সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২১
গৌতম বাড়ই
একমাস কাল অতিক্রান্ত হয়েছে তারপর। এই রাঢ়ের জনপদ ভয়ে সন্ত্রস্ত সিংহরাজের জন্য। লাঙুলবাবার মৃত্যু হয়েছে সিংহের হাতে। সবাই জানে এখানকার সিংহরাজের একচ্ছত্র আধিপত্য রাঢ়ের পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর সমস্ত ভূমিপ্রদেশের ওপর। তার গুহা আবাস আলো করে থাকে বিচিত্ররঙা বনফুলের সৌরভের মতন মিষ্টি আর সুন্দরী স্ত্রী সুসীমা। রাতে গুহার মুখে বড় বড় পাথর সাজিয়ে তা দিয়ে গুহাপথ আটকে আরও নিরাপদ আশ্রয় তৈরী করা হয় এ গুহা-আবাসের। সিংহরাজের কাছে এই সংসার জীবন সুন্দর আর সাজানো গোছানো শান্তির অবস্থান। আগের জীবন ছিল সত্যি পশুদের মতন। কেউ সচরাচর ঘেঁষে না এই গুহা-আবাসের আশেপাশে। একে তো ভয়ংকর আর লাঙুলবাবার হত্যার পর এই পশুরাজকেও সবাই সমঝে চলে। রাতে তার থেকেও হিংস্র কোনও অচেনা শ্বাপদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাথর দিয়ে আটকে সুরক্ষা নিশ্চিত করেন তিনি।
কোনও কোনও দিন আহারের সামগ্রী জোটাতে তাকে এখানে ওখানে যেতে হয়। সংসারের প্রয়োজনেই তাকেই বেরিয়ে পড়তে হয়। লোকালয় থেকে গরু বা মোষের দুধ জোগাড় করে আনেন তিনি। বনের থেকে ফলমূল সবজি জোগাড় করেন। সুসীমার এখন এইসব আহারের খুব প্রয়োজন। দূরের ভীমাপুরের বৈদ্যরাজ তারাকারুলাল সুসীমাকে দেখে গিয়েছেন। সিংহরাজের এক ডাকেই সটান তিনি হাজির। বলে গিয়েছেন - " সুসীমা মা এখন ভরাপেটের পোয়াতি। খুব সাবধানে রাখতে হবে। হোঁচট খায় না যেন। আর পিছলেও না পড়ে কোথাও। খুব সাবধান। পূর্ণগর্ভ। আগামী ভরা চন্দ্রিমার আগেই দাইকে এনে হাজির রাখতে হবে এখানে। বড় জোর আর এক আগাম পূর্ণশশী। বুঝলে সিংহরাজ?"
দুপুর গড়িয়ে বেলা হচ্ছে আরও। বৈদ্যরাজকে পিঠে বসিয়ে সেই গুহা আবাস থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সুসীমাকে বারবার সাবধান বাণী উচ্চারণ করে গেলেন, খুব খুব সাবধানে সে যেন থাকে। বৈদ্যরাজকে ভীমাপুরের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েই তাড়াতাড়ি তিনি ফিরবেন। আর এই সিংহরাজের গুহা- আবাসের আশেপাশে কারও ঘেঁষবার মতন সাহস এ অঞ্চলে নেই। বৈদ্যরাজকে ভীমাপুরের কাছাকাছি পৌঁছে দেবেন তাকে। বন-জঙ্গল, এই রাঢ়ের পাহাড় ভূমি সিংহরাজ অন্ধকারেও দেখতে পান। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে ওঠে তার চোখ। আজ তার মনের মধ্যে খুশির আনন্দ নিশ্চূপে খেলা করে যাচ্ছে। লাখ- কোটি তারা রাতের অন্ধকার আকাশে শুধু নয়, এই সিংহরাজের মনের আকাশেও ঝিকিমিকি করে যাচ্ছে। বৈদ্যরাজ দুহাতে শক্ত করে সিংহরাজকে আঁকড়ে ধরলেন। ঝড়ের গতিতে সিংহরাজ এগিয়ে চললেন ভীমাপুরের দিকে। দূরের টিলা পাহাড়ের মাথায় সন্ধ্যাপেঁচা কঁ--কঁ--কক করে উঠল। এক দঙ্গল শেয়াল সিংহরাজের পদধ্বনি পেয়েই হুটোপুটি করে গর্তে গিয়ে লুকোলেন। বৈদ্যরাজ সিংহের কাঁধে চড়ে জোরে দু- হাতে তাকে ধরে লাগলেও, যতক্ষণ না ভীমাপুরের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছেন ভয়ে ভেতরে ভেতরে কাঁপছেন। যদি এই দুরন্ত গতির পিঠের থেকে ছিটকে মাটিতে পড়েন , তবে একটাও হাড়গোড় আর আস্ত থাকবে না। সিংহের কাঁধের থেকে ঠিক ঠাহরও করতে পারছেন না কতদূর এলেন? ঠিক সন্ধের মুখে ভীমাপুরের দোরগোড়ায় বৈদ্যরাজকে পৌঁছে দিয়ে সিংহরাজ তার গুহা-আবাসের দিকে ফিরে চললেন।
এবারে সুসীমার জন্য তার মন দুশ্চিন্তায় ভরে উঠলো। শুধু তো সুসীমা নয়, তার গর্ভে বেড়ে ওঠা তার সন্তানও তো আছে! অজানা নানা আশঙ্কায় বুকে তার ডঙ্কা বাজতে লাগল।তাই সে আরও দ্রুত তার গুহাতে ফিরে চলল। আর বুড়ি দাইমাকে আগামীকাল থেকেই সে গুহাতে নিয়ে এসে রাখবে, এই মনে মনে ঠিক করে রাখল।
সে ফিরছে, প্রায় চলে এসেছে তার আস্তানার কাছাকাছি। এমন সময় হাল্কা আলোতে ভরে উঠেছে পৃথিবীর এই জঙ্গল প্রদেশ। মালিমটিলার ওপরে একটা হালকা আলো গায়ে মেখে চাঁদ উঠেছে। সিংহরাজ ঐ দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। এক চুল খোলা বুড়ি চাঁদকে পিঠে করে তার দিকে তাকিয়ে কিম্ভুতকিমাকার হাসিমাখা মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলশালী সিংহরাজেরও ভয় করতে লাগল এতে। আরও দ্রুত পা চালাল সে। গুহার কাছাকাছি এসে সুসীমার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল।
ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো- " ভেতরে এসো । আমরা দুজনাই ভালো আছি। আর এসে দেখো কে এসেছে? তুমি যাবার পর সন্ধের মুখেই সে আমাদের পাহারা দিতে ও যত্ন করতে, দায়িত্ব নিয়ে চলে এসেছে। এসো, ভেতরে এসো-।"
সুসীমার কথা শুনে মশালের লাল- হলুদ আলোয় গুহায় ঢুকেই তাকে দেখতে পেয়ে সিংহরাজ যারপরনাই আশ্চর্য হলেন।
সে কে বা তিনি কে?
(ক্রমশ)
0 Comments