জ্বলদর্চি

অলংকারশিল্পের ঐতিহ্য মেনেই সাহা অলংকারের উত্তর-আধুনিকতা

অলংকারশিল্পের ঐতিহ্য মেনেই সাহা অলংকারের উত্তর-আধুনিকতা

রুম্পা প্রতিহার

 নারী, শাড়ি ও গহনা শব্দ তিনটি পরস্পর সংলগ্ন। একে অপরের সাথে জুড়ে আছে, বা বলা যায়  একে অপরের সহচরী। ছোট্ট টিপ, গায়ের রঙের সাথে মানানসই অতি সাধারণ  শাড়ি আর নতুন প্রযুক্তির হাল্কা অথচ শৌখিন গহনা অতি  আধুনিকার ব্যক্তিগত অভিরুচির সাথে সাথে ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অনন্য উপায়। 
কিন্তু শুধু কি নারী ও গহনা শব্দ দুটি জুড়ে আছে! অলংকারে অলংকৃত হতে সবাই চান। কেউ পছন্দ করেন ক্লাসিক সাবেকি গয়না, কেউ আধুনিক, এক একজনের এক একরকম রুচি। তাই চাহিদাও ভিন্ন। কেউ-বা চান ঐতিহ্য বজায় রেখেই আধুনিকতার স্পর্শ। বিভিন্ন মানের চাহিদা পূরণের চেষ্টায় সফল হয়েছে মেদিনীপুর শহরের ক্যালেকটরী মোড়ের 'সাহা অলঙ্কার'। সাবেকিয়ানা, আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা -- সব বিষয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল। সংস্থার অন্যতম তরুণ অধিকর্তা শ্রী অর্চিশ সাহা এই সব জানেন ও এর মূল্য দেন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতা মিলে মিশে রয়েছে বলেই আজও জেলা ও জেলার বাইরে 'সাহা অলঙ্কার'-এর এত  ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। তিনি বলেন যে, "অলংকার কেবল সাজসজ্জার উপকরণ মাত্র নয়, এগুলি ভারতের সাংস্কৃতিক চিহ্ন, গল্প বলার উপকরণ , এমনকি তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা ঘর গৃহস্থালিও।"
  অলঙ্কার ব্যবহারের প্রাচীনতম ঝলক সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকে দেখা যায়। সেসময়কার দক্ষ কারিগররা টেরাকোটা, ঝিনুক, ন্যূনতম মূল্যবান পাথর দিয়ে গহনা তৈরি করত। নকশায় থাকত উদ্ভিদ, প্রাণীজগতের মোটিফ,জ্যামিতিক চিহ্ন বা পৌরানিক চিত্র। এ হেন সাজসজ্জা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের গভীর ইঙ্গিত বহন করে। ভারতীয় ইতিহাসে গুপ্তযুগ হল শিল্প ও সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। অলঙ্কার শিল্পেও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনুমিত হয়, এই সময় থেকেই প্রাণীজ ও উদ্ভিদজ ফিগার, জ্যামিতিক নকশা ছাড়াও জটিল নকশার গহনা তৈরির সূত্রপাত। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা তাদের নিজস্ব শৈলীগত অনুভব নিয়ে আসে। যার ফলে ভারতীয় অলঙ্কারে আরবীয় নকশা ও নানান নতুন অলঙ্কারের ব্যবহার সংযোজিত হয়। পাশাপাশি চোল, হোয়সলদের মত ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলি নিজস্ব ঘরাণার স্বতন্ত্র শৈলী বজায় রেখেছিল। কিন্তু একই ভূমিতে বসবাসের ফলে তলে তলে মিলাবট তো চলছিলই। 
এরপর ১৮ শতকে ইউরোপীয়দের আগমনে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় গহনায় যুক্ত হয় ফুল, পাতা, ক্যামিওর কারিগরী। আর বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ভারতের ঐতিহ্যবাহী নকশাকে আধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তির সাহায্যে অনন্য রূপদান চলছে। যা নতুন সম্ভাবনার,নতুন কর্মজগতের দ্বার খুলে দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কিছু ডিজাইনার অনন্য  ও জটিল গহনা তৈরিতে 3D প্রযুক্তি  ব্যবহার  করছেন। যার মাধ্যমে গহনা শিল্পে ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রতিফলন যেমন ঘটছে, তেমনি তা ব্যক্তিগত অভিরুচি প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ফল স্বরূপ ভারতীয় গহনা বিশ্বজুড়ে গহনাপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
অর্চিশ সাহা জানালেন, এইসব বিষয় মাথায় রেখেই আধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তির সাহায্যে  আমাদের সুদক্ষ কারিগররা তাদের শিল্পবোধ ও নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেন। সেটাই আজকের তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূলমন্ত্র। 
 আর, এই ব্যবসা যেহেতু বহুদিনের পুরোনো, প্রতিষ্ঠিত, সর্বোপরি  ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের অভিযোজিত করে থাকেন, তাই ক্রেতারা চোখ বন্ধ করে ভরসা করে থাকেন, ঠকে যাওয়ার ভয় পান না। সহজেই পান নিত্যনতুন ডিজাইন সঠিক দামে। আবার ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নতুন রূপে ডিজাইনও এঁরা তৈরি করে দেন। সততা, বিশুদ্ধতা ও বিশ্বাস -- এই তিনটি এঁদের ব্যবসার মূল মন্ত্র। আধুনিকতা থেকে উত্তর-আধুনিকতার যাত্রাপথে তাই সাহা অলঙ্কার আজও অদ্বিতীয়।

Post a Comment

0 Comments