মিলি ঘোষ
সান্তা ক্লজের মুখোমুখি আমি কোনোদিনই হইনি। ঝোলা ভর্তি করে উপহার দিয়ে যাওয়ার গল্প ছোটবেলায় খুব একটা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কারণ, আমার ছোটবেলা হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে-কেল্টু এদের নিয়েই কেটেছে। সঙ্গে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। অদ্ভুত এক মাধুর্য ছিল তাঁর লেখায়। একই কথা বারবার নিয়ে এসে বেশ একটা মজার পরিবেশ গড়ে দিতেন। বিরক্তি তো আসতই না। বরং লাইনগুলো মুখস্ত হয়ে যেত। তাই সান্তা ক্লজের কথা ভাবার অবকাশ হয়নি। তা ছাড়া সান্তা ক্লজের উপহার দেওয়ার মধ্যে কেমন একটা বড়োলোকই গন্ধ আছে। সৌভাগ্যের পরশ আছে। তাই হয়তো সান্তাও আমাকে এড়িয়ে গেছে। আমিও তাকে খুঁজিনি। খুঁজিনি মানে, নামই শুনিনি। শুনেছি অনেক পরে। চেনা-পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন, যারা আমার পরে এই পৃথিবীতে এসেছে, তাদেরও কোনওদিন সান্তা'র থেকে উপহার পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বলে শুনিনি। কাজেই মনের মধ্যে গেঁথে গেছে সান্তা এমন কেউ, যে কল্পনা রাজ্যের রাজপুত্রের মতো। হঠাৎ করে ধুলো উড়িয়ে এসে বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করে ধুলো উড়িয়েই বেরিয়ে যাওয়ার মতো কেউ। সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তার কথা ভাবতে মন্দ লাগে না। কিছুটা রূপকথার গল্পের স্বাদ আছে । কোনও সন্দেহ নেই, তার লাল সাদা পোশাক, সাদা দাঁড়ি গোঁফ, এমন কী সাদা ভ্রু পর্যন্ত বেশ আকর্ষণীয়। ঈষৎ ঝুঁকে হাঁটা ছবিই দেখে আসছি। তা বয়সের ভারে, না উপহারের ভারে বোঝা মুশকিল। কারণ, সান্তা বহুকালের। এত দিনেও সে যখন বহাল তবিয়তে জীবিত, বয়সের ভার তাকে কব্জা করতে পেরেছে কি না সন্দেহ আছে।
বেশ কয়েক বছর আগে খবরের কাগজে দেখেছি, কলকাতার বেহালা অঞ্চলের এক বিখ্যাত ব্যক্তির বাড়িতে সান্তা গেছিলেন। তুমি থেকে আপনিতে এলাম। কারণ, তিনি রক্ত মাংসের সান্তা। একেবারে জীবন্ত। এবং অবশ্যই প্রচার-প্রিয়। ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ ( সালটা মনে নেই ) সেই বিখ্যাত ব্যক্তির মেয়েকে উপহার দিতে গেছিলেন। তা তো যাবেনই। তেলের দাম যতই বাড়ুক, বোতল উপুড় করা চলছেই। কাকে ধন্য করতে গেছিলেন জানি না। না কি নিজেই ধন্য হয়ে ফিরে এলেন, তাও জানা যায়নি। তিনি তাঁর ঝোলাতে কোন ধনরত্ন ভরে নিয়ে গেছিলেন, সে সব আমরা কিছুই জানি না। শুধু জানি, যাকে উপহার দিলেন, সে কিন্তু সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছে। সান্তা যা'ই দিয়ে থাকুন, সবই সেই রাজকন্যার উদ্বৃত্ত। তবু শিশু মন। এভাবে সান্তার থেকে উপহার পেতে কার না ভালো লাগে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখিনি, অনাহারে ক্লিষ্ট বাচ্চাদেরকে উপহার দিচ্ছেন কোনও সান্তা। দিলে তো খবরের কাগজে, ফেসবুকে ছবি থাকতই। ফটো ছাড়া আবার দান হয় না কি ? এদের উপহার দেবার জন্য প্রত্যন্ত গ্রামে যাবার দরকার পড়ে না। বিভিন্ন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আলো করে বসে থাকে যারা, ব্রিজগুলোর তলায় তলায় সংসার পেতেছে যারা, ছাদ বলতে যাদের খোলা আকাশ, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস গায় দেবার মতো ওই একটাই ছেঁড়া কাঁথা, কই তাঁদের কাছে তো ঝোলা নিয়ে যাননি কোনওদিন সান্তা। এদের মুখের ভাষা অশ্রাব্য হলেও সান্তার থেকে উপহার প্রাপ্তি হাতে চাঁদ পাওয়ার সমতুল্যু। সেই সময় এদের মুখের হাসি দেখার সৌভাগ্য কোনও সান্তারই বোধহয় হয়নি। এই অস্থায়ী পরিবারগুলির কিশোর ছেলেরা ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাবার বদলে কুকুরের গায় ঢিল মেরে বেড়ায়। সমাজের নিচু তলার এই কিশোরদের সামনে ঝোলা নিয়ে দাঁড়াতে সান্তার হয়তো কোথাও বাধে।
এভাবে বৈষম্য দূর করা যাবে না জেনেও যারা নিজেদের সামর্থ্য মতো এদের জন্য সত্যিই কিছু কাজ করেন, তাঁদের লাল সাদা পোশাক পড়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বছরের শেষ ক'টা দিন পার্ক স্ট্রিটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত মানুষ হেঁটে বেড়ালো, নেচে গেয়ে পুলিশের কানের কাছে ভেঁপু বাজিয়ে উৎসব মুখর বাঙালি আনন্দ করল। সায়েন্স সিটিতে শিল্প মেলায় নাকি দুর্গা পুজোর অষ্টমীর মতো ভিড় হয়েছিল। আনন্দ এখানেই থেমে থাকে না। রাত জেগে হুল্লোড়, খানাপিনা সবই এখন উৎসবের স্বাভাবিক অঙ্গ। কেউ মাত্রা রাখে, কেউ মাত্রা ছাড়ায়। সে করুক। তাদের ইচ্ছা। তাদের পরিবার বুঝবে কতটা পা বাড়ানো উচিত, কোথায় থামা উচিত। কিন্তু উপহার হাতে সান্তার কি দেখা মিলল ? সান্তার দাড়ি, গোঁফ, ভ্রু এবং চুলের রঙ প্রমাণ করে সান্তা বৃদ্ধ। যেদিন থেকে সান্তার ছবি দেখছি, সেদিন থেকেই বৃদ্ধ। বয়স কত হলো তাঁর ? এখন কি তিনি অতি বৃদ্ধ ? কিন্তু চারদিকে এত হই চই। এর কিছুই কি তাঁর কানে যায় না ?
সান্তা ভক্তদের বলি,
কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না,
সান্তা বৃদ্ধ হয়েছেন, গোলোযোগ সইতে পারেন না।
তবুও, ২৫শে ডিসেম্বর আমাদের কাছে বড়ো বেদনার দিন। ২০১৮ সালের ২৫সে ডিসেম্বরেই গভীর নিদ্রামগ্ন হলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। হারিয়ে গেছেন বলা যায় না। রয়ে গেছেন। কল্পনায় নয়, মিথ্যে আশার প্রতিশ্রুতিতে নয়, উন্মাদনায় নয়। রয়ে গেছেন তাঁর কবিতায়। সহজ সরল ভাষায় মানুষের একেবারে অন্তস্থলে পৌঁছে গেছিলেন। যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন না, তাঁরাও হয়তো নীরেন্দ্রনাথের কবিতা পড়েন। তাঁর কবিতা দু'লাইন পড়ে পাতা উল্টাতে হয় না। পুরোটাই পড়তে হয়। বারবার পড়লেও ক্লান্তি আসে না। প্রতিটি কবিতাই যেন আমাদের কথা। প্রতিদিনের কথা। দৈনন্দিন জীবনে যাদের সামনে দেখেও আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিই, বিশাল ব্যস্ততায় এড়িয়ে যাই, তাদের কথাই থাকে তাঁর কবিতায়। তাই রচিত হয়, 'কলকাতার যিশু'। নিতান্ত গোপনে অমলকান্তি এসে দরজায় কড়া নাড়ে। যে অমলকান্তি স্কুলে যেত দেরি করে। পড়া পারত না। সেই অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অন্য কিছু হতে সে চায়নি। কিন্তু রোদ্দুর সে হতে পারেনি। বড়ো হয়ে সে একটি অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করেছে। কবিতাটা কী সাংঘাতিক! এ অমলকান্তি আমাদের প্রত্যেকের পরিচিত। আমাদের অনেকের মধ্যেই হয়তো একটা অমলকান্তি রয়ে গেছে।
কবির 'কিছু ধুলোবালি, কিছু ছাই' কবিতাটির কয়েকটি লাইন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
"চারিদিকে যত দেখি, তত এই চেনা পৃথিবী
অচেনা হতে থাকে।
হতে পারে, দেখায় আছিল কিছু দোষ --
যে-রকম তোমার, তেমন
হয়তো আমারও।"
আর একটি কবিতার কথা না বললেই নয়। সেটি হলো
'উলঙ্গ রাজা'। এই কবিতাটির একেবারে শেষে এসে কবি বললেন,
"সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক
রাজা, তোর কাপড় কোথায় ?"
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজা যার যার মতো। যত উপরের দিকে তাকানো যাবে, রাজা একাধিক। কিন্তু বক্তব্য একই। সে অর্থে সান্তা ক্লজও কি রাজা নয় ? সেই তো গরিব ঠকিয়ে ধনীর তোষামোদ। সেই তো সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার প্রচেষ্টা। আর মানুষও তো ভুলছে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে। রাজা উলঙ্গ দেখেও হাততালি দিচ্ছে। তবু, জানতে চাইছে না, 'রাজা, তোর কাপড় কোথায় ?'
0 Comments