এটারও প্রয়োজন আছে জীবনে।"
স্নিতা চুপ করে থাকে। আকাশও চুপ।
সামান্য বিরতির পর আকাশ একটু সময় নিয়েই লিখল, "আচ্ছা স্নিতা, তুমিও তো একাই থাকতে এখানে, সারাদিন। তোমারও কি এরকম হতো ? এই সন্ধেবেলার সময়টুকু ?"
0 Comments