বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
একাদশ পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
কি রকম? আসছি সে কথাতেই। কেবল মুখের কথা নয়, সন্ধ্যা নামলে আর প্রবেশ করা যাবে না এই বনে, এমনই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে নিধুবনে। সঙ্গে প্রচলিত হাজারও জনশ্রুতি। প্রচলিত বিশ্বাস এই নিষেধ যারাই অমান্য করার সাহস দেখিয়েছে, তারা সকলেই নাকি মৃত বা অন্ধ অথবা বিকলাঙ্গ বা উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি নাকি ঘটেছিল এক বাঙালীকে কেন্দ্র করেই। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি লুকিয়ে ছিলেন বনে। পরেরদিন সকালে মন্দিরের সেবায়েতরা এসে আবিষ্কার করেন তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায়। চিকিৎসা করলেও বাকশক্তি আর ফিরে আসেনি তাঁর। কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যুও ঘটে ওই ব্যক্তির। কিন্তু মৃত্যুর আগে একটি চিঠিতে স্পষ্ট বাংলায় তিনি লিখে যান, নিধুবনে নাকি স্বয়ং রাধাকৃষ্ণকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য, ভক্তরা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেন সে কথা। মথুরার সরকারী সংগ্রহশালাতেও ঠাঁই পেয়েছে সেই চিঠিটি। এই উপবনের মধ্যে রয়েছে বাঁকেবিহারী মন্দির, যেখানে রয়েছে কষ্টিপাথরে তৈরি কৃষ্ণের মূর্তি। আর সেই কৃষ্ণই নাকি প্রতি রাতে পা রাখেন এই নিধুবনে, এমনটাই বিশ্বাস ভক্তদের। নিধুবনে যে তুলসী গাছগুলি দেখা যায়, সেগুলির মাটির দিকে অবনত ডালপালা দেখলে প্রণামের ভঙ্গি মনে আসে, ভক্তদের মতে তারা সকলেই ছদ্মবেশী গোপিনী। প্রতি রাতের রাসলীলায় নাকি যোগ দেন এই গোপিনীরাও। এ ছাড়াও নিধুবনে রয়েছে রঙমহল। ভক্তদের বিশ্বাস, রাসলীলার শেষে এখানেই রাধার সঙ্গে বিশ্রাম নেন কৃষ্ণ। তাই রঙমহলে রয়েছে চন্দনকাঠের পালঙ্ক। প্রতিদিন সন্ধ্যাআরতির পরে মন্দির বন্ধ করার পূর্বে পুরোহিত পালঙ্কে পরিপাটি করে শয্যা রচনা করেন এবং তার নিকটে মিষ্টান্ন, তাম্বুল, পানীয় জল, নূতন বস্ত্র, অলঙ্কার, প্রসাধন সামগ্রী, চূয়া, চন্দন এবং নিমগাছের ডাল (দাঁত মাজার জন্য) রেখে আসেন। শোনা যায়, ভোরে মন্দির খোলার পর পুরোহিত রঙমহলে প্রবেশ করে দেখতে পান অসংলগ্ন শয্যার চাদর যা দেখে মনে হবে রাত্রিতে সেখানে কেউ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এছাড়াও মিষ্টান্ন তাম্বুলের পাত্রগুলি দেখে মনে হয় যেন কেউ গ্রহণ করেছেন এবং জলের পাত্র থেকে পানীয় জলগ্রহণের চিহ্ন বর্তমান। প্রসাধন সামগ্রীগুলি এলোমেলো ভাবে রাখা আছে মনে হবে যেন এই প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং চন্দনের বাটিতেও চন্দন নিঃশেষিত। অর্থাৎ সবকিছুকেই নাকি ব্যবহৃত অবস্থায় দেখতে পান তাঁরা। বিশ্বাস আর যুক্তির তর্ক তো চলেই। তবে এই দুয়ের মাঝখানে রয়ে যায় এক রহস্য। তেমন রহস্যের আবরণেই মোড়া বৃন্দাবনের এই নিধুবন। গাইড বললেন নিধুবনের ভিতরে রংমহল মন্দির সম্বন্ধে সব তথ্য আপনাদের বললাম। কিন্তু এই নিধুবনের ভিতরে আরও দুটি মন্দির আছে সেগুলি হল বাঁকেবিহারী মন্দির এবং বংশীচোর রাধা মন্দির। সেগুলি সম্বন্ধে আমার যতটুকু জানা আছে তা আপনাদের বলছি, তাহলে ভিতরে যখন সব দেখবেন তখন কোন অসুবিধা হবে না।
🍂
উপরে বর্ণিত এই নিধুবনের ভিতরে যে বাঁকেবিহারীর মন্দির আছে সে সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানাচ্ছি। আজ থেকে ৫০০ বছরেরও অধিক কাল পূর্বে সম্ভবতঃ ইংরেজী ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে আলীগড়ের নিকটবর্তী এক গ্রাম থেকে ২৫ বৎসর বয়স্ক ভক্ত হরিদাস এখানে এসেছিলেন। তখন বৃন্দাবন জুড়ে ছিল গভীর বন। রাধাকৃষ্ণের একান্ত সাধক অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী ভক্ত হরিদাস যমুনার তীরে বসে আত্মমগ্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নাম গান করতেন আর নিজেকে ভাবতেন কৃষ্ণসখী ললিতা। তাঁর কন্ঠের অসাধারণ সংগীতের ডালি নিয়ে রাধাকৃষ্ণের চরণে অঞ্জলি দিতেন। বৃন্দাবনের নিধুবনে সাধনায় একাত্ম হয়ে তিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেন বাঁকেবিহারী রূপে। তিনি বিশ্বাস করতেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার কৃপা ছাড়া জীবনে আর কিছুই পাওয়ার নেই। তাঁর সমকক্ষ সঙ্গীত সাধক সেই সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষে আর কেউ ছিলেন না। তাঁর কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সংগীত সম্রাট তানসেন, বৈজু বাওরা, মৃগনয়নী দেবী প্রভৃতি যারা পরবর্তীকালে তাঁর যোগ্য উত্তরসাধক রূপে পরিগণিত হয়েছিলেন। শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের সাথে একাত্ম হয়ে বাঁকেবিহারী রূপে তাঁকে এই নিধুবনে দর্শন দিয়েছিলেন। ভক্ত হরিদাস যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি প্রত্যহ সেই বিগ্রহের সেবা পূজা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই বিগ্রহকে পৃথক মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়াও এই নিধুবনে আর একটি মন্দির আছে। সেই মন্দিরের নাম 'বংশীচোর রাধা' মন্দির। প্রবাদ এই স্থানে রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি চুরি করেছিলেন। নিধুবনের ভিতরে যেয়ে আমরা সমস্ত দেখে যখন বেরিয়ে এলাম তখন সন্ধ্যা আরতি শুরু হচ্ছে। সরকারী বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই সন্ধ্যা আরতির পরে সমস্ত দর্শনার্থীদের এখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। রাত্রি আটটা বেজে গেছে বলে গাইড সেদিন আর আমাদের কিছু দেখালেন না। বললেন "আপনারা যদি আগামীকাল আসেন তাহলে বাকি মন্দিরগুলি দেখাবো"। অগত্যা আমরা নিধুবন থেকে বেরিয়ে আমাদের বৃন্দাবনের আবাসস্থল ভারত সেবাশ্রম সংঘের পথে রওনা হলাম।
পরের দিন সকালে আমরা স্থির করলাম নতুন একটি আশ্রয়স্থল খুঁজে নিতে হবে। কারণ এখানে ভারত সেবাশ্রম সংঘের নীচতলার ঘরগুলি অত্যন্ত স্যাঁতসেতে। পূর্বরাত্রে দেখেছি বিছানা থেকে নামলে পা ভিজে যাচ্ছে। আমরা আশ্রম থেকে বেরিয়ে মথুরা বৃন্দাবন-রোডের উপরে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের উল্টোদিকে দেখলাম আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম। আশ্রম বলতে আমাদের মানসলোকে পৌরাণিক যুগের যে মনোহর চিত্রটি ভেসে উঠে এই আশ্রমটি ঠিক তাই। সামনের বড় প্রবেশ দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই পথের দুধারে চমৎকার বাগান। বাগানের পরে সম্মুখভাগে প্রশস্ত চত্বর। চত্বরের পরে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে নাটমন্দির ও মন্দির একই সঙ্গে। মন্দিরটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। গর্ভমন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের এবং নিত্যানন্দের ও আনন্দময়ী মায়ের মূর্তি। নাটমন্দিরের নিচে কয়েকটি কুঠুরি আছে যেখানে সন্ন্যাসীরা তপস্যা ও ভজন করেন। মন্দিরের পিছনেও বাগান। তারই মাঝে সন্ন্যাসীদের বাসগৃহ, বিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস। সমস্ত আশ্রমটি যেন ছায়াশীতল শান্তির নীড়। অতি রমনীয় স্থান। আমরা আশ্রমে গিয়ে আমাদের থাকার কথা বলতে আশ্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সন্ন্যাসিনী সাধ্বী নিত্যানন্দ আমাদের আশ্রমের শ্রীরাম মন্দির নামে একটি বিল্ডিংয়ে একটি ঘর দিলেন। ঘরটি দেখে আমাদের খুব পছন্দ হলো এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আগামীকালই এখানে চলে আসব। সেই ভাবে পরের দিনে যেয়ে আমরা আশ্রমে থাকার নির্দিষ্ট টাকা জমা দিতে থাকার অনুমতি দিলেন। এখানে ভারত সেবাশ্রম সংঘের মত অত্যধিক দর্শনার্থীর চাপ নেই যার ফলে নিরিবিলিতে থাকতে পারব বলে আমার স্ত্রীর খুব আনন্দ হল। এই আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত সেকথা পূর্বে উল্লেখ করেছি।। পুণ্যার্থীদের থাকার জন্য চার পাঁচটি বড় বড় বিল্ডিং আছে। পরবর্তীকালে অর্থাৎ এই বৎসরেরই জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আমরা বৃন্দাবনে পুনরায় গিয়ে এই আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে ন'দিন ছিলাম।
(পরবর্তী অংশ দ্বাদশ পর্বে)
0 Comments